ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কালো টাকার কতটুকু সাদা হয়েছে?

প্রকাশিত: ০০:৫২, ১৭ জানুয়ারি ২০২১

কালো টাকার কতটুকু সাদা হয়েছে?

বিগত ১১ জুন ২০২০ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী (২০২০-২০২১) অর্থবছরে যে বাজেট প্রস্তাব পেশ করেছিলেন তাতে বলা হয়েছিল দেশের প্রচলিত আইনে যা-ই থাকুক না কেন, ব্যক্তিশ্রেণীর করদাতাদের চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত জমি, বিল্ডিং, ফ্ল্যাট ও এ্যাপার্টমেন্টের প্রতি বর্গমিটারের ওপর নির্দিষ্ট হারে এবং নগদ অর্থ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড বা যে কোন সিকিউরিটিজের ওপর ১০ শতাংশ কর দিয়ে আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করলে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ অন্য কোন কর্তৃপক্ষ কোন প্রশ্ন করতে পারবে না। অর্থমন্ত্রী আরও বলেছিলেন একই সময় ব্যক্তিশ্রেণীর করদাতারা পুঁজিবাজারে অর্থ বিনিয়োগ করলে, ওই বিনিয়োগের ওপর ১০ শতাংশ কর দিলে, আয়করসহ কোন কর্তৃপক্ষ প্রশ্ন করবে না। এর বাইরে বিনিয়োগ চাঙা করতে বিদায়ী অর্থবছর থেকে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে আসছে সরকার। সেখানে বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগকৃত অর্থের ১০ শতাংশ কর দিলেই প্রশ্ন করবে না এনবিআর। ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত এই সুযোগ আছে। এখন পর্যন্ত কেউ হাইটেক পার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চলে কালো টাকা বিনিয়োগ করেননি বলে জানা গেছে। বিদায়ী অর্থবছরে ফ্ল্যাট কেনায়ও তেমন সাড়া পায়নি সরকার। এই সংখ্যা ছিল একশ’র মতো। এ পর্যন্ত দেশে ১৭ বার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এতে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি টাকা সাদা হয়েছে ২০০৭ ও ২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। ওই সময় ৩২ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এই সুযোগ নিয়েছিল। তখন ৯ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা বৈধ করা হয়। বাজেট ঘোষণায় ব্যবসা শিল্প ও আবাসন খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করা অথবা অপ্রদর্শিত আয় প্রদর্শিত করার যে সুযোগের কথা বলা হয়েছে, তা বিগত সময়ের বাজেট ঘোষণাগুলোতে এমনভাবে আসেনি। সম্ভবত সরকার মনে করছে এ সুযোগের ফলে অর্থপাচার রোধ হবে এবং অর্থনীতির মূলধারায় বিনিয়োগ হলে যা প্রবৃদ্ধিকে (জিডিপি) ত্বরান্বিত করবে; যা কর্মসংস্থান তথা মাথাপিছু আয় বাড়ানোরও একটি মাধ্যম। কিন্তু এ ব্যাপারে ভিন্নমত রয়েছে অনেকের। যেমন এ প্রক্রিয়া অবৈধভাবে আয় উপাজর্ন ও আয়কর ফাঁকিকে যেমন উৎসাহিত করবে অন্যদিকে বৈধপথে উপার্জনকারী নিয়মিত ও সৎ করদাতাকে নিরুৎসাহিত করবে, দুই দলের মধ্যে বৈষম্য বাড়াবে এবং অনৈতিক চর্চা প্রসারিত হবে। কিন্তু তাত্ত্বিকভাবে এ বিষয়টিকে অর্থনীতির চর্চায় তেমনভাবে গুরুত্ব দেয়া হয় না। তাই প্রশ্ন স্বভাবতই আসে বিষয়টি কী? কালো টাকার একটা নিজস্ব ধারণা রয়েছে যেমন