ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যাংক ঋণে নতুন আতঙ্ক ‘সার্ভিস চার্জ’

প্রকাশিত: ২২:৪১, ১৬ জানুয়ারি ২০২১

ব্যাংক ঋণে নতুন আতঙ্ক ‘সার্ভিস চার্জ’

রহিম শেখ ॥ ব্যাংকিং খাতে লুকায়িত অরাজকতার নাম বিভিন্ন পর্যায়ের সার্ভিস চার্জ। বাংলাদেশ ব্যাংক পরিমাণ নির্ধারণ না করায় ইচ্ছেমতো সার্ভিস চার্জ আদায় করছে ব্যাংকগুলো। ব্যাংক থেকে আরোপিত সুদের পাশাপাশি গ্রাহককে গুনতে হচ্ছে কমপক্ষে ৪৫ ধরনের ‘সিডিউল অব চার্জ’। এর মধ্যে শুধু আমদানি-রফতানিতেই কাটা হচ্ছে ২৯ ধরনের চার্জ বা কমিশন। এছাড়া ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে ১২-১৫ ধরনের মাসুল দিচ্ছেন সাধারণ গ্রাহক। ঋণ নিষ্পত্তিতেও চার্জ গুনতে হচ্ছে। এর বাইরে রয়েছে আরও অনেক হিডেন চার্জ, যা গ্রাহক কোন দিন জানতেও পারেন না। এছাড়া ক্রেডিট কার্ডের সার্ভিস চার্জ তো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এতে প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন গ্রাহক। গ্রাহক স্বার্থে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চার্জ নির্ধারণ ও ব্যাংকের প্রতিটি শাখায় সব ধরনের কমিশনের তালিকা টানানোর পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। জানা গেছে, গত বছরের ১ এপ্রিল থেকে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ধরনের ঋণের সুদ ৯ শতাংশ বাস্তবায়ন করতে ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য বিভিন্ন নীতি সহায়তাও দিয়ে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপরেও প্রকৃতপক্ষে ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামছে না। জানতে চাইলে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহিম বলেন, বর্তমানে ঋণের সুদ কাগজ-কলমে ৯ শতাংশ। কিন্তু বাস্তবে ১২-১৮ শতাংশ পড়ছে (প্রণোদনা ঋণ এ হিসাবের বাইরে)। কারণ এখন সার্ভিস চার্জ ডাবল করে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। তিনি বলেন, প্রতি এলসিতে আগে ২০ পয়সা কমিশন কাটলে এখন কাটে ৪০ পয়সা। আর আগে ৪০ পয়সা কাটলে এখন ৮০ পয়সা কাটছে। এতে আমাদের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। সে হিসাবে কোন কোন ক্ষেত্রে ঋণের সুদ আগের চেয়ে বেড়ে যাচ্ছে। জানতে চাইলে একটি বেসরকারী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, গত এপ্রিল থেকে ব্যাংক ঋণের সুদহার এক অঙ্ক কার্যকর করা হয়েছে। বৈশ্বিক নিয়ম হচ্ছে সুদহার কমলে সার্ভিস চার্জ বাড়ে। ব্যাংক পরিচালনায় নানা ধরনের খরচ রয়েছে। আইটি, অনলাইন, কমপ্লায়েন্স, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ, গ্রাহক সেবার মান বাড়ানো ইত্যাদিতে অনেক খরচ করতে হয়। এসব করতে হলে অবশ্যই চার্জ থাকতে হবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৈদেশিক বাণিজ্য (আমদানি) লেনদেনের ওপর ১৫ ধরনের কমিশন বা চার্জ আদায় করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে- এলসি ওপেনিং কমিশন। এখানে আবার অনেক প্রকার-শতভাগ এফডিআর (স্থায়ী আমানত) রেখে সাইট এলসি খোলার জন্য দিতে হয় শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ কমিশন। ব্যাক-টু-ব্যাক, এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইডিএফ) এবং বিভিন্ন অনুদান তহবিল থেকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রেও একই কমিশন দিতে হয় গ্রাহককে। তবে ডেফার্ড (বকেয়া) এলসির জন্য এ কমিশন আরও বেশি (শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ)। এলসির সময় এবং পরিমাণ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গ্রাহককে গুনতে হয় অতিরিক্ত কমিশন। বিদেশী এলসি হলে প্রতিবারে ৭৫০ টাকা এবং লোকাল হলে দিতে হয় ৩০০ টাকা। এ্যাড কনফার্মেশন চার্জ শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ। এছাড়া সুইফট চার্জ অব এলসি ট্রানজেকশনের মধ্যে রয়েছে- প্রি-এ্যাডভাইস বিদেশী এলসির জন্য কমপক্ষে এক হাজার এবং লোকাল এলসিতে ৫০০ টাকা কমিশন দিতে হয়। এসব ঋণ পরিচালনার জন্য আবার আলাদাভাবে কমিশন দিতে হয় গ্রাহককে। লোকাল এলসির জন্য যার সর্বনিম্ন অঙ্ক এক হাজার টাকা, সার্কভুক্ত দেশগুলোর জন্য কমপক্ষে দুই হাজার টাকা এবং সার্কভুক্ত দেশের বাইরের দেশগুলোর জন্য কমপক্ষে তিন হাজার টাকা। এলসি এ্যাডভাইসিং ফি ৭৫০ টাকা। একসেপ্টেন্স কমিশন শূন্য দশমিক ১০ থেকে শুরু করে শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ পর্যন্ত নেয়া হয়। লোকাল এলসিতে ডিসক্রিপ্যান্সি (অমিল) চার্জ ২৫ মার্কিন ডলার এবং বিদেশী এলসির জন্য ৮০ মার্কিন ডলার। লোকাল এলসির পেমেন্ট চার্জ বিলপ্রতি ৩০০ টাকা এবং বিদেশী এলসির জন্য ২০ মার্কিন ডলার। অরিজিনাল ডকুমেন্টের অনুপস্থিতিতে জাহাজীকৃত পণ্য খালাসের জন্য প্রতি ডকুমেন্টে এক হাজার টাকা। নো অবজেকশন সার্টিফিকেটের (এনওসি) জন্য ৫০০ টাকা। স্টেশনারি খরচ ৩০০ টাকা, আইআরসি নবায়নের সার্ভিস চার্জ ৫০০ টাকা। একই চিত্র রফতানি বাণিজ্যেও। এখানে ১৪ ধরনের চার্জ বা কমিশন কাটা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- রফতানি বাণিজ্যে ৭৫০ টাকায় এলসি এ্যাডভাইজিং কমিশন। এলসি ট্রান্সফার বা স্থানান্তরের জন্য ৭৫০ টাকা। রফতানির জন্য ব্যাংকের গ্যারান্টি এ্যাড কনফার্মেশন কমিশন শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ। পণ্য রফতানির জন্য দু’পক্ষের চুক্তি বা নেগোসিয়েশন হিসেবে শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ কমিশন দিতে হয়। রফতানি চুক্তির ভিত্তিতে এক্সপোর্ট বিল কালেকশনের জন্য গুনতে হয় আরও শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ। ডকুমেন্ট কুরিয়ার করে পাঠানোর জন্য এশিয়ার মধ্যবর্তী দেশগুলোতে ২ হাজার ৫০০ টাকা এবং এশিয়ার বাইরের দেশগুলোর জন্য ডকুমেন্ট প্রতি ৩ হাজার টাকা গুনতে হয় রফতানিকারককে। তবে নিবন্ধিত এয়ার মেইলের মাধ্যমে পাঠালে এ খরচ হয় ডকুমেন্ট প্রতি কমপক্ষে ৫০০ টাকা। বিল প্রতি বায়িং হাউস কমিশন ১ হাজার টাকা। ইএক্সপি ফরমের জন্য স্টেশনারি খরচ ১০০ টাকা। সিএ্যান্ডএফ, এফসিআর, মানি এক্সচেঞ্জ এবং বায়িং হাউসের জন্য প্রসেসিং ফি প্রথমবারের জন্য ৫ হাজার এবং নবায়নের জন্য ৩ হাজার টাকা। এফসি এ্যাকাউন্ট মেইনটেইনের জন্য প্রতি বছর দুই মার্কিন ডলার এবং পিআরসি ইস্যুর জন্য প্রতিবারই ৫০০ টাকা গুনতে হয় রফতানিকারককে। এর বাইরে সবচেয়ে বেশি সুদ নেয়া হয় ক্রেডিট কার্ড ঋণে। এক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ১৪ থেকে সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ সুদ নেয় ব্যাংকগুলো। এসব সুদহার আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ফি ও চার্জ। ঋণ পেতে হলে ব্যাংক প্রসেসিং ফি দেয়া লাগে। ব্যাংকভেদে এ হার ১ থেকে ২ শতাংশ। ঋণ নিতে গেলে অবশ্যই মর্টগেজ রাখতে হয়। মর্টগেজ তৈরির ফি ২ শতাংশের কম নয়। ১ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত মর্টগেজ প্রস্তুত করতে ২ হাজার টাকা ফি লাগে। ২০ লাখ টাকা থেকে ১ কোটি টাকার মর্টগেজ প্রস্তুতিতে ফি লাগে ৫ হাজার টাকা। এরচেয়ে বেশি অঙ্কের মর্টগেজ করতে ৫ হাজার এবং প্রতি লাখে ২ শতাংশ হারে ফি দিতে হয়। এর বাইরে রয়েছে সরকারী বিভিন্ন স্টাম্পের নির্ধারিত মূল্য। ঋণ নিতে হলে গ্রাহককে অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সিআইবি ক্লিয়ারেন্স নিতে হয়। এজন্য নির্ধারিত ফি ২০০ টাকা। ঋণের জন্য ব্যাংকে সুনির্দিষ্ট কিছু কাগজপত্র জমা রাখতে হয়। এজন্য ব্যাংকে ১ থেকে দেড় হাজার টাকা ফি দেয়া লাগে। কোন কোন ব্যাংক এজেন্ট কমিশনও আদায় করে ২ থেকে ৩ শতাংশ। ব্যাংকের জামানতের নিরাপত্তার জন্য দিতে হয় ১ থেকে ২ শতাংশ কমিশন। ঋণের অঙ্ক যত বেশি, কমিশনের অঙ্কও তত বেশি। অবশিষ্ট অংশের ওপর ২ শতাংশ হারে সুদ পরিশোধ করতে হয়। একজন গ্রাহককে যদি ৫০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করে ব্যাংক এবং ওই গ্রাহক ২০ কোটি টাকা নিয়ে বাকিটা পরবর্তী সময়ে নিতে চাইলে সে ৩০ কোটি টাকার ওপর ১ থেকে ২ শতাংশ হারে সুদ আদায় করে ব্যাংক। কোন গ্রাহক যদি নির্দিষ্ট মেয়াদের আগেই তার ঋণ পরিশোধ করতে চান তাহলে তাকে মোট ঋণের ওপর ২ শতাংশ হারে চার্জ (আরলি সেটেলমেন্ট ফি) পরিশোধ করতে হয়। এছাড়া নন-ফান্ডেড ঋণের ক্ষেত্রে রয়েছে সুনির্দিষ্ট কিছু চার্জ। এর বাইরে ঋণ নিতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে হিসাব খুলতে হয়। সে ব্যাংক হিসাবের যাবতীয় চার্জসহ ঋণের সুদহার ডাবল ডিজিটে চলে যায়। এছাড়া আরও আছে ডকুমেন্টেশন ফি, লিগ্যাল ফি, ঋণ পুনর্গঠন ফি, কিস্তি পরিশোধের তারিখ পরিবর্তন ফি, নিজস্ব অভিভাবক পরিবর্তনজনিত ফি, কোটেশন পরিবর্তন ফি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- হিসাব পরিচালন ফি ৬০০ টাকা (প্রতি ষান্মাসিকে ৩০০) ও এটিএমের ডেবিট কার্ড ফি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। কেউ যদি হিসাবের জমার পরিমাণ জানতে চান বা কোথাও ব্যাংক সংক্রান্ত কাগজ জমা দিতে হয় তাহলে স্টেটমেন্ট প্রতি ২০০ থেকে ৫০০ টাকা চার্জ দিতে হয়। বর্তমানে সব ব্যাংকই অনলাইন ব্যাংকিং সেবা চালু করেছে। অনলাইন লেনদেন করলে ৫০ থেকে ৫ হাজার টাকা, ডেবিট কার্ড শুরুতে চার্জ ৪৬০ টাকা এবং বার্ষিক চার্জ ৫০০ টাকা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ জনকণ্ঠকে জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক আগে যেমন সার্ভিস চার্জের একটা তালিকা করে দিত, এখন করছে না। এখন ব্যাংকগুলো কি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু সংরক্ষণ করছে। এতে গ্রাহকদের ওপর অনেক বেশি চাপ পড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত বিভিন্ন ক্ষেত্রের সার্ভিস চার্জের সীমা নির্ধারণ করে দেয়া।
×