ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বগুড়ার সেই তুফান সরকার ফের টক অব দ্য টাউন

প্রকাশিত: ২২:৫২, ১৯ জানুয়ারি ২০২১

বগুড়ার সেই তুফান সরকার ফের টক অব দ্য টাউন

স্টাফ রিপোর্টার, বগুড়া অফিস ॥ প্রায় পৌনে চার বছর আগে- ২০১৭ সালের মধ্য জুলাইয়ে বগুড়ায় এক তরুণী শিক্ষার্থী সরকারী কলেজে ভর্তির প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে। ধর্ষণের শিকার হয়। প্রতিবাদ করলে মেয়ে ও তার মাকে নির্যাতনের পর মাথা ন্যাড়া করে দেয়া হয়। ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়েছিল মূল নায়ক তুফান সরকার ও তার দশ সহযোগীকে। দেশজুড়ে নিন্দার ঝড় ওঠে। সকলেই জানতে চেয়েছিল কে এই- তুফান সরকার। স্পর্শকাতর ঘটনার সেই তুফান সরকার জামিন পেয়েছেন রবিবার। রাতেই জামিনের কথা এক কান থেকে চার কান হয়ে পৌঁছে যায় সকল মহলে। সোমবার দিনভর তুফান সরকারের ঘটনা কৌতূহলী সাধারণের মধ্যে রিক্যাপ হয়ে মুখে মুখে ফেরে। পরিণত হয় টক অব দ্য টাউনে। রবিবার সকালে বগুড়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালত-১ এ সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মামলার বাদী মেয়ের মা এবং ঘটনার শিকার মেয়ে দুজনেই বলেন : ঘটনার স্থান কাল তারা কিছুই জানেন না। তুফান সরকারের বিরুদ্ধে তাদের কোন অভিযোগ নেই। ধর্ষণের কোন ঘটনা ঘটেনি। মামলার এজাহারে বর্ণিত অভিযোগ সত্য নয়। এজাহারে কি লিখা ছিল তা পড়ে দেখেন নি। জোর করে এজাহারে স্বাক্ষর নেয়া হয়েছিল। ভুল বোঝাবুঝি থেকে এই মামলা হয়েছিল। এরপর আদালতের বিচারক এ কে এম ফজলুল হক অভিযুক্ত তুফান সরকারের জামিন মঞ্জুর করেন। এই বিষয়ে সোমবার দুপুরে ওই আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি (পাবলিক প্রসিকিউটর) নরেশ মুখার্জী জনকণ্ঠকে বলেন, প্রধান অভিযুক্ত তুফান সরকারের জমিন শুনানির আগে মামলার অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রধান সাক্ষী বাদী নিজে এবং অন্যতম সাক্ষী ঘটনার শিকার মেয়ের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। তাদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তুফান সরকারকে জামিন দিয়েছে আদালত। তিনি বলেন, আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা তুফান সরকারের জামিনের ঘোর বিরোধিতা করেছেন। আদালত দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে জামিন দিয়েছে। পিপি নরেশ মুখার্জী জানান, এই মামলার বিচারকাজ এখনও শেষ হয়নি। ফাইনাল রায় জানা যাবে ট্রায়াল শেষে। আইনে আছে যদি প্রমাণ হয় বাদী মিথ্যা সাক্ষী দিয়েছে তাহলে শাস্তির বিধান আছে। তিনি জানান, জয়পুরহাটের এক মামলার এমন সাক্ষীতে এক ব্যক্তির কারাদণ্ডাদেশ হয়েছিল। জামিনপ্রাপ্ত তুফান সরকার বগুড়া শহর শ্রমিক লীগের বহিষ্কৃত আহ্বায়ক। বাড়ি শহরের চকসূত্রাপুর। মামলায় তার পক্ষে আইনজীবী ছিলেন আবদুল মোন্নাফ, নুরুস সালাম ও রবিউল ইসলাম। পিপি নরেশ মুখার্জী বলেন, তুফানের বিরুদ্ধে মা মেয়েকে নির্যাতনের পর চুল কেটে দেয়ার অভিযোগে আরেকটি মামলা চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আছে। তুফান সরকার ছাড়া মামলার অন্য অভিযুক্তরা জামিনে রয়েছেন। তারা হলেন তুফানের স্ত্রী তাছমিন রহমান ওরফে আশা, আশার বড় বোন বগুড়া পৌরসভার ২ নম্বর সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী কাউন্সিলর মারজিয়া হাসান ওরফে রুমকি, তুফানের শাশুড়ি লাভলী রহমান ওরফে রুমি, তুফানের সহযোগী আতিকুর রহমান ওরফে আতিক, মুন্না, আলী আযম, মেহেদী হাসান ওরফে রুপম, সামিউল হক ওরফে শিমুল ও এমারত আলম খান ওরফে জিতু। ২০১৭ সালের ১৭ জুলাই মেয়েকে (১৭) ভাল কলেজে ভর্তি ও বিয়ের প্রলোভনে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়। এই ঘটনায় বিচার চাইতে গেলে মেয়ে ও তার মাকে কৌশলে নির্যাতন এক পর্যায়ে নাপিত ডেকে এনে দুইজনের মাথার চুল কেটে দেয়া হয়। ধর্ষণের শিকার মেয়েটির মা বাদী হয়ে ২০১৭ সালের ২৯ জুলাই বগুড়া সদর থানায় ধর্ষণ এবং মাথা ন্যাড়া করে দেয়ার অভিযোগে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন। তুফান সরকারের জামিনের প্রতিক্রিয়ায় কয়েক সুধীজন যা বলেন : বগুড়া সরকারী আজিজুল হক কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ত্বাইফ আল মামুন বলেন, সুধীজনের মধ্যে মানসিক চিন্তা বাড়ল। সমাজের এই ধরনের দৌরাত্ন্য বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। ধর্ষণের শিকার মেয়ে ও তার মার প্রতি সাধারণের যে সহানভূতি ছিল তাও হারিয়ে গেল। অন্য নারীরা নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত অবস্থায় থাকল। টিআইবির নাগরিক সংগঠন সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ওসমান গনি বললেন, এ যেন এক অশনিসঙ্কেত। সমাজে বেঁচে থাকা কঠিন হবে। এমন দৃষ্টান্ত অন্য অপরাধীদের উৎসাহিত করতে পারে। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সেক্টর কমান্ডার ফোরামের নেতা মাসুদার রহমান হেলাল বলেন, মানুষ চায় সঠিক বিচার। অপরাধী যেই হোক সে যেন বিচারের আওতায় এসে শাস্তি পায়। দেশজুড়ে চাঞ্চল্যকর ঘটনায় পৌনে চার বছর পর মেয়ে ও মায়ের (বাদী ও অন্যতম সাক্ষী) এ ধরনের সাক্ষ্য দেয়া খুবই দুঃখজনক। কি করে এটা ঘটল তাও খতিয়ে দেখা দরকার। বগুড়া থিয়েটারের কর্ণধার ও গ্রাম থিয়েটারের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক তৌফিক হাসান ময়না জানালেন : তিনি শুনেছেন ঘটনার মীমাংসা হয়ে গেছে। তা যদি হয় তাহলে সমাজের জন্য কখনও ভাল ফল বয়ে আনবে না। সেদিনের ঘটনাক্রম ॥ ধর্ষণের শিকার মেয়ে ও তার নির্যাতিতা মাকে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডের ২৯ নম্বর ক্যাবিনে ভর্তি করা হয়। এর আগে ডাক্তারী পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। ভর্তির ১১ দিন পর ছাড়পত্র দেয়া হয়। তার আগে হাসপাতালে শেষবারের মতো তাদের শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। বিভাগীয় প্রধান বলেছিলেন, মেয়ে ও মায়ের শারীরিক ক্ষত সেরে উঠছে। তবে মানসিক ক্ষত সারতে কিছুটা সময় লাগবে। এটা নির্ভর করছে দিনে দিনে মেয়েটি ঘটনা ভুলে কতটা স্বাভাবিক হতে পারে। তারপর মেয়ে ও মাকে পুলিশী নিরাপত্তায় অতিরিক্ত জেলা দায়রা জজ-১ ও শিশু আদালতে হাজির করে তাদের নিরাপত্তা