ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

স্মৃতির শহর ॥ রেক্স, ফ্রাইড কাবাব- ক্লান্ত আলোয় ম্লান ছায়া

প্রকাশিত: ২১:৩৬, ১৫ জানুয়ারি ২০২১

স্মৃতির শহর ॥ রেক্স, ফ্রাইড কাবাব- ক্লান্ত আলোয় ম্লান ছায়া

নবাবপুর রেলগেট। আদি ঢাকা আর হালের ঢাকার অলিখিত বিভাজন রেখা। ফুলবাড়িয়া ঢাকার রেলস্টেশন, মিটার গেজ ট্রেনলাইন পুবে চলে গেছে নারায়ণগঞ্জ ঘাট স্টেশনের দিকে আর পশ্চিমে কিছুটা গিয়ে ডানে বেঁকে উটের মতো উবু হাতির পুলের ঢাউস ব্রিজের নিচ দিয়ে তেজগাঁ হয়ে চট্টল, সিলেট বা ময়মনসিংহে। কমলাপুর হয়নি। নবাবপুর থেকে এসে গেট ক্রস করতেই হাতের ডানে নবাববাড়ির বিশাল গেট, বাগান যা হয়ে গেছিল গবর্নর হাউসের প্রবেশদ্বার দেশ ভাগের পটভূমিতে। বঙ্গভবনেরও মূল প্রবেশদ্বার এটিই ছিল। এখন বাগান নেই। অপরিকল্পিত স্থাপনা, আগাছা, জঙ্গল। বঙ্গভবনের গেট এখন দূরে, পুবে। দিল্কুশ্ আম বাগান নেই। বামে প্রেক্ষাগৃহ গুলিস্তান, সিঁড়ি দিয়ে উঠলে ছোট্ট কিউট হল, নাজ সিনেমা হল, মূলত: হলিউডি ইংরেজী ছবির অপূর্ব প্রক্ষেপণ হতো পর্দায়। একতলায় সুইটহ্যাভেন, আজব স্ন্যাক্সের রেস্তরাঁ, তৎকালীন সিনেমা পথিকৃতদের আড্ডাস্থল, মনে হয় দোসানীর করা। দক্ষিণের দোতলায় সম্ভবত ঢাকার প্রথম চাইনিজ রেস্তরাঁ চৌচিনচো, বিদেশী সোমরস-ও মিলত! উত্তরে এগোই। ডান দিকে বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের কণ্ঠস্বর পল্টন ময়দান, অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের জলদকণ্ঠ, মজলুম জনতার নেতা ভাসানীর হুংকার। ‘কাঁদো বাংলার মানুষ’ লাখো জনতার সামনে শিমুল বিল্লাহ্র সেইগান। ছিল ওয়ান্ডারার্স মোহামেডান, ওয়ারির ক্লাবঘর, স্টেডিয়াম। অকস্মিক এভিনিউয়ের রাস্তা বাঁয়ে ঘুরিয়ে দিয়ে বায়তুল মোকাররমের সগর্ব সরগরম অবস্থান! ২. রেলগেট থেকে এগিয়ে গুলিস্তান পার হলেই বামে প্রথমেই সিংগার, ভাম ফার্মেসি এবং তারপরই পৌঁছে যাব কাক্সিক্ষত কাবাব-পরোটা-মোগলাইয়ের সুগন্ধে ‘মোমো-ময়’ রেক্স, সন্ধ্যাটা কবি-উবিদের মিলনস্থল। আড্ডা শব্দটির প্রচলন ছিল না বললেই চলে, পাতে ওঠেনি। দীর্ঘাকৃতি শাহী বেশে হুকুমত শাহ, শের শাহ-র চুনার থেকে আসা, আদবের সঙ্গে বিনয় আর মমত্ব মিক্স করে রেক্সি কায়দায় জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেই বলতাম- হুকুমত একটু পরে, সবাই আসুক। জাবাব তমিজের সঙ্গে হুকুম জনাব। আমরা কখনও হুকুম করেছি বলে মনে করতে পারছি না। দক্ষিণের টেবিলে কলরবকারী ‘ছাগ’ মানে কতিপয় আমরা, আমাদের দখলে। আর উত্তরের টেবিলে? উত্তরে বিরাজ করতেন, ওরে বাপ্স! কাদের কথা বলব? ‘লিজেন্ড’ শব্দটির অপব্যবহার তখন শুরু হয়নি, শুরু হয়নি ‘মুরব্বি’ কিংবা কলকাতা থেকে আমদানি করা ‘গুরু’ শব্িেদ্টর ব্যবহার আর শুরু হয়নি ভুয়া দূরত্বের বিভাজন। সম্বোধন ছিল- ভাই। সহজ, অকপট। সম্মান দেয়াটা ভেতরের, বাইরের নয়। সন্ধ্যা গাঢ় হলেই আসতেন সবার বুড়োভাই, আসল নাম মুশাররফ রসুল, পুরান ঢাকার শায়েস্তা খানের আমলের নিঃসঙ্গ খসেপড়া লাল ইটের দালান থেকে। থাকতেন একা, কিন্তু তিনি নিঃসঙ্গ মানুষ ছিলেন না। বই-পুস্তকের পাহাড় তাঁর চির সঙ্গী, লেখালেখি করতেন না, লেখকদের অণুঘটক ছিলেন, মন-মানসে প্রেরণা দিতেন নবপ্রজন্মকে! এমনকি বিশ্ব-চলচ্চিত্র ভাণ্ডারের দ্বারও আমাদের সামনে উন্মোচন করতেন সহজ সরল বর্ণনে। তাঁদের টেবিলে তুমুল তর্ক লাগলে প্রয়োজনে থামাতেন, প্রত্যয়ী কথনে। সবাই শুনতেন, যেন ফুটবলের রেফারী, লাল কার্ড, হলুদ কার্ড। আর আজ হলে বলতাম ক্রিকেটের আম্পায়ার। হাউজদ্যাট? আউট, নট আউট। ৩. একদিন কবি শামসুর রাহমান ভাই শহীদ কাদরীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন- আমার বন্দী শিবির থেকে পড়া হয়েছে? কাদরী তাঁর স্বভাবসুলভ দুষ্টুমিতে বললেন- আমি তো টয়লেটে কবিতা পড়ি, ক’দিন যাওয়া হচ্ছে না। রাহমান ভাই গোস্যা না করে পাল্টা বললেন- উঁ! ঠিক আছে, আমার পানীয় রসদ-ও শেষ। অনেক দিন ধরা হবে না না! মনে রাখতে হবে! নির্ভেজাল রস-বাক্যের ঠোকাঠুকি, অন্তরঙ্গ খেলায় ক্যারামের গুটি! ঠকাস, ঠকাস! শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, রফিক আজাদ —— ‘কত নাম কোনটা কুড়াই বল। কোন মুখটার কথা ভেবে দু’দণ্ড কাঁদি বল?’ বন্ধুর কবিতা। ৪. তবে করোনার কান্নার মাঝে আজ আর কান্নার কথা নয় মেমরিচিপ্স থেকে মাজার কিছু কথা, আমাদের দক্ষিণের টেবিল নিয়ে। যুদ্ধ শেষ, সদ্যপ্রাপ্ত স্বাধীনতার স্বাদ পেতে শুরু করেছি, জনক মুজিব মুক্তির অপেক্ষায়। পুব আর পশ্চিমের অবারিত দ্বার, গগন ললাট চুমে তব পদধূলি। ডিসেম্বর ১৬তে এপার বাংলা আর ওপার বাংলার পানি আর জলের অনেকেই যুদ্ধ না করেই মুক্তিযোদ্ধা সেজে গেছিল, অবলীলায়। আমরা তাদের খেতাব দিয়েছিলাম ‘সিক্সটিন্থ ডিভিশন’! সদ্য কলকাতা থেকে ফেরা তরুণ নব্য কবি, আমাদের সংস্কৃতির বলয়ের সদাহাস্যময় ফুরফুরে বিপ্লব দাশ (দাস নয়) সঙ্গে করে নিয়ে এল কলকাতা থেকে আগত ‘রণাঙ্গন- ফেরত’ কথিত কতিপয় ‘মুক্তিযোদ্ধাকে’। ওরা প্রগতিশীল, তাই মাংসে আপত্তি নেই। বড়টাতেও। (পরিবারের একজন আজকের প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী, প্রশিক্ষক দীপা। আমাদের ঢাকা থিয়েটারেরও বটে।) আগত বন্ধুদের কথা ছুটছে, নিরীহ, নিরাপদ তুব্রির মতো বললে ভুল হবে, ছুটছে মেশিন গানের মতো। কত গান- স্টেনগান, মেশিনগান, ব্রেনগান, আর্টিলারি গান, এন্টি এয়ারক্র্যাফট গান, দম না নিয়ে এক নিঃশ্বাসে বয়ান, যেন ৭৮ আরপিএম ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েসের’ কাটা রেকর্ড। বেজেই চলেছে, নন-স্টপ। যুদ্ধে সহায়ক বন্ধু ওরা, ওদের উৎসাহে কে বাধা দেয়। কাবাব পরোটার সঙ্গে ভালই যাচ্ছে, বইকি! কিন্তু ঠোঁটকাটা কবি, আমাদের ঘড়ির কাঁটার ২৪ ঘণ্টার বন্ধু, আবুল হাসানের মুচকি হাসির মুখ থেকে ত্বরিত ফস্কে এল- আর ‘বাঙ্কার’ বাঙ্কার মারেননি? এতক্ষণ সে টেবিলে ছেড়া কাগজে আনমনে আঁকিবুকি করছিল, তার এই আঁকিবুকি থেকে অনেক কালজয়ী কবিতা উদ্ধার করেছি আমরা, প্রায়শই! তার চোখ চিলের আর কান খরগোশের। কলমে বাংলার বহতা নদী। হৃদয়ে মধুমতি। র‌্যাডক্লিফ বাঁদরের উন্মত্ত ৪৭-এ বন্ধকরা সীমান্ত পারি দেয়া উন্মুক্ত অদৃশ্য দেয়াল টপকে আসা বন্ধু মুহূর্তেই প্রশ্ন লুফে নিল, উইকেটের পেছনের দক্ষ কিপারের ক্যাচ ধরার মতো। উল্লাসে বলে উঠলো- হাউ-ইজ- দ্যাট! হাউজদ্যাট! হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক বলেছেন, প্রথমে পাইনি, কিন্তু শেষদিকে পেয়েছি বলে বলতে মনে ছিল না। যখন পেয়েছি তখন বাঙ্কার ছুড়েও মেরেছি পাকিস্তানী হানাদার জল্লাদদের দিকে। গ্রেনেড থেকেও শক্তিশালী, বাঙ্কার, বুঝেছেন দাদা!!! হাসান ঈশানের বিদ্যুতের মতো এক ঝলক হাসি দিয়ে বলল- বুঝছি! একগাল হেসে আবার বলল- আর দাদা, রেকি? রেকি ছুড়ে মারেননি? (রিকোনাইসেন্স থেকে রেকি, গেরিলা যুদ্ধে বহুল উচ্চারিত সংক্ষিপ্ত শব্দ রেকি। সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহ, গেরিলা যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ) এবার একটু থমকে গেলেন দাদা কিন্তু চট-জলদি সপ্রতিভ জবাব এলো- না,দাদা, রেকি যখন হাতে পেলাম, যুদ্ধ শেষ। খানসেনারা আত্মসমর্পণ করে ফেলেছে। বলেই কাবাব-পরোটার রোলে একটি তৃপ্তির মরণকামড় দিলেন। ৫. উত্তরের উৎকর্ণ টেবিল থেকে হাসি উপচে কিছুটা আমাদের কানেও এলো বটে। হাসান তার খেরো কাগজে লিখল, ঘোড়ার মাথা! আমাকে আড়ালে দেখাল। হাসানের কোন কিছু অপছন্দ হলে বলত ঘোড়ার মাথা। গল্প বলি, ঘোড়ার মাথার। লন্ডন থেকে আমাদের ‘কাক’ সংকলনের জন্য তড়িঘড়ি করে পাঠানো সৈয়দ হক ভাইয়ের কবিতা পাঠ করে পছন্দ হয়নি হাসানের। ঢাকায় আসতেই হক ভাইকে বলে বসল, কি ঘোড়ার মাথা কবিতা দিছেন? হক ভাই স্নেহের আধিক্যে বলে উঠেছিলেন- থাম, থাম, হাসান, দিচ্ছি দিচ্ছি——ওটা তোর দাপটে তড়িঘড়ি লেখা। তারপর দিলেন যার শেষ দুটি ছত্র- ‘কপালে তৃতীয় চোখ, হাতে রক্ত হেনা, বুঝি এই বাংলাদেশ মরেও মরে না। ‘কালজয়ী’। ৬. এত কিছু থাকতে ঘোড়ার মাথা কেন? ঘোড়াড্ডিম শুনেছি। রেক্সে একদিন বৃষ্টিমুখর নির্জন সন্ধ্যায় হাসানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। উত্তর সহজ, যুক্তি সরল- হা হা বুঝলেন না! ঘোড়া চিরকাল গাধার চেয়েও অধম। মাথাটা শূন্য। শত-সহস্র বছর যুদ্ধে রক্ত দিয়েও, সাম্রাজ্য-সীমা বৃদ্ধি করেও গাধা বনে রইল, যুদ্ধ শেষে বৃদ্ধ হলে নির্মম মৃত্যুদণ্ড। বঝলেন? বুঝি না আজও। কবিদের সব কথা বুঝতে নেই। রেক্সের শিক্ষা! ৭. বিপ্লব প্রবল উৎসাহে আরেক দফা ফ্রাইড কাবাব-পরোটা অর্ডার করে বসল- হুকুমত,’ কুছপরোটা’নেহি, কাবাব-পরোটা আওর এক দফা’! মাথা নুইয়ে শেরশাহ বংশের হুকমত কিচেনের দিকে ধাবিত হলো। আসর জমেছে বইকি! মন্দ কি? যুদ্ধক্লান্ত মুক্তাঙ্গনে একটু হাসি, একটু মজা! মুক্তির সংগ্রাম তো শেষ হয়নি, তখনও! ৮. কাদরী ভাই চলে যাবেন, আমি আর হাসান একটি দিন, একটি রাত কাটালাম রেক্স আর পুরান ঢাকার পঞ্চুর পাটিতে। যে যাবার, যায়, যাচ্ছে। যেমন চলে গেল একটি বছর! ‘সূর্যের উত্তরায়ন, দক্ষিণায়ন, কেটে গেছে পাঁচটি দশক। অয়নান্তে যন্ত্রণার মