ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আলোকিত হচ্ছে চর কুকরি মুকরি

দুর্গম চরে আলো ॥ সাবমেরিন ক্যাবলে

প্রকাশিত: ২২:৪৪, ১৭ জানুয়ারি ২০২১

দুর্গম চরে আলো ॥ সাবমেরিন ক্যাবলে

রশিদ মামুন ॥ চর কুকরি মুকরি, ভোলা সদর থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে জেগে উঠেছে এই দ্বীপকন্যা। নির্ভেজাল প্রকৃতিকে আলিঙ্গন করা যায়। দেশে এমন জায়গা কমই আছে। যাতায়াতের ঝক্কি সামলে এখানে অসংখ্য দেশী-বিদেশী পর্যটক ভিড় করেন। স্থলভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন এই চরে কি কোন দিন গ্রিডের বিদ্যুতের আলো পৌঁছাবে! সংশয় ছিল। কিন্তু অসম্ভবই এখন বাস্তবে পরিণত হয়েছে। দ্বীপকন্যায় এখন বিদ্যুতের আলো পৌঁছাচ্ছে। এভাবে চর থেকে দুর্গম চরে সাবমেরিন ক্যাবলে বিদ্যুত পৌঁছে যাচ্ছে। বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলছেন, চরের জীবনে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দেয়াতে রীতিমতো উৎসব শুরু হয়ে গেছে। অনেকদিনের অপেক্ষার অবসান হতে যাচ্ছে। বিদ্যুত বিভাগের কর্মীদের সঙ্গে এসব দুর্গম এলাকার মানুষও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। ভোলা পল্লী বিদ্যুত সমিতির মাধ্যমে অফগ্রিড এলাকার এসব চরের মানুষের জন্য সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুত সংযোগ পেতে যাচ্ছেন ৩৭ হাজারের বেশি গ্রাহক। ভোলা পল্লী বিদ্যুত সমিতি তাদের অফগ্রিড এলাকা ১৬টি চরের মানুষের সঙ্গে নিয়মিত উঠান বৈঠকের মাধ্যমে শতভাগ বিদ্যুতায়নের কাজে স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করেছে। অন্যদিকে বিদ্যুত পাওয়ার দৌড়ে এগিয়ে যাওয়াতে ফরিদপুরের পদ্মার চর অঞ্চলের মানুষের মাঝে রীতিমতো উৎসব শুরু হয়ে গেছে। অনেকদিনের অপেক্ষার অবসান হতে যাচ্ছে। দুর্গম এই চরের ১০ হাজারের বেশি পরিবার এবার বিদ্যুতের আলোয় নিজের ঘর আলোকিত করতে পারবে। দুর্গম পাহাড় থেকে চরাঞ্চল, বিল পেরিয়ে মাঠ পেরিয়ে বর্তমানে গ্রিড এলাকার শতভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে গেছে। এখন কাজ চলছে অফগ্রিড যেসব এলাকা রয়েছে সেখানকার মানুষের কাছে বিদ্যুতের আলো পৌঁছানোর কাজ। ফরিদপুর পল্লী বিদ্যুত সমিতি তাদের অফগ্রিড এলাকা পদ্মার চরে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুতায়নের কাজ শুরু করেছে। মালামাল বড় নৌকা করে যখন চরের ঘাটে ভিড়েছে তখন ছুটে এসেছেন স্থানীয়রা। বিদ্যুত বিভাগের কর্মীদের সঙ্গে স্থানীয় এলাকাবাসীও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিজের ঘরে আলো পৌঁছানোর কাজ করছেন। শুরুটা যেভাবে হয়েছিল ॥ এভাবে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুত পৌঁছানো সম্ভব কি না তা নিয়ে বছর কয়েক আগেও ঢের বিতর্ক ছিল। কিন্তু সব বিতর্ককে পিছনে ফেলে বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সন্দ্বীপে বিদ্যুত পৌঁছে দিতে সাগরের তলদেশ দিয়ে সামমেরিন ক্যাবল নির্মাণ করে। বিগত ২০১৮ সালের ১৫ নবেম্বর দেশের ইতিহাসে প্রথমবার সন্দ্বীপে বিদ্যুত পৌঁছায় সামমেরিন ক্যাবলে। এক দুই কিলোমিটার নয় সীতাকুণ্ড থেকে সন্দ্বীপ পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দেশের প্রথম বিদ্যুত সঞ্চালন সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপন করা হয়। শুরুতেই সাগরকে জয় করাতে নদী পেরনোর চিন্তা গতি পায়। দেশের যেসব বড় নদী রয়েছে তার চরাঞ্চলে বহু দিন থেকেই মানুষের বসতি গড়ে উঠেছে। এসব চরে একে একে সাবমেরিন ক্যাবলে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়। এই ধারাবাহিকতায় শরীয়তপুরে পদ্মার চরে পৌঁছে দেয়া হয় বিদ্যুত। ক্রমেই এই চিন্তাকে আরও প্রসারিত করে নেয়া হয় নতুন নতুন পরিকল্পনা। অফগ্রিড এলাকায় বিদ্যুত পৌঁছানোর বিশদ পরিকল্পনা ॥ অফগ্রিড অঞ্চল বলতে মূলত বোঝায় দুর্গম চর, দ্বীপ ও উপকূলীয় ভূ-সীমানাকে, যেগুলো বছরের বেশির ভাগ সময়ই মূল ভূ-ভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। পল্লী বিদ্যুতের শতভাগ বিদ্যুতায়ন কার্যক্রমে এই অঞ্চলগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করায় বিদ্যুত সুবিধা পেতে যাচ্ছে এই প্রত্যন্ত এলাকার প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার গ্রাহক। ফলে বিদ্যুত পৌঁছে যাচ্ছে বাংলাদেশের একমাত্র অফগ্রিড উপজেলা পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালিতেও। উক্ত এক হাজার ৫৯টি গ্রামে তিনটি ধাপে এ বিদ্যুতায়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। যার মধ্যে ১ম ধাপের ৬৪৬টি গ্রাম তুলনামূলকভাবে কম প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত। ৩৫টি স্থানে কম/বেশি দুই কিলোমিটার পর্যন্ত সাবমেরিন ক্যাবল দ্বারা নদী অতিক্রম করে গ্রামসমূহ গ্রিড লাইনে বিদ্যুতায়ন করা সম্ভব। চলমান প্রকল্পে লাইন ও উপকেন্দ্র নির্মাণের সংস্থান বৃদ্ধি এবং আরইবি অর্থায়নে সাবমেরিন ক্যাবল ক্রয়পূর্বক গ্রামসমূহের লাখ ৫৫ হাজার গ্রাহককে গ্রি লাইনে বিদ্যুত সুবিধার আওতায় আনার কার্যক্রম শেষের পথে রয়েছে। দ্বিতীয় ধাপের ৩৮৪টি গ্রাম দুর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত। ৫০টি স্থানে সাবমেরিন ক্যাবল দ্বারা নদী অতিক্রম করে গ্রামগুলোতে গ্রিড লাইনে বিদ্যুতায়ন করা সম্ভব। এ সকল নদী এবং চরের প্রশস্ততা তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়ায় সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে গ্রামগুলোর ৯০ হাজার গ্রাহককে গ্রিড লাইনে বিদ্যুত সুবিধার আওতায় আনার কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। তৃতীয় ধাপের অন্তর্ভুক্ত অবশিষ্ট ২৯টি গ্রাম অতি প্রত্যন্ত ও দুর্গম এলাকায় অবস্থিত। অধিকাংশ গ্রামেই স্থায়ী জনবসতি নেই। কেবলমাত্র শুষ্ক মৌসুমে বিক্ষিপ্তভাবে মানুষ বসবাস করায় গ্রাহক ঘনত্ব অত্যন্ত কম। ওই ২৯টি গ্রামের প্রায় ৬ হাজার গ্রাহকের জন্য সোলার হোম সিস্টেম স্থাপনের কার্যব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক মুজিববর্ষেই বিদ্যুতায়ন কাজ সম্পন্ন করা হবে। অন্য কোম্পানিগুলোর পরিকল্পনা ॥ শুধু আরইবি নয় আরিইবির পাশাপাশি নর্দান ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) রাজশাহী এবং রংপুরের চরাঞ্চলে বিদ্যুত পৌঁছাতে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। একই ধারাবাহিকতায় কাজ শুরু করেছে ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো)। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুত বিতরণ কোম্পানি নেসকো ১২ হাজার ৬৯০ পরিবারের ঘরে সোলার হোম সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে আলো জ্বেলে দেয়ার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে। নেসকো সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলের (সিএসআর) অর্থ ব্যয় করে প্রতিটি পরিবারকে সোলার হোস সিস্টেম স্থাপন করে দিচ্ছে। প্রতিটি পরিবারের জন্য ২৩ হাজার ২২৫ টাকা করে খরচ করা হচ্ছে। ওজোপাডিকো আরেক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে। মেঘনার মোহনায় জেগে ওঠা মনপুরার সবার বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে তারা সৌর বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করছে। দেশে জীবাশ্ম জ¦ালানিমুক্ত শতভাগ বিদ্যুতায়নের এই পরিকল্পনা এখন কেবল মনপুরাতেই বাস্তবায়িত হচ্ছে। দ্বীপের দুই হাজার ৫০০ গ্রাহককে সোলার মিনিগ্রিডের মাধ্যমে বিদ্যুত বিতরণ করা হচ্ছিল। এর বাইরে সেখানে আরও ৮৫৩ জন গ্রাহক রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সবমিলিয়ে তিন হাজার ৩৫৩ জন গ্রাহক সার্বক্ষণিক বিদ্যুত পাবেন। দিনের বিদ্যুত চাহিদা পূরণের সঙ্গে রাতের জন্য লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারিতে রাতের চাহিদা মেটাতে বিদ্যুত ধরে রাখা হবে। এজন্য তিন মেগাওয়াটের একটি সৌর বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে।
×