বিধানে আদালতের কাছে আবেদন জানায় পুলিশ। আদালতের তৎকালীন বিচারক মোঃ ইমদাদুল হক সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে ধর্ষণের শিকার তরুণীকে রাজশাহী সেফ হোমে এবং মেয়ের নির্যাতিতা মাকে (যিনি এই মামলার বাদী) কোন ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখার আদেশ দেন। এর আগে আদালত মেয়ে ও মায়ের কাছে জানতে চায় কোথায় তারা থাকতে চান। মেয়ে এ সময় আদালতকে জানায় রাজশাহীতে হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করতে চায়। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষ আদালতকে জানায়, মেয়ের মা এই মামলার বাদী। তাদের নিরাপত্তা নেই। আদালত তখন মেয়ের বাবাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন তিনি তার স্ত্রী ও মেয়েকে নিজের হেফাজতে রাখতে চান কিনা। এ সময় মেয়ের বাবা আদালতকে জানান তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এই অবস্থায় তিনি নিজের হেফাজতে না রাখার মত প্রকাশ করে বলেন এই ঘটনার অভিযুক্তদের তিনি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান। আদালতের নির্দেশের পর বগুড়ার তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সনাতন চক্রবর্তী আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী মেয়েকে রাজশাহী সেফ হোমে এবং মেয়ের মাকে ঢাকা অথবা রাজশাহী যেখানে ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টার আছে সেখানে রেখে আসেন। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে যা ছিল ॥ তুফান সরকার সরাসরি ঘটনার কথা স্বীকার করেনি। যা বলেছে তা পরোক্ষভাবে। যে কারণে তাকে তিন দফায় পুলিশী রিমান্ডে নেয়া হয়। তারপরও পুলিশ সদুত্তর পায়নি। সূত্র জানায়, তুফানের স্বীকারোক্তি না পাওয়া গেলেও এজাহারভুক্ত অভিযুক্ত তুফানের সহযোগী ক্যাডার সন্ত্রাসী আতিক ও মুন্না এবং এজাহার বহির্ভূত অভিযুক্ত নরসুন্দর (নাপিত) জীবন আদালতে ১৬৪ ধারায় যে জবানবন্দী দিয়েছে তাতে সম্পূর্ণ বিষয় পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে। এর আগে ধর্ষণের শিকার তরুণী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২২ ধারায় আদালতে জবানবন্দী দেয়। পুলিশ আদালতের আদেশে তুফানকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করে। ওই সময় পুলিশ জানিয়েছিল- ঘটনার যে তথ্য উপাত্ত, আলামত, জবানবন্দী এবং সাক্ষ্যপ্রমাণ পুলিশের হাতে আছে তা মামলার চার্জশীট দেয়ার জন্য যথেষ্ট। বগুড়ার এই ঘটনার পর তুফানের স্ত্রী আশা, জ্যাঠাস পৌরসভার নারী কাউন্সিলর মার্জিয়া হাসান রুমকী ও তাদের মা রুমী খাতুন কি প্রকৃতির ওই সময়ে তা লোকমুখে ফেরে। তুফানের ক্যাডাররা ধর্ষণের শিকার মেয়ে ও মাকে অপহরণ করে রুমকীর বাড়িতে নিয়ে যায়। রুমকীর নির্দেশে তুফানের তিন ক্যাডার মেয়ে ও মাকে নির্যাতন করে মাথা ন্যাড়া করে দেয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সুধীজনের কথা ॥ আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে। আইন চায় তথ্য প্রমাণ। সেই প্রমাণের দায়িত্ব আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের।
×