ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

৮০ উপজেলায় বিউটি পার্লার গড়ে তোলার উদ্যোগ

প্রকাশিত: ২২:৫৪, ১৬ জানুয়ারি ২০২১

৮০ উপজেলায় বিউটি পার্লার গড়ে তোলার উদ্যোগ

নিখিল মানখিন ॥ করোনা ভাইরাসের ধাক্কা সামাল দিতে পারছে না দেশের বিউটি পার্লার। বন্ধ হয়ে গেছে শত শত পার্লার। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার বিউটিশিয়ান। কঠিন করোনা পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকা পার্লারগুলোও উঠে দাঁড়াতে পারছে না। লাভের মুখ তো দূরের কথা, পার্লারের বাসার ভাড়াই যোগাড় হচ্ছে না। অথচ ৩ লাখের বেশি বিউটি পার্লারে উদ্যোক্তা ও কর্মী আছে ১০ লাখের বেশি। করোনা পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে এই খাতের বিপুল জনগোষ্ঠী কর্মহীন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিউটি পার্লার গড়ে তুলে উদ্যোক্তা তৈরিসহ নারীর জন্য কর্মসংস্থান তৈরির প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। ‘বৈশাখী বিউটি পার্লার’ এর স্বত্বাধিকারী স্বপ্না আজিম। রাজধানীর মহাখালী ওয়্যারলেস গেটের ১৪৭ নং হোল্ডিংয়ে তিনি পার্লারটি গড়ে তুলেছেন। এটি চলছে ১৪ বছর ধরে। করোনা পরিস্থিতির আগে লাভজনক হয়ে উঠেছিল পার্লারটি। করোনার আঘাতে পার্লারটি মুখ থুবড়ে পড়ে। পুরোপুরি বন্ধ ছিল প্রায় ৬ মাস। নবেম্বর থেকে খোলা হলেও উঠে দাঁড়াতে পারছে না এটি। আয় কমে গেছে ৬০ শতাংশ। দোকান ভাড়া ও কর্মচারীদের বেতন দেয়ার পর সংসার চালানোর টাকা থাকে না। সংসার চলছে ঋণ ও ধারদেনার টাকায়। জানি না, এভাবে আর কতদিন টিকতে পারব। করোনার থাবায় বন্ধ হয়ে গেলো ১৩ বছর ধরে চলে আসা ‘গ্রেস বিউটি পার্লার’। ২নং গুলশানের ক৩০/১, দক্ষিণ শাহজাদপুরে গড়ে তোলা হয়েছিল পার্লারটি। আর্থিক সঙ্কটে পড়েছেন পার্লারটির স্বত্বাধিকারী বেবী দিও, তার পরিবার এবং কর্মরত বিউটিশিয়ানরা। বেবী দিও জনকণ্ঠকে জানান, কষ্ট করে টাকা জমিয়ে পার্লারটি গড়ে তুলেছিলাম। তিন বিউটিশিয়ানের বেতন ও দোকানের ভাড়া দেয়ার পরও এর আয় দিয়ে ভালভাবেই চলছি আমার সংসার। লকডাউনের সময় পার্লারটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছি। জমানো টাকায় কয়েক মাস সংগ্রাম করেও পার্লারটি টিকিয়ে রাখতে পারিনি। বর্তমানে বেকার হয়ে অর্থ সঙ্কটে পড়েছি। চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে দুই সন্তানের লেখাপড়া। সব মিলিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছি বলে জানান বেবী দিও। রাজধানীর বংশালে বসবাসরত বিউটি এক্সপার্ট ও ওশেনথ গার্লস বিউটি পার্লারের স্বত্বাধিকারী নাছরিন পারভিন একজন বিধবা নারী। একমাত্র সন্তানকে নিয়ে অনেক কষ্টে পার্লার চালিয়ে সংসার চালান তিনি। এর মধ্যে করোনাভাইরাসের কারণে বিপাকে পড়েছেন নাছরিন পারভিনের মতো অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। তিনি বলেন, আমরা পার্লার মালিকরা ভাল নেই। পার্লারটি বন্ধ ছিল অনেক দিন। কয়েক মাস ধরে পুনরায় খুলেছি, কিন্তু তেমন সাড়া পাচ্ছি না। সামনে কবে পরিস্থিতি ঠিক হয় জানি না। এই স্বত্বাধিকারী আরও বলেন, ঘর ভাড়া, পার্লার ভাড়া, স্টাফের বেতন, বাজার সব মিলিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এমন চললে ডাল-ভাত খাওয়ার উপায় থাকবে না। আমরা ত্রাণ বা এককালীন সাহায্য চাই না। আমাদের যদি এক বছর মেয়াদী ঋণের ব্যবস্থা করে দেন তাহলে আমরা সেই ঋণ দিয়ে এই দুঃসময়ে জীবন পরিচালনা করতাম এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কাজ করে ঋণ পরিশোধ করব। এমতাবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেন তিনি। নাসরিন পারভিন বলেন, আমরা চাই সরকারী খাতে পার্লার জগতের নাম যুক্ত হোক। করোনার কারণে শত শত বিউটিশিয়ান চাকরি হারিয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন নমিতা দিও। সিলেটের শ্রীমঙ্গলে তার বাড়ি। রাজধানীর একটি ভাল বিউটি পার্লারে দশ বছর ধরে কাজ করছিলেন তিনি। করোনাকালে তিনি চাকরি হারান। ছয় মাস বেকার থাকার পর কাজের সন্ধানে তিনি আবার রাজধানীতে পাড়ি জমিয়েছেন। বাংলাদেশে বিউটি পার্লার গড়ে ওঠার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন গারো নারীরা। গারো বিউটিশিয়ানদের দ্বারাই দেশে এই খাতের বিকাশ ঘটে। বর্তমানেও রাজধানীসহ বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের পার্লারগুলো গারো বিউটিশিয়ানদের দখলে। দক্ষ বিউটিশিয়ান হিসেবে তাদের আলাদা কদর রয়েছে। বাংলাদেশ গারো বিউটি পার্লার ওনার্স ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সভাপতি স্বপ্না আজিম জনকণ্ঠকে জানান, করোনাভাইরাসের ধাক্কা সামাল দিতে পারছে না দেশের বিউটি পার্লারসমূহ। বন্ধ হয়ে গেছে শত শত পার্লার। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার বিউটিশিয়ান। কঠিন করোনা পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকা পার্লারগুলোও উঠে দাঁড়াতে পারছে না। এমতাবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করে তিনি বলেন, আমরা চাই সরকারী খাতে পার্লার জগতের নাম যুক্ত হোক। আমরাও দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রেখে আসছি, যা কখনই সবার সামনে আসে না বলে জানান স্বপ্না আজিম। গরো বিউটি পার্লারের মালিক ও বিউটিশিয়ানদের নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছে গারো কমিউনিটি সেন্টার ‘নকমান্দি’। এই সেন্টারের সমন্বয়কারী প্রতাপ রেমা জনকণ্ঠকে জানান, বিউটি পার্লার ব্যবসা শুরু হওয়ার গোড়াতে বিউটি পার্লার ও বিউটিশিয়ান বলতে গারো নারীর কথাই চলে আসত। বর্তমানে অ-আদিবাসী নারীরাও এই পেশায় সম্পৃক্ত হয়েছেন। কয়েক যুগ ধরে বিউটি পার্লারের মালিক ও বিউটিশিয়ানদের নানাভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছে নকমান্দি কর্তৃপক্ষ। করোনার থাবায় বিউটি পার্লারগুলো থমকে গেছে। কর্মহীন হয়ে পড়েছে শত শত বিউটিশিয়ান। রাজধানীসহ সারাদেশে প্রায় সাড়ে চার হাজার গারো বিউটিশয়ান কর্মরত এবং গারো নারীর দ্বারা পরিচালিত বিউটি পার্লারের সংখ্যা হবে দুই শতাধিক। নারী উদ্যোক্তা সম্মেলন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ও বিউটি পার্লার ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক সুমা মণ্ডল বলেন, আমরা খেটেখাওয়া মানুষ, যাদের ট্রেড লাইসেন্স আছে সব সুবিধা শুধু তাদের জন্য অব্যাহত রাখলে সবাই সুবিধা পাবে না। প্রধানমন্ত্রীÑ যারা নতুন উদ্যোক্তা, নতুন পার্লার, যারা এখন ট্রেড লাইসেন্সের সুযোগ করে উঠতে পারেনি তাদের জন্য ব্যবস্থা নিন দয়া করে। ৮০টি উপজেলায় বিউটি পার্লার গড়ে তোলার সরকারী উদ্যোগ ॥ দেশে বিউটি পারলার বা সৌন্দর্যচর্চা সেবাকেন্দ্র জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ফলে রাজধানী ও বিভাগীয় শহর ছাড়িয়ে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও গড়ে উঠছে বিউটি পারলার। সরকারও এই খাতকে বিকশিত করতে চায়। তাই নতুন নারী উদ্যোক্তা তৈরির জন্য দেশের ৮০টি উপজেলায় বিউটি পারলার স্থাপন করে দেবে। জানা গেছে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে ৪৪১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে, যেটি এখন চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায়। এটি বাস্তবায়ন করবে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্পটির আওতায় বিউটি পারলারের পাশাপাশি সুবিধাবঞ্চিত নারীর কর্মসংস্থানের জন্য ৮০টি ফুড কর্নারও করে দেয়া হবে। নির্বাচিত ৮০টি উপজেলায় নারীর জন্য স্থাপন করা হবে বিক্রয় ও প্রদর্শনী কেন্দ্র। যেসব নারী জাতীয় মহিলা সংস্থার মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং ভবিষ্যতে প্রশিক্ষণ নেবেন, তাদেরকেই বিউটি পারলার, ফুড কর্নার ও বিক্রয় কেন্দ্র করে দেয়া হবে। ৫ থেকে ১০ জন মিলে একেকটি বিউটি পারলার পরিচালনা করবেন। একই পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে ফুড কর্নার ও বিক্রয় কেন্দ্র। তাদের এককালীন টাকা দেবে সরকার। একই সঙ্গে বিউটি পারলার সাজাতে যেসব উপকরণ প্রয়োজন হয়, সেসবও সরবরাহ করা হবে। তবে বিউটি পারলার, ফুড কর্নার এবং বিক্রয় ও প্রদর্শনী কেন্দ্র ভাড়া নিতে হবে নারী উদ্যোক্তাদেরই। প্রকল্প তৈরির প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত অতিরিক্ত সচিব আনোয়ারা বেগম বলেন, কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ পুরুষের তুলনায় অনেক কম। তাই আমরা কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ আরও বাড়াতে চাই। একজন নারী যাতে নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন, সে জন্য আমরা তাকে প্রশিক্ষণ দেয়া থেকে শুরু করে সব ধরনের সহযোগিতা করব। ব্যবসা করতে গিয়ে নারী উদ্যোক্তাদের হয়রানিতে পড়তে হয়। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ পেতে সমস্যা হয়। অনেকে পণ্য বিপণনের পদ্ধতি জানেন না। অনেকে আন্তর্জাতিকমানের পণ্য উৎপাদনের পদ্ধতিও জানেন না। প্রশিক্ষণে এসব বিষয় শেখানো হবে। জাতীয় মহিলা সংস্থার তথ্য বলছে, এই প্রকল্পের আওতায় সারাদেশ থেকে ২ লাখ ৫৬ হাজার নারী বাছাই করে তাদের ছয় মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। প্রতিদিন একজন নারী প্রশিক্ষণার্থীকে দেড় শ’ টাকা করে দেয়া হবে। কারা দক্ষতা উন্নয়নের প্রশিক্ষণ পাবেন, তার মানদণ্ড ঠিক করে দেয়া হয়েছে। অষ্টম শ্রেণীর কম পড়ালেখা এমন কেউ এই প্রশিক্ষণ পাবেন না। এসএসসি ও এইচএসসি পাস অনেক নারী এই সংস্থা থেকে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।
×