ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু এপ্রিল-মে মাসে

প্রকাশিত: ২২:৪৯, ২০ জানুয়ারি ২০২১

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু এপ্রিল-মে মাসে

মোয়াজ্জেমুল হক ॥ চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে অর্থাৎ আগামী এপ্রিল ও মে মাস নাগাদ বাংলাদেশে আশ্রিত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু হবে। এর আগে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে দু’দেশের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক হবে। মঙ্গলবার চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সচিব পর্যায়ের ত্রিপক্ষীয় ভার্চুয়াল বৈঠক শেষে এসব তথ্য জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে ব্রিফিংকালে পররাষ্ট্র সচিব জানান, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করার প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এ সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনার জন্য আরও কিছু সময় লাগবে। বিষয়টি বিবেচনা করে আমরা দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রত্যাবাসনের প্রস্তাব দেয়ার পর মিয়ানমার পক্ষ এতে সম্মতি প্রদান করেছে। পররাষ্ট্র সচিব আরও জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে রাখাইন রাজ্যে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার উপস্থিত থাকার বিষয়ে চীন ও মিয়ানমার ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। ফলে আমরা আশা করছি, আগামী এপ্রিল ও মে মাস নাগাদ থমকে থাকা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে। ভার্চুয়াল ত্রিপক্ষীয় এ বৈঠকে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সেখানে নেয়ার প্রক্রিয়ায় গ্রামভিত্তিক প্রত্যাবাসনের প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে মিয়ানমারের কাছে উখিয়া টেকনাফের আশ্রয় শিবিরে বসবাসকারীদের মধ্যে ৮ লাখ ৩০ হাজার ৪২ রোহিঙ্গার তালিকা প্রেরণ করা হয়েছে। তাদের সকলকে প্রত্যাবাসনের আওতায় নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। যদিও মিয়ানমার পক্ষ ওই তালিকা থেকে প্রায় ২৮ হাজার বাস্তুচ্যুতকে রাখাইন রাজ্যের অধিবাসী ছিল বলে স্বীকার করেছে। অবশিষ্ট ১৪ হাজার রোহিঙ্গার কোন তথ্য ভা-ারে নেই বলে জানিয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে আগামী মাসের প্রথমার্ধে বাংলাদেশ মিয়ানমার ওয়ার্কিং গ্রুপের যে বৈঠক হবে সেখানে আলোচনা হবে। পররাষ্ট্র সচিব আরও বলেছেন, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের তাদের স্ব স্ব গ্রামভিত্তিক প্রত্যাবাসনকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। কারণ এতে তাদের নিজ নিজ গ্রাম বা এলাকায় সকলে একসঙ্গে প্রত্যাবাসিত হলে আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে তারা নিরাপদ ও সুরক্ষিতবোধ করবে। তিনি আরও জানান, ভার্চুয়াল বৈঠকে রোহিঙ্গারা ফিরে যাওয়ার পর তারা যেন সে দেশের আইনকানুন মেনে চলে বৈঠকে এ বিষয়ে আশ্বাস চেয়েছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। বৈঠকে মিয়ানমার পক্ষ আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির (আরএসএ) বিষয়টিও উল্লেখ করেছে। উত্তরে বাংলাদেশের পক্ষে আমরা বলে দিয়েছি, এদেশে কোন সন্ত্রাসীর আশ্রয় নেই। কিছু অপরাধী থাকলেও তাদের কোন ধর্মীয় বা রাজনৈতিক পরিচয় নেই। উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশে সরকারী নিবন্ধিত ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা নিবন্ধিত হয়ে আছে। যদিও বেসরকারী পরিসংখ্যানে এ সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখেরও বেশি। ২০১৭ সালের ২৫ মে গভীর রাতে রাখাইন রাজ্যজুড়ে একযোগে সেনা অভিযান শুরু হওয়ার পর তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়। খুন, গুম, ধর্ষণসহ মানবতবিরোধী হেন কোন অপকর্ম নেই যা ঘটেনি। এ অবস্থায় টিকতে না পেরে প্রাণে বাঁচতে রোহিঙ্গারা