দেশের কর আইনে কালো টাকার সংজ্ঞা না থাকলেও অপ্রদর্শিত আয় কথাটি উল্লেখ আছে বিধায় যে ব্যক্তি তার আয়কর রিটার্নে তার আহরিত আয় প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয় সেই টাকাকেই কালো বলে ধরা হয়; যদিও এই আয় অবৈধ পথে নাও হতে পারে। এখন অনেকে বলছে অপ্রদর্শিত আয় দুই রকমের যথাÑ (১) বৈধ অর্জন কিন্তু আয় রিটার্নে প্রদর্শিত হয়নি; (২) অবৈধ উপায়ে অর্জন; যার ওপর আয়কর দেয়া হয়নি। এখন নির্দিষ্ট পরিমাণ কর জরিমানাসহ প্রদান সাপেক্ষে অর্থনীতির মূলধারায় কালো টাকাকে সম্পৃক্ত করার প্রচেষ্টাকে কালো টাকা সাদা করা বলা হয়। অর্থনৈতিক দর্শনে কালো টাকাকে বিভিন্নরূপে দেখানো হয়েছে। যেমন- ধূসর, নিমজ্জিত, অনানুষ্ঠানিক, সুপ্ত, সমান্তরাল ইত্যাদি। যার মূল উৎস অনৈতিকতার ছাপে আবদ্ধ বিভিন্ন রূপে যেমন- ঘুষ, মানুষ পাচার, স্বর্ণ পাচার, চাঁদাবাজি, জমি কেনা-বেচার দালালি ইত্যাদি। যার গতিময়তা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বেশি যা কোন নিয়মের ছকে আবদ্ধ করা যায় না। এখন মধ্যবিত্ত আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থানটা কী তা নিয়ে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। কারণ বাজেট আসলেই এ বিষয়টি নিয়ে নানা ধরনের উক্তি করতে দেখা যায়। বিশেষত বিশ্লেষকদের কাছে ছদ্মবেশে বিষয়টি রয়েই যায়; যা কর্তৃপক্ষ সরাসরি বলতে বা ঘোষণায় কিছুটা রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির আশ্রয় নেয়। কারণ বিষয়টি অনেকটা অনৈতিক দার্শনিক শাস্ত্রের মানদণ্ড। ১৯৭১ সাল থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পরিচালিত রাষ্ট্র-কাঠামোতে কালো টাকা সাদা করার বিতর্কটি ছিল না। কিন্তু পঁচাত্তর পরবর্তী সামরিক সরকারগুলো এ বিষয়টিকে নিয়ে আসে বিভিন্ন আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এবং বাজেটের আগে-পরে এ বিষয়টি হালে পানি পায় এই যুক্তিতে, যা জিডিপির একটি বড় অংশ; যা অর্থনীতির মূল ধারায় নিয়ে আসতে না পারলে উন্নয়ন অনেকাংশে ব্যাহত হবে। এখন আসা যাক অর্থনীতিতে কালো টাকার পরিমাণ কত এবং এখন পর্যন্ত কত টাকা সাদা করা হয়েছে এই হিসাবে। বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের ২০১১ সালের গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী দেখা যায় যে, ২০০৯ সালে অর্থনীতিতে ৬২ দশমিক ২ শতাংশ কালো টাকা ছিল, যার পরিমাণ ৫ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা; যা সম্প্রতি ঘোষিত বাজেটের চেয়েও বেশি। বাংলাদেশে ১৯৭৫ পরবর্তী সময় থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র ১৩ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা সাদা করা হয়েছে এবং সরকারের রাজস্ব আদায় হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা; যার জন্য এ সুযোগটা রাখা হয়েছে ঘোষিত-অঘোষিতভাবে। সর্বশেষে বলা যায়, এই কালো টাকা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সময় ব্যয় না করে এর একটি স্থায়ী সমাধানের দিকে যাওয়া উচিত; যার দিকে নীতি-নির্ধারকদের মনোযোগ দিতে হবে।
×