ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নদী দখলের থাবা ॥ ৬৪ জেলায় দখলদার ৬৩ হাজার

প্রকাশিত: ২২:৪৭, ২০ জানুয়ারি ২০২১

নদী দখলের থাবা ॥ ৬৪ জেলায় দখলদার ৬৩ হাজার

রাজন ভট্টাচার্য ॥ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীর পাঁচ হাজার বর্গফুট জমি দখল করে বালুর ব্যবসা পরিচালনা করছেন হাজী মোহাম্মদ আলী। এই এলাকায় নদীর জায়গা দখল করে একই ব্যবসা গড়ে তুলেছেন আবদুল কাদির, আনোয়ার হোসেন, মেসার্স মৌমিতা এন্টারপ্রাইজ, সাদিয়া, মনির এন্টারপ্রাইজসহ ৩০-এর বেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ২০২০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নদী দখলদারদের হালনাগাদ করা তালিকায় এমন চিত্র ওঠে এসেছে। অন্যদিকে রূপগঞ্জের তারাবো এলাকায় শীতলক্ষ্যার বুক ভরাট করে অফিস বানিয়েছেন মোহাম্মদ আলী নামের আরেকজন। একই এলাকায় তানজিম এন্টারপ্রাইজের নামে মোস্তফা কামাল তপন এক হাজার ৪০ বর্গফুটের বেশি নদীর জমি দখল করেছেন। রূপগঞ্জের পূর্বগ্রামে আলম মেরিন শিপ বিল্ডার্সের নামে দখল করা হয়েছে ৭০০ বর্গফুটের বেশি নদীর জায়গা। এখানেই শেষ নয়। এই এলাকার আশপাশে বেশ কিছু ডকইয়ার্ডের নামে নদীর জমি গ্রাস করেছে ভূমিদস্যুরা। নদী রক্ষা কমিশনের দখলদারদের তালিকায় আরও দেখা গেছে, পূর্বগ্রামে খান ডকইয়ার্ডের নামে ৮০০ বর্গফুট নদীর জায়গা দখল করা হয়েছে। এরকম দখলে যুক্ত আরও অন্তত ২০টি ডকইয়ার্ড প্রতিষ্ঠান! নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায়ও ধলেশ^রী নদীর বিভিন্ন এলাকায় চলছে দখলের মহোৎসব। বাদল হোসেনের মালিকানাধীন মেসার্স কনকর্ড ওয়েল সাপ্লাইয়ার্স লিমিটেড কোম্পানির নামে নদীর জমি দখল নেয়া হয়েছে। দখল করা জমিতে পাকা দালান এমনকি নদীর ভেতরের অংশ ভরাট করে তেলের ড্রাম রাখার জায়গা ও পেট্রোল পাম্প নির্মাণ করা হয়েছে! প্রতিটি জেলাতেই কমবেশি নদী দখল হয়েছে। অর্থাৎ দেশের ৬৪ জেলায় নদীর জমিতে রয়েছে ভূমিদস্যুদের থাবা। নদী কমিশনের প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা গেছে, টাঙ্গাইল সদরের পশ্চিম আকুরটাকুর এলাকায় লৌহজং নদীর জায়গা দখল করেছে হাউজিং সোসাইটি নামের একটি প্রতিষ্ঠান। একই নদীর জায়গা দখল করে পশ্চিম আকুরটাকুর নদীর পাড় এলাকায় শহীদুল ইসলাম ও মহসিন সিকদার নামে দুই ব্যক্তি দুইতলা পাকা বাড়ি নির্মাণ করছেন। পশ্চিম আকুরটাকুর নদীর পাড়ে দিব্যি তিনতলা ভবন করছেন রাশেদুল হক নামের আরেকজন। একই এলাকায় নদীর জায়গা দখল করে দুইতলা পাকা বাড়ি ও দোকানঘর নির্মাণ করেছেন শিমুল খান। তালতলা আকুরটাকুর এলাকায় একই নদীর জমি দখল করে দুটি একতলা ভবন নির্মাণ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দা মজিবুর রহমান। টাঙ্গাইল সদরের লৌহজং নদীর পাড় দিঘুলিয়া মৌজা এলাকার স্টেডিয়াম পাড়ায় নদীর জমিতে তিনতলা ভবন নির্মাণ করেছেন মীর রুহুল আমীন মিলন নামে এক ব্যক্তি। একই নদীর জায়গা দখল করে পার দিঘুলিয়ার পশ্চিম আকুরটাকুর পাড়া এলাকায় একতলা ভবন নির্মাণ করেছেন আনোয়ার হোসেন খান ও রাউফুর রহমান। ইসলামবাগের বেড়াডোমাব্রিজ সংলগ্ন নদীর জায়গা দখল করে দ্বিতল ভবন ও দোকান নির্মাণ করেছেন জহিরুল হক। একই এলাকায় নদীর জমিতে দুইতলা ভবন করেছেন মেহেদি হাসান মিঠু নামের আরেকজন। নদীর জমি নিজের মনে করে দখলের মাত্রা একটু বাড়িয়েই দিয়েছেন মোহাম্মদ জমশেদ আলী। তিনি পাড় দিঘুলিয়ার স্টেডিয়াম পাড়ায় অবৈধভাবে সাততলা ভবনসহ আধাপাকা ঘর নির্মাণ করেছেন। একই এলাকায় আব্দুস সাত্তার নিজের মতো করে নদীর জমিতে নির্মাণ করেছেন তিনতলা আরেকটি ভবন। এই পরিস্থিতিতে চলমান উদ্ধার অভিযানের মধ্যেও বাড়ছে নদী দখলের মাত্রা। দীর্ঘ হচ্ছে দখলকারীদের তালিকাও। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে স্থানীয় লোকজন নদীর জমি দখলের সঙ্গে যুক্ত। দখলে যুক্ত নানা পেশার প্রভাবশালী ব্যক্তিসহ তাদের পরিচিত বা নিকটাত্মীয় স্বজনও। অনেক সময় স্থানীয় প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পেশিশক্তি ব্যবহার করে নদীর জমি দখল নেয়া হচ্ছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বারবারই বলা হচ্ছে, যে কোন মূল্যে নদীর জমি নদীকে ফিরিয়ে দেয়া হবে। দখলের সঙ্গে কোন আপোস হবে না। এরই ধারাবাহিকতায় তালিকা ধরে ধরে চলছে উচ্ছেদ অভিযানও। তবে বিভিন্ন এলাকায় নদীর জমি উচ্ছেদের পর তদারকি না করায় ফের দখল হওয়ারও খবর আছে। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, নদীর জমি দখলমুক্ত করার পর তদারকি না থাকায় ফের দখল হচ্ছে। এভাবেই বেড়ে ওঠছে দখলদারের সংখ্যা। সেইসঙ্গে তালিকাভুক্ত দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন অনেকেই। তারা বলছেন, সরকারী জমি বা নদী দখলের অপরাধে আইনী ব্যবস্থায় দখলদারদের জেল জরিমানার যে বিধান রয়েছে বিভিন্ন আইনে তা নিশ্চিত করা গেলে দখলের মাত্রা কমে আসতে পারে। সেইসঙ্গে রাজনৈতিকভাবেও দখলদারদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। কমিশনের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক সহযোগিতার অভাবে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে অনেক সময় আইন প্রয়োগ কঠিন হয়ে যায়। এজন্য রাজনৈতিক সমর্থন জরুরী বলেও মনে করেন তারা। জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয় (বুয়েট) নৌযান ও নৌযন্ত্র কৌশল বিভাগের অধ্যাপক মীর তারেক আলী বলেন, আমরা প্রতিবছর একদিকে দেখছি নদী দখলমুক্ত করতে অভিযান চলছে, অন্যদিকে প্রতিবছর বাড়ছে দখলদার। তিনি বলেন, দখল উচ্ছেদ ও উচ্ছেদকৃত ভূমি যেন আবার দখলে না যায় এ দুটি কাজ একসঙ্গে চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু আমরা তা লক্ষ্য করছি না। অভিযোগ আছে, উচ্ছেদের পর রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকঠাক হয় না। ফলে দ্রুত উচ্ছেদকৃত ভূমি আবারও দখলে চলে যায়। এতে একই কাজ বারবার করতে হচ্ছে। অর্থাৎ আবারও টাকা খরচ করে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতে হয়। তিনি বলেন, নদীর জমি যদি দখলমুক্ত রাখা যায় তবেই প্রতি বছর দখলদারের তালিকা দীর্ঘ হবে না। সেইসঙ্গে নদী ফিরে পাবে তার নিজের জমি। ফিরবে নাব্য। নদী নিয়ে সরকারের পরিকল্পনাও দ্রুত সময়ের মধ্যে সফল হবে। পাশাপাশি কমবে নদীদূষণের মাত্রাও। ৬৩ হাজার দখলদার ॥ দেশের ৬৪ জেলায় নদী দখলদারের সংখ্যা এখন প্রায় ৬৩ হাজার। সম্প্রতি এই হিসাব তুলে ধরা হয়েছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের পক্ষ থেকে। কমিশনের বিদায়ী চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার এ তথ্য জানান। যা ২০১৮ সালের হিসাবে ছিল ৫০ হাজারের মতো। সম্প্রতি কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৯ প্রকাশ করা হয়েছে। কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে নদী দখলদারদের সংখ্যা ছিল ৫৭ হাজার। মুজিবুর হাওলাদার বলেন, এখন প্রায় ৬৩ হাজার হবে। প্রতিবেদন অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি নদী দখলদার খুলনা বিভাগে। সেখানে সংখ্যাটি ১১ হাজার ২৪৫ জন। আর উচ্ছেদ করা হয়েছে ৪ হাজার ৮৯০ জন অবৈধ দখলদারকে। নদী দখলদারের সংখ্যা সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে ২ হাজার ৪৪ জন। এই বিভাগে ২০১৯ সালে উচ্ছেদ করা হয়েছে ৫৭৬ জনের অবৈধ স্থাপনা। ঢাকা জেলায় নদী দখলকারী সাড়ে ছয় হাজারের বেশি ॥ ঢাকা বিভাগে নদী দখলদারের সংখ্যা ৮ হাজার ৮৯০ জন। উচ্ছেদ করা হয় নদীর জমিতে থাকা ১ হাজার ৪৫২ জনের ৫ হাজার ৯৩৫টি স্থাপনা। ঢাকা জেলায় বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, ইছামতি, বালু, বংশী, গাজীখালী, কালীগঙ্গাসহ মোট ১১টি নদী ও ২০১টি খালের উল্লেখ রয়েছে প্রতিবেদনে। ঢাকা জেলায় নদী দখলদারের সংখ্যা ৬ হাজার ৭৫৮ জন। এরমধ্যে উচ্ছেদ করা হয়েছে ৫ হাজার ৭৯৯ জনের স্থাপনা। প্রতি বছর নদী দখলদারের সংখ্যা বাড়ার কারণ প্রসঙ্গে নৌসড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, নদী দখলের সঙ্গে যুক্তদের বেশিরভাগই রাজনৈতিক পরিচয়ে প্রভাবশালী। কেউ কেউ প্রশাসনিক প্রভাব নিয়েও নদীর জায়গা দখল করছেন। তিনি বলেন, দখল হওয়া স্থাপনা উচ্ছেদ করলেই হবে না, দখলকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও জরুরী। এতে দখল কমবে। সেইসঙ্গে রাজনৈতিক পরিচয়ে যারা নদীর জায়গা দখল করছে তাদের বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থা নেয়ারও পরামর্শ দেন তিনি। নারায়ণগঞ্জে দখলদারের সংখ্যা ৭৮৫ ॥ কমিশনের হিসাব অনুযায়ী শিল্পনগরী নারায়ণগঞ্জে নয়টি নদী ও ২১৮টি খাল রয়েছে। সেখানে নদী ও খাল দখলদারের সংখ্যা ৭৮৫ জন। ছোট বড় সবকটি নদী ও খাল দখল হয়েছে। বেশি দখল হয়েছে শিল্পায়নের নামে। বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, শিল্পের নামে নদীর পাশে জায়গা কিনে স্থাপনা নির্মাণের সময় নদীর জায়গা দখল করা হয়েছে। আবার এমনও আছে সরাসরি নদীর জমি দখল করেই নির্মাণ করা হয়েছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এদিকে মানিকগঞ্জ জেলায় নদীর সংখ্যা ১৬টি আর খাল ১১৭টি; দখলদারের সংখ্যা ১ হাজার ৩৯৯ জন। ফরিদপুর জেলায় ১৩টি নদী ও ১৫টি খাল রয়েছে; দখলদারের সংখ্যা ১ হাজার ৮৩৪ জন। টাঙ্গাইল জেলায় নদী দখলদারের সংখ্যা ১ হাজার ৭৮৮ জন। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৬৪ জেলায় মোট ৫৭ হাজার ৩৯০ জন নদী দখলদারের ১৮ হাজার ৫৭৯টি স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। তবে পর্যাপ্ত অর্থায়ন ও সক্ষমতা না থাকার কারণে জেলা প্রশাসন পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রত্যাশিত উচ্ছেদ অভিযান চালানো সম্ভব হয়নি বলে কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। সেইসঙ্গে করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে গত বছর উচ্ছেদ অভিযান বাধাগ্রস্ত হয়েছে। নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মজিবুর হাওলাদার বলেন, চেষ্টা করেছি একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিতে। তবে অনেক প্রতিবেদন সময় মতো হাতে না পৌঁছানোয় পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিতে পারিনি। ১ হাজার ৪৫৬ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন তাদের কার্যাবলী, দেশের নদ-নদী পরিদর্শন ও পরিবীক্ষণ কার্যক্রম, প্রশাসনিক ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি নদ-নদীর চিহ্নিত সমস্যা ও সমাধানে সুপারিশ, গৃহীত পদক্ষেপ ও অগ্রগতি তুলে ধরা হয়। পুরানা পল্টনের হোসেন টাওয়ারে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। হারিয়ে গেছে ১৯ হাজার কিলোমিটার নৌপথ ॥ দেশে একসময় ২৪ হাজার কিলোমিটার নদীপথ ছিল। দখল, দূষণ ও ভরাটে হারিয়ে গেছে ১৯ হাজার কিলোমিটার নৌপথ। বর্তমানে ৫ হাজার কিলোমিটারেরও কম নদীপথে চলছে নৌযান। সারাদেশে ৫৩টি রুটের ১২ হাজার কিলোমিটার নৌপথ খননের জন্য ২০১২ সালে ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প গ্রহণ করে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। প্রাথমিক পর্যায়ে ২৪টি রুটে ১ হাজার ২৪ কিলোমিটার নৌপথ খননের কাজ ২০২১ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। গত ৮ বছরে ৭৫ শতাংশ নদী খনন কাজ শেষ হয়েছে বলে প্রকল্প সূত্র জানায়। সূত্র জানায়, সারাদেশের অভ্যন্তরীণ ৫৩টি নৌরুটের ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের জন্য ২০১২ সালের ১৪ নবেম্বর একনেক প্রকল্পটি অনুমোদন করে। প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এক্ষেত্রে প্রথম দফায় ২৪টি এবং দ্বিতীয় দফায় ২৯টি গুরুত্বপূর্ণ নদীপথ খনন করার কথা রয়েছে। নদী খননের এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার নৌপথ সচল হবে। প্রকল্পের সংশোধিত ব্যয় ১ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা। মেয়াদ জুলাই ২০১২ থেকে জুন ২০২১ পর্যন্ত। প্রকল্পের আওতায় ২৪টি নৌপথে ৯৯৭ লাখ ঘনমিটার খননের মাধ্যমে ২ হাজার ৩৮৬ কিলোমিটার নৌপথের নাব্য উন্নয়ন করা। চলতি ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে কমিয়ে ১০৮ কোটি করা হয়েছে। প্রথম কিস্তির ছাড় করা ৩৭ দশমিক ৫০ কোটি টাকার মধ্যে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩৬ দশমিক ৫৪ কোটি টাকা। চলতি ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা জানান, সারাদেশের নদীপথ উদ্ধারে একাধিক প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৫৩টি নৌরুটে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের আওতায় সারাদেশে নদী খনন কাজ চলছে। ২০২১ সালের জুনের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। এ ছাড়া গোমতী ও ব্রহ্মপুত্রসহ আগামী ৪-৫ বছরে প্রায় ১০ হাজার নৌপথ উদ্ধার করা হবে। বছরে ১৯ হাজার দখলদার উচ্ছেদ ॥ নদী কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার জানান, গত একবছরে প্রায় ১৮ হাজার ৫৭৯ দখলদারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এক বছরে দখল ও দূষণকারীর তালিকা ৫৭ হাজার ৩৯০ থেকে ৬৩ হাজার ২৪৯ তে পৌঁছেছে। পরিকল্পনামন্ত্রী আবদুল মান্নান জানান, নদী কমিশনের মাধ্যমে নদীকে বাঁচানোর উদ্যোগ আমাদের প্রধানমন্ত্রীর। আমরা এ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আগামী ক্যাবিনেট সভায় নদী কমিশনের বিষয়গুলো প্রধানমন্ত্রীর সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করব, যাতে এটি আরও গুরুত্ব পায়। তিনি জানান, নদী দখল ও দূষণ রোধে আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে ২০০ কোটি টাকা চেয়েছি। পাশাপাশি দুই প্রকল্পের প্রস্তাব জমা দিয়েছি পরিকল্পনা কমিশনে। করোনার কারণে আমাদের কিছু কাজ পিছিয়ে গেছে। অর্থ ও প্রকল্পগুলো অনুমোদন পেলে আমরা যেসব কাজে পিছিয়ে গেছি তা কাটিয়ে উঠতে পারব। গত বছরের প্রতিবেদন ॥ কমিশনের গত বছর প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের ৭৭০টি নদীর জমি দখল করেছে ৫৭ হাজার ৩৯০ ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান। গত একবছরে তাদের মধ্যে ১৮ হাজার ৫৭৯ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে উচ্ছেদ করেছে বিভিন্ন জেলার প্রশাসন। দখলদারদের মধ্যে অন্তত ১০ শতাংশ স্থানীয় এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। সংসদীয় কমিটির কাছে জমা দেয়া কমিশনের প্রতিবেদন এনআরসিসি জানায়, প্রতিটি বিভাগেই নদী ও নদীর তীরে বিশালাকার কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। দখলদাররা স্থানীয়ভাবে শক্তিশালী এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় সেগুলো ভেঙ্গে ফেলা যায়নি। প্রতিবেদনে এনআরসিসি আরও বলেছে, বার বার চেষ্টা করেও বিভিন্ন সরকারী অবকাঠামোগুলোও সরানো যায়নি। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, সারাদেশে নদী দখলদারদের সংখ্যা প্রতি বছর বাড়ছে বিষয়টি তেমন নয়। একসঙ্গে চূড়ান্ত প্রতিবেদন করা যায় না। তাছাড়া বারবার তদন্তে নতুন নতুন দখলের চিত্র ওঠে আসায় দখলদারের সংখ্যা বাড়ে মনে হয়। তিনি বলেন, দেড় বছর আগে দেয়া প্রতিবেদনে আমরা সারাদেশে ৪৯ হাজার ১২৬ জন নদী দখলদারের কথা বলেছিলাম। তখন সবকিছু চিহ্নিত করা যায়নি। জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় বার বার তদন্তে নতুন দখলদারদের নাম ওঠে আসে। গত একবছরে ১৯ হাজার নদী দখলদারদের নির্মাণ করা স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে একথা উল্লেখ করে কমিশনের সদ্য বিদায়ী এই চেয়ারম্যান বলেন, তিন ভাগের একভাগ দখল ইতোমধ্যে উচ্ছেদ করা হয়েছে। নানা কারণে কয়েক দশকে চোখের সামনে নদীগুলো দখল হয়েছে একথা উল্লেখ করে হাওলাদার বলেন, সমন্বিত প্রচেষ্টা থাকলে বাকি দখলও মুক্ত করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে নদী ও পরিবেশ রক্ষায় আইন হয়েছে। আইন প্রয়োগের পাশাপাশি অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। তাছাড়া নদী দখলের অভ্যাস দেশে এখন স্থায়ী রূপ নিয়েছে। শুকনো মৌসুমে নদী শুকিয়ে গেলে দখলের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। এজন্য নদীর নাব্য বজায় রাখার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সব নদী নাব্য ফিরে পেলে দখল কমবে। সেই সঙ্গে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করে পানির ন্যায্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে নদীগুলো প্রবাহ ফিরে পাবে। তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী কেউ নদী দখল করলে এক থেকে সাত বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। কেউ নদীর প্রবাহ বন্ধ করলে অন্য আইনেও শাস্তির বিধান আছে। নদী দখল একটি ফৌজদারি অপরাধ একথা উল্লেখ করে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, উচ্চ আদালতের পক্ষ থেকেও নদী দখলকারীদের প্রয়োজনে শাস্তি বাড়ানোর আদেশ দিয়েছে। সেইসঙ্গে দখলকারীদের থেকে ক্ষতিপূরণও আদায় করা যাবে। তাছাড়া কেউ যদি নদীর জমি ভরাট করে সেক্ষেত্রে মাটি ও বালু ব্যবস্থাপনা আইনে দুই বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানার বিধান আছে। পানিতে বর্জ্য ফেলা হলে ১০ বছর পর্যন্ত দণ্ড দেয়া যায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো আইনের যথাযথ প্রয়োগ একেবারেই নেই। কিন্তু শাস্তির বিধান আছে। কেন আইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আইনে নদী সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়া যাচ্ছে না। ভয়ে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো। পেশি শক্তি ও রাজনৈতিক কারণে অফিসাররা ভয় পান সাজা দিতে। এজন্য রাজনৈতিক সাপোর্ট জরুরী উল্লেখ করে সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, কঠোর আইন প্রয়োগের আগে মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। এজন্য কমিশনের পক্ষ থেকে ট্রেনিং প্রোগ্রাম চলমান রাখারও পরামর্শ দেন তিনি।
×