ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দুর্নীতি ও জঙ্গীবাদ নির্মূলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে : রাষ্ট্রপতি

প্রকাশিত: ১৭:৪০, ১৮ জানুয়ারি ২০২১

দুর্নীতি ও জঙ্গীবাদ নির্মূলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে : রাষ্ট্রপতি

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তুলতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখে দেশ থেকে দুর্নীতি, মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গীদের নির্মূলের লক্ষ্যে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির যে পথে আমরা হাঁটছি, সে পথেই আমাদেরকে আরও এগিয়ে যেতে হবে। তাই আসুন, দল-মত-পথের পার্থক্য ভুলে গিয়ে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আমরা লাখো শহীদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করি। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সোমবার একাদশ জাতীয় সংসদের একাদশ অধিবেশনের (শীতকালীন অধিবেশন) প্রথম দিনে ভাষণ দিতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, আমরা আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দারপ্রান্তে। এ বছর মধ্য-আয়ের দেশ হিসেবে আমরা ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী’ পালন করবো। তবে, আমাদের লক্ষ্য ২০৪১ সালে বিশ্বসভায় একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশের মর্যাদায় অভিষিক্ত হওয়া। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জনগণের সর্বাত্মক অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমরা একটি কল্যাণমূলক, উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে সক্ষম হবো। গণতন্ত্রায়ন, সুশাসন ও নিরবিচ্ছিন্ন আর্থসামাজিক উন্নয়নে সকল রাজনৈতিক দল, শ্রেণী ও পেশা নির্বিশেষে ঐকমত্য গড়ে তোলার সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করার উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, জাতীয় সংসদ দেশের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার কেন্দ্রবিন্দু। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, পরমতসহিষ্ণুতা, মানবাধিকার ও আইনের শাসন সুসংহতকরণ এবং জাতির অগ্রযাত্রায় সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলকেও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে হবে। রাষ্ট্রপতি সরকারি দল ও বিরোধী দল নির্বিশেষে মহান জাতীয় সংসদে যথাযথ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ‘মুজিববর্ষ’ পালনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু অভিন্ন সত্তা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক কিংবদন্তি। আপোষহীন নেতৃত্ব দৃঢ় মনোবল আর ত্যাগের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রধান নেতা। প্রতিটি বাঙালির কাছে তিনি পৌঁছে দিয়েছেন মুক্তির মূলমন্ত্র। তিনি বলেন, জীবিত বঙ্গবন্ধুর মতোই অন্তরালের বঙ্গবন্ধু শক্তিশালী। মুজিববর্ষ উদযাপনের লক্ষ্যে গৃহীত কর্মসূচিসহ কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারীর কারণে নির্ধারিত সময়ে যথাযথভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব না হওয়ায় সরকার মুজিববর্ষের মেয়াদকাল ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করেছে। মুজিবর্ষে গৃহীত সকল কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে জানতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। রেওয়াজ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সংসদের উত্তর প্লাজা দিয়ে আইন সভায় ভবনে প্রবেশ করেন। সংসদ ভবনে প্রবেশ করে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বিশেষ লিফটে চড়ে সাত তলায় তাঁর চেম্বারে যান। সেখান থেকে বিকেল ৪টা ৫৪ মিনিটে অধিবেশন কক্ষে যান রাষ্ট্রপতি। স্পীকার রাষ্ট্রপতিকে তাঁকে আমন্ত্রণ জানালে বিউগলে ফ্যানফেয়ার বাজানো হয়। স্যুট-কোট পরিহিত রাষ্ট্রপতি অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করলে সবাই দাঁড়িয়ে তাঁকে সম্মান জানান এবং নিয়মানুযায়ী জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয়। স্পীকারের পাশের চেয়ারে বসেন রাষ্ট্রপতি। স্পীকার তাঁকে ভাষণ দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানানোর পর ডায়াসে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন রাষ্ট্রপ্রধান। ভাষণের সংক্ষিপ্তসার সংসদে পাঠ করেন রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতি তাঁর পুরো ভাষণটি পঠিত বলে গণ্য করার জন্য আহ্বান জানালে স্পীকার তা গ্রহণ করেন। বক্তব্য শেষে রাষ্ট্রপতি সংসদ অধিবেশন প্রস্থানের সময়ও জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয়। রাষ্ট্রপতি তাঁর ভাষণে বলেন, দেশে আইনের শাসন সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, যুদ্ধপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারসহ চাঞ্চল্যকর অন্যান্য মামলার রায় দ্রুত প্রদান করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও শক্তিশালীকরণের পাশাপাশি জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও তথ্য কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দুর্নীতি, মাদক, জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাস ও উগ্রবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে এবং জনজীবনে স্বস্তি বিরাজ করছে। তিনি বলেন, বৈশ্বিক মহামারী করোনার প্রভাবে গোটা বিশ্বের ন্যায় আমাদের অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, কর্মসংস্থান, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পসহ অর্থনীতির সকল সেক্টরে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩১ দফা নির্দেশনাসহ ভার্চুয়াল কনফারেন্সের মাধ্যমে নানামুখী দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছেন। সামাজিক সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সংবলিত এক লাখ ২১ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকার ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। রপ্তানীমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদান অব্যাহত রাখায় প্রায় ৫০ লাখ শ্রমিক-কর্মচারীর চাকরি সুরক্ষা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি বলেন, বিনামূল্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ, ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রয় এবং নগদ অর্থ বিতরণ ইত্যাদি সরকারি কর্মসূচির কারণে দেশের একটি মানুষও করোনাকালে না খেয়ে থাকেনি। সময়োপযোগী ও আকর্ষণীয় প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার কর্মসৃজন ও কর্মসুরক্ষা, অভ্যন্তরীণ চাহিদা সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সচল রাখায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। প্রধানমন্ত্রীর সময়োচিত সাহসী সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশ করোনা পরিস্থিতি সাফল্যের সঙ্গে মোকাবেলা করে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোভিড-১৯ সঙ্কট মোকাবেলায় গৃহীত পদক্ষেপসমূহ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। তিনি বলেন, এরই ধারাবাহিকতায় প্রথিতযশা সাময়িকী ‘ফোবর্স’ কর্তৃক প্রকাশিত নিবন্ধে করোনা মোকাবেলায় সফল নারী নেত্রীদের তালিকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্তর্ভূক্ত হয়েছেন। কোভিড-১৯ জনিত প্যানডেমিকের সফল মোকাবেলা, অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন ও জীবনমান সচল রাখার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গ প্রণীত ‘কোভিড-১৯ সহনশীল র‌্যাংকিং’-এ বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষ এবং বিশ্বে ২০তম স্থান অর্জন করেছে। এর মাধ্যমে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়, প্রাজ্ঞ ও দূরদর্শী নেতৃত্বের জন্য এ অর্জন সম্ভব হয়েছে। এজন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভিনন্দন ও আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। রাষ্ট্রপতি তাঁর ভাষণে বলেন, বিশ্বশান্তি, গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ নির্মূল, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং তথ্যপ্রযুক্তির খাতের উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তনর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীকে প্রদত্ত আন্তর্জাতিক পুরস্কার এবং সম্মাননাসহ সমগ্র বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও দূরদর্শী দর্শন-চিন্তায় আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ সম্মাননাসহ অর্জন সম্ভব হয়েছে। রাষ্ট্রপ্রধান বলেন, বাঙালি জাতির জীবনে শ্রেষ্ঠ গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ওয়ারিশদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংবলিত একটি ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম প্রস্তুত করা হয়েছে। এর ফলে সরাসরি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাংক হিসাবে সম্মানি ভাতা প্রদান সহজতর হয়েছে। তিনি বলেন, মুজিববর্ষের উপহার হিসেবে ১৪ হাজার গৃহ নির্মাণ করে বিনামূল্যে অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রদান করার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণ স্থানকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ‘মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্র স্থাপন’- এর নির্মাণ কাজ শুরু হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন শীর্ষক প্রকল্প এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্যানোরমা নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। সরকার খুব শীঘ্রই দেশের জনগণকে কোভিড-১৯ টিকা প্রদান করতে পারবে উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড এবং ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট অব লাইফ সাইন্সেস প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে ৩ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন সরাসরি ক্রয়ের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সিএমএসডি’র মাধ্যমে জরুরিভিত্তিতে ভ্যাক্সিন ক্রয় বাবদ ৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ভাতীয় প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে প্রদান করা হয়। আমি আশা করছি সরকার খুব শীঘ্রই দেশের জনগণকে কোভিড-১৯ এর টিকা প্রদান করতে পারবে।
×