দলে দলে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে। ওই সময়ে বিষয়টি বিশে^র নজর কাড়ে। বিশে^র বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশকে এ সব বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়ার আহ্বান জানাতে থাকে। সার্বিক বিষয় বিবেচনায় এনে বিশেষ করে মানবতার বিষয়টিকে সবকিছুর উর্ধে রেখে বাংলাদেশ সরকার এদের আশ্রয় দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে সীমান্ত খুলে দেয়। রোহিঙ্গারা নদী, সমুদ্র এবং স্থলপথে যে যে অবস্থায় ছিল সেভাবে সীমান্ত গলিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এরপর মানবতাবিরোধী অপরাধে এ বিষয়টি নিয়ে বিশ্ব থেকে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু প্রবল চাপের মুখেও মিয়ানমারের সামরিক জান্তা নিয়ন্ত্রিত সরকার নতস্বীকার করেনি। মিয়ানমার পক্ষ একপর্যায়ে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা ও গ্রামগুলো বুলডোজার দিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। এতকিছুর পরও যারা সেখানে রয়ে যায় তাদের ওপর আরোপিত হয় কড়া নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে বিশ্ব গণমাধ্যম এবং জাতিসংঘসহ বিশে^র শক্তিশালী বিভিন্ন সংস্থা মিয়ানমারকে এ ঘটনা নিয়ে দোষারোপ করে রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে চাপ সৃষ্টি করে। এ নিয়ে শুরু হয় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে আলোচনা। ২০১৭ সালের ২৩ নবেম্বর দু’দেশের মধ্যে প্রত্যাবাসনে চুক্তি হয়। ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি ফিজিক্যাল এ্যারেঞ্জমেন্ট সম্পর্কিত একটি চুক্তিতেও স্বাক্ষর করে ঢাকা-নেপিদো। এ চুক্তিটি রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে সহায়ক হবে বলে ধারণা করা হলেও মূলত এতেও কোন সুফল আসেনি। মূলত রোহিঙ্গারা ২০২০ সালের মধ্যে সসম্মানে নিজ দেশে প্রত্যাবাসিত হবে এমন প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু তাদের সে আশা পূরণ হয়নি। এরপরও অধিকাংশ রোহিঙ্গা নিজ দেশে ফিরে যেতে চায়, তবে নাগরিকত্বসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্তে। এর আগে আস্থার অভাবে ২০১৮ সালের নবেম্বর এবং ১০১৯ সালের আগস্টে দু’দফায় প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। মিয়ানমার পক্ষ ঠিকই সীমান্তের ওপারে নির্দিষ্ট স্থানে রোহিঙ্গাদের নিতে আসে। বাংলাদেশ পক্ষও ট্রানজিট পয়েন্ট নির্দিষ্ট করে। কিন্তু প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণে রোহিঙ্গারা বিশাল সমাবেশ করে জানিয়ে দেয় রাখাইন রাজ্যে তাদের জন্য নিরাপত্তার বিষয়টি সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এছাড়া তাদের যে নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছে তা ফিরিয়ে দিতে হবে। এছাড়া আরও কিছু শর্ত আরোপ করে। এ ঘটনার পর প্রত্যাবাসন থমকে যায়। আরও পরে মিয়ানমারের কাছে বাংলাদেশ পক্ষ কয়েক দফায় বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের তালিকা প্রেরণ করে। সবশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রেরিত তালিকায় ৮ লাখ ৩০ হাজার ৪২ জন। যদিও মিয়ানমার পক্ষ অত রোহিঙ্গার তালিকা তাদের তথ্য ভা-ারে নেই জানিয়ে মাত্র ২৮ হাজারকে সঠিক বলে জানিয়ে দিয়েছে। পুরো বিষয়টি এখনও আলোচনা সাপেক্ষ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আশা করছে, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ওয়ার্কিং কমিটির যে বৈঠক হবে এতে এ বিষয়ে একটি ফয়সালা হবে। চীনের সন্তোষ ॥ এদিকে বাংলানিউজ জানায়, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরাতে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে চীন। মঙ্গলবার বাংলাদেশ, চীন ও মিয়ানমারের মধ্যে অনুষ্ঠিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠক নিয়ে দেশটি সন্তোষ প্রকাশ করেছে। ঢাকার চীনা দূতাবাস থেকে পাঠানো এক বার্তায় এ তথ্য জানানো হয়।
×