ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মৌসুমি ফল উৎপাদনে দেশের অবস্থান শীর্ষ দশে

ফলের উৎপাদন এক যুগে বেড়েছে ২০ লাখ টন

প্রকাশিত: ২২:৫৬, ১৭ জানুয়ারি ২০২১

ফলের উৎপাদন এক যুগে বেড়েছে ২০ লাখ টন

ওয়াজেদ হীরা ॥ দেশে ফলের উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। কৃষি নিয়ে সরকারের সুষ্ঠু পরিকল্পনার প্রভাব পড়েছে ফলের উৎপাদনেও। একযুগে ফলের উৎপাদন বেড়েছে বিশ লাখ মেট্টিক টনের বেশি। উৎপাদন বৃদ্ধির হারে সারাবিশ্বে বাংলাদেশ প্রথম। মৌসুমি ফল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। শুধু গত এক বছরেই দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন ফলের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় আড়াই লাখ মেট্টিক টন। দেশের ফল চাষীরাও বেশ ভাল অর্থ পাচ্ছে। অনেকের ভাগ্য বদলাচ্ছে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন ফল চাষের মাধ্যমে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশী-বিদেশী জাত মিলে ৭ লাখ ২৯ হাজার ২৮০ হেক্টর জমিতে উৎপাদিত ফলের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ২৩ লাখ ৮৯ হাজার টন। এর আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ হেক্টর জমিতে দেশে ফলের উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ২১ লাখ ৫২ মেট্টিক টন। একদিকে বেড়েছে দুই হাজার হেক্টর জমি। অন্যদিকে গত অর্থবছরে আগের চেয়ে ২ লাখ ৩৭ হাজার মেট্টিক টন উৎপাদন বেড়েছে। এছাড়া ২০১৭-১৮ তে সাত লাখ ২৪ হাজার ২৮ হেক্টর জমিতে ১ কোটি ২১ হাজার ১৩ মেট্টিক টন, ২০১৬-১৭ তে সাত লাখ ১৫ হাজার ৯৪১ হেক্টর জমিতে উৎপাদিত হয় ১ কোটি ২০ লাখ ৯৬ মেট্টিক টন ফল। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের দেশে এখন ফল উৎপাদন অনেক ভাল পর্যায়ে আছে। সরকার কৃষককে সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে এখন। অধিক পুষ্টিকর খাবার হিসেবে শাকসবজি, ফলমূল খাচ্ছে মানুষ। এতে করে উৎপাদন হলেও কৃষকের লোকসান নয় বরং আয় বেড়েছে। আমরা অপ্রচলিত ফসল নিয়েও কাজ করছি। নতুন, পুরাতন জাত মিলে আমের উৎপাদন অনেক বেড়েছে। এছাড়া বড়ই, যেটি এক সময় মানুষ খেতে চাইত না সেটি এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে। তার মানে চাহিদা বেড়েছে। এ রকম প্রায় সব ধরনের ফলের চাষ এখন বাণিজ্যিকভাবে হচ্ছে। মানুষও এখন আগের চেয়ে ফল খায় বেশি বলে জানান ড. আব্দুর রাজ্জাক। একযুগে বাংলাদেশে ফল উৎপাদনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এক তথ্যে জানা গেছে, ১৮ বছর ধরে বাংলাদেশে সাড়ে ১১ শতাংশ হারে ফল উৎপাদন বাড়ছে। বাংলাদেশ কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বের দ্বিতীয়, আমে সপ্তম ও পেয়ারায় ষষ্ঠ। আম, কাঁঠালের বাইরে মৌসুমি ফলের মধ্যে আছে জাম, লিচু, কুল, কামরাঙা, পেঁপে, বেল, লেবু, আনারস, আতা, সফেদা, লটকন, তরমুজ, ফুটি। বাংলাদেশ আয়তনে বিশ্বে ৯৪তম। জনসংখ্যায় অষ্টম। সার্বিকভাবে ফল উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ২৮তম হলেও উৎপাদনের হার বিবেচনায় বিশ্বে শীর্ষস্থানে। একই সঙ্গে নিত্যনতুন ফল চাষের দিক থেকেও বাংলাদেশ সফলতা পেয়েছে। এত কম আয়তনের দেশ হয়েও ফল চাষে জমি বৃদ্ধির দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে। বছরে ১০ শতাংশ হারে ফল চাষের জমি বাড়ছে। শুধু ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির দিক থেকে নয়, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু ফল খাওয়ার পরিমাণও গত একযুগে দ্বিগুণ হয়েছে। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের মানুষ দিনে ৫৫ গ্রাম করে ফল খেত। ২০১৯ সালে তা ৮৫ গ্রামে উঠে আসে। একসময় দেশে কাঁঠাল ও আম প্রধান ফল হিসেবে থাকলেও এখন অন্তত ২২ প্রজাতির ফল মানুষ নিয়মিত খায়। গত ১০ বছরে দেশে পেঁপে আড়াই গুণ, আমের উৎপাদন দ্বিগুণ, পেয়ারা দ্বিগুণের বেশি এবং লিচু উৎপাদন ৫০ শতাংশ বেড়েছে। চার/পাঁচ বছরের মধ্যে নতুন ফল ড্রাগন, দেশী ফল বাতাবিলেবু, তরমুজ, লটকন, আমড়া ও আমলকীর মতো পুষ্টিকর ফলের উৎপাদনও ব্যাপক হারে বাড়ছে। এসব ফলের প্রায় পুরোটাই দেশে বিক্রি হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মোঃ আসাদুল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা উৎপাদন বৃদ্ধির হারে বিশ্বে প্রথম। এটি অত্যন্ত গৌরবের মনে করি। সরকারের কৃষি নিয়ে নানামুখী উদ্যোগের প্রতিফলনের মধ্যে ফল উৎপাদন তারই একটি। কেননা, কৃষকরা এখন নানা ধরনের উচ্চ ফলনশীল জাত পাচ্ছে। সরকার নীতি-কৌশলগত সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছে। বিদেশী ফল এখন আর হাতের বাইরে নয়, এদেশেই উৎপাদন হয়। অনেকেই লাভবান হচ্ছে বলে ফল চাষে ঝুঁকছেন। জানা গেছে, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর থেকে ধারাবাহিকভাবেই ফলের উৎপাদন বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি ও পলিসি গ্রহণের কারণে অনেকেই শুধু ধান চাষে সীমাবদ্ধ নেই। কৃষির বহুমুখী কর্মকাণ্ডে ছড়িয়ে যাচ্ছে। ফলের উৎপাদন তারই একটি নিদর্শন। একাধিক কৃষিবিদ জানিয়েছেন, সরকার কৃষককে নানা ধরনের প্রণোদনা, ব্যাংকিং ঋণে সুবিধা দেয়ার কারণে অনেকেই ফুল-ফল চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। দেশে বিভিন্ন বিদেশী জাতের ফল চাষ হচ্ছে। এটি এক সময় অকল্পনীয় ছিল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে জানা গেছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরের চেয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে অর্থাৎ একযুগে ফলের উৎপাদন বেড়েছে ২০ লাখ মেট্টিক টনের বেশি। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৯ লাখ ৩৫ হাজার ৯১৮ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হতো ১ কোটি ৩ লাখ ৪১ মেট্টিক টন ফল। তার পরের অর্থবছরেই দুই লাখ হেক্টর জমি কমলেও উৎপাদন বেড়ে হয়েছিল ১ কোটি ৪ লাখ ৫৩ হাজার মেট্টিক টন। শুধু ২০১৩-১৪ অর্থবছর ব্যতীত বাকি সকল অর্থবছরেই ফলের উৎপাদন শুধু বেড়েছেই। গত অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয়েছে আমের। সারাদেশে আমের উৎপাদন ছিল ২৪ লাখ ৬৮৭ হাজার ৫০ মেট্টিক টন। এর পরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল কলার। কলার উৎপাদন ছিল ২২ লাখ ৫২ হাজার ৫৯২ মেট্টিক টন। একই সময়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল জাতীয় ফল কাঁঠালের। কাঁঠালের উৎপাদন ছিল ১৮ লাখ ৬৫ হাজার ৫০০ মেট্টিক টন। তরমুজের উৎপাদন ছিল ১৪ লাখ ৫২ হাজার ৫৯২ মেট্টিক টন। যদিও তালিকায় নিচের দিকে আছে বিদেশী ফল ড্রাগনের। তবে দেশে ক্রমেই যে ড্রাগন ফলের চাষ বাড়ছে সেটিও বোঝা যায় পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে। গতবার তিন হাজার ৪৬৩ মেট্টিক টন ফলন হয়েছে। দেশে কাজুবাদামের ব্যাপক বি¯ৃÍতি হচ্ছে। গতবার ১৩২২ মেট্টিক টন ফলন ছিল। জানা গেছে, বিদেশী ফলের চাহিদা বাড়ায় দেশেই এখন মাল্টা, ড্রাগন, স্ট্রবেরি ফলের আবাদ শুরু হয়েছে। আবার আপেলের বিকল্প বড় আকারের কুল, থাই পেঁপে ও পেয়ারা উৎপাদনও বাড়ছে। যার প্রভাব পড়েছে সামগ্রিক উৎপাদনে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য বলছে, দেশে প্রায় ১৩০ রকমের ফল রয়েছে। এর মাঝে প্রচলিত ও অপ্রচলিত প্রায় ৭২টি ফলের চাষাবাদ হয়। সারা বছর ফল প্রকল্পের পরিচালক ড. মেহেদী মাসুদ জনকণ্ঠকে বলেন, ফল উৎপাদন বৃদ্ধির হার অর্থাৎ উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির দিক দিয়ে এবং জমি বৃদ্ধির হার দুভাবেই বাংলাদেশ শীর্ষে। বছরব্যাপী ফল চাষসহ ফল উৎপাদনে কৃষক লাভবান হওয়াতে দেশে ফলের চাষ বাড়ছে। মেহেদী মাসুদ আরও বলেন, এখন মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। ফলে বেশি বেশি ফল কিনে থাকেন। কৃষক অন্যান্য চাষাবাদের চেয়ে ফলে বেশি লাভ পায়। নতুন নতুন জাতের মাধ্যমে ফলন বেশি। যার কারণে আমাদের সাফল্য ভাল। তিনি বলেন, গত বছর যেখানে থাই পেয়ারা ৩ লাখ মেট্টিক টন উৎপাদন ছিল। এবার তা ৫ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে।
×