ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

এরা সবাই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি

ইন্টারপোলের সর্বশেষ রেড এ্যালার্ট তালিকায় ৭৮ বাংলাদেশী

প্রকাশিত: ২৩:০৬, ১৯ জানুয়ারি ২০২১

ইন্টারপোলের সর্বশেষ রেড এ্যালার্ট তালিকায় ৭৮ বাংলাদেশী

শংকর কুমার দে ॥ ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন (আন্তর্জাতিক পুলিশ অপরাধ সংস্থা)- ইন্টারপোলের রেড এ্যালার্টের সর্বশেষ তালিকায় বর্তমানে আছে ৭৮ বাংলাদেশীর নাম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিয়ে বেড়ানো এসব নাগরিকের মধ্যে আছে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত থেকে বিভিন্ন মেয়াদের সাজাপ্রাপ্ত বা দণ্ডিত আসামি। এসব আসামির মধ্যে আছে যুদ্ধাপরাধী, বঙ্গবন্ধুর খুনি, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার আসামি, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের আসামি, জঙ্গী গোষ্ঠীর পলাতক জঙ্গী, মানব পাচারকারী, অর্থ পাচারকারী, শীর্ষ সন্ত্রাসী ও কুখ্যাত অপরাধীদের নাম। চলতি মাসে ইন্টারপোল সদর দফতর থেকে বাংলাদেশের পুলিশ সদর দফতরের ইন্টারপোল শাখাকে এক চিঠিতে জানিয়েছে, ইতালীতে ১জন ও লিবিয়ায় ১জন মোট ২ মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য গ্রেফতার হয়েছে। আগামী এক মাসের মধ্যেই ইতালী ও লিবিয়ায় গ্রেফতার হওয়া ২ মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া ও প্রস্তুতি শুরু করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতর সূত্রে এ খবর জানা গেছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ইন্টারপোলের রেড নোটিসের তালিকায় বর্তমানে ৭৮ বাংলাদেশীর নাম ও পরিচয় আছে। তালিকায় যাদের নাম আছে তাদের অপরাধের ধরনও বলা আছে। আছে ঠিকানা, বয়স ও ছবি। তাদের মধ্যে গ্রেফতারকৃত দু’জন মানব পাচারকারীও আছেন। গত বছর লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশী হত্যাকাণ্ডের পর মানব পাচারকারীদের ধরতে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চায় বাংলাদেশ। তাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেফতারে রেড নোটিস জারি করেছে পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থাটি। এর মধ্যে দু’জন গ্রেফতার হয়েছেন। বাংলাদেশের যে দুই পলাতক মানব পাচারকারী গ্রেফতার হয়েছেন তারা হলেন মাদারীপুরের শাহাদাত হোসেন এবং কিশোরগঞ্জের জাফর ইকবাল। আর জাফর ইকবালকে ইতালীতে গ্রেফতার করা হয়েছে। ইতালীর পুলিশ ১০ জানুয়ারি পুলিশ সদর দফতরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোকে (এনসিবি) চিঠি দিয়ে গ্রেফতারের খবর জানিয়েছে। জাফরকে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এজন্য সর্বোচ্চ দেড়মাস সময় লাগতে পারে। সিআইডি পুলিশের অনুরোধে মানব পাচার চক্রের মোট ৬ জনের বিরুদ্ধে নোটিস জারি করেছে ইন্টারপোল। গত বছরের মে মাসে লিবিয়ার মিজদাহ শহরে মানব পাচারকারীরা গুলি করে ২৬ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করে, সেই মামলায় শাহাদাত ও জাফর আসামি। আরও চার আসামি হলেন বাংলাদেশী মিন্টু মিয়া, স্বপন, নজরুল ইসলাম মোল্লা ও তানজিরুল। তাদের ধরিয়ে দিতে গত নবেম্বরে ইন্টারপোল রেড নোটিস জারি করে। এই ৪ জনের এখনও হদিস করতে পারেনি ইন্টারপোল। তদন্তে মানব পাচার চক্রের আরও অন্তত ২০ জনের নাম আসতে পারে যারা বিদেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। মানব পাচারকারী চক্রের ৬ জনের বাইরে আরও জড়িত যাদের নাম আসবে তাদের ধরার জন্যও রেড নোটিস জারির অনুরোধ করা হবে ইন্টারপোলকে। এর আগে ইন্টারপোলের সহায়তায় দুবাইতে বাংলাদেশী একটি মানব পাচারকারী দলকে আটক করা হয়েছে। কুয়েতেও মানব পাচারকারীদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে। তাদের ব্যাপারেও ইন্টারপোলের সহায়তা নেয়া হবে। ইন্টারপোলের সঙ্গে বাংলদেশ পুলিশ ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে বলে পুলিশের দাবি। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, বিদেশে সাড়ে তিন হাজার টাকা পাচার করার অভিযোগে প্রশান্ত কুমার হালদার-পিকে হালদারের বিরুদ্ধে পুলিশ সদর দফতর থেকে রেড নোটিস জারির জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে ইন্টারপোলকে। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পিকে হালদারের নাম ইন্টারপোলের রেড নোটিসে প্রকাশিত হয়নি। তার অর্থ পাচারের মামলাটি তদন্ত করছে দুর্র্নীতি দমন কমিশন-দুদক। তবে কুয়েতে আটক এমপি পাপুলের বিষয়ে এখনও কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। ইন্টারপোল সংস্থাটি নিজেরা তথ্য পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হলে তালিকায় কারও নাম অন্তর্ভুক্ত করে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ইন্টারপোলের রেড নোটিসে যে ৭৮ জনের নাম রয়েছে তার মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতকদের নামও আছে। বঙ্গবন্ধুর খুনি নূর চৌধুরী, খন্দকার আব্দুর রশীদ, নাজমুল আনসার, শরিফুল হক ডালিম, আহমেদ শরিফুল হোসেন, মোসলেম উদ্দিন, রাশেদ চৌধুরীর নাম আছে। যুদ্ধাপরাধ মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতকদের নাম। যুদ্ধাপরাধের মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতকদের মধ্যে আবদুল জব্বার ইঞ্জিনিয়ার ও মাওলানা আবুল কালাম আজাদ আছে তালিকাতে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলায় পলাতক মাওলানা তাজউদ্দিনের নাম রয়েছে যিনি জঙ্গী নেতা। জঙ্গী নেতা মাওলানা তাজউদ্দিনের নাম রয়েছে যিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিরোধীদলীয় নেতা থাকাকালে হত্যা চেষ্টার পরিকল্পনাকারীদের অন্যতম ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলারও আসামি। মডেল তিন্নি খুনের অভিযোগের আসামি হিসেবে রয়েছে সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভির নাম। বিএনপির সময়ের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও বিএনপি নেতা হারিস চৌধুরীর নাম ও ছবিও আছে এই তালিকায়। বহুল আলোচিত হাওয়া ভবনের কর্ণধার তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ হারিছ চৌধুরী ওয়ান ইলেভেনের পর থেকেই নিখোঁজ আছেন। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মামলার আসামি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত গোপালগঞ্জের আশরাফুজ্জামান খান, ফেনীর মইনউদ্দিন চৌধুরীর নামও ঝুলছে ইন্টারপোলের রেড নোটিসে। এছাড়াও রয়েছে দেশের টপটেরর বা শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, আমিনুর রসুল, হারিস আহমেদ, জাফর আহমেদ, নবী হোসাইন, জিসান, শাহাদাত হোসাইন, মোল্লা মাসুদ, সুব্রত বাইন, কালা জাহাঙ্গীর, খন্দকার তানভীর ইসলাম জয়। রয়েছে, রফিকুল ইসলাম, নবী হোসাইন, তৌফিক আলম, মিন্টু, আতাউর রহমান, নাসির উদ্দিন রতন, চান মিয়া, প্রশান্ত সরদার, সুলতান সাজিদ, হারুন শেখ, মনোতোষ বসাক, আমিনুর রহমান, আহমেদ বাবু, সৈয়দ মোহাম্মদ হোসাইন, জাহিদ হোসেন খোকন, সুরত আলম, সাজ্জাদ হোসেন খান, হাসেম কিসমত, মো. ইউসুফ, নাঈম খান, মকবুল হোসাইন ও সালাহউদ্দিন মিন্টু, আনজুম ফারজানা, খান মোহাম্মদ শহীদ উদ্দিন, অশোক কুমার দাস, চন্দন কুমার, সুজন শহীদ কামাল, আলী আকবর ভুট্টো, আমান উল্লাহ শফীক, সাজ্জাদ হোসাইন খান, হুসাইন মকবুল, মজনু আহমেদ, দিপু নুরুল ও শহীদ সুলতানের নাম। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, হালনাগাদ করা হয় ইন্টারপোলের রেড নোটিসে তালিকাধারীদের নাম ও পরিচিতি। সর্বশেষ বাংলাদেশের ৭৮জনের নাম ইন্টারপোলের রেড নোটিসের তালিকায় ঝুলছে। ইন্টারপোলে রেড নোটিস যাদের বিরুদ্ধে জারি করা হয়, তারা সবাই শীর্ষ অপরাধী ও পলাতক। এদের অবস্থান ও গ্রেফতারে ইন্টারপোল চেষ্টা চালায়। সন্ত্রাসীকে গ্রেফতারের পর নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়। আন্তার্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের সহায়তায় বিদেশে পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে। পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ ইন্টারপোলের সদস্য পদ লাভ করে। আন্তর্জাতিক এ সংস্থার রেড নোটিস কোন গ্রেফতারি পরোয়ানা নয়। ইন্টারপোল আসামিকে গ্রেফতারে কোন বাহিনী পাঠায় না বা কোন দেশকে চাপও দিতে পারে না। তারা শুধু এ সংক্রান্ত তথ্য সদস্যভুক্ত ১৯০টি সদস্য দেশ ও সেদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন বিভাগকে অবগত করে। বন্দী বিনিময় চুক্তি না থাকাসহ নানা কারণে রেড নোটিস জারি থাকলেও এসব আসামিকে দেশে ফিরিয়ে আনা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তবে যেসব দেশের সঙ্গে বন্দী বিনিময় চুক্তি নেই তাদের সঙ্গে চুক্তি করে অথবা আইনী প্রক্রিয়ায় বিদেশে পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনার বিষয়টি অনেকটাই সহজ ও চেষ্টা করা হচ্ছে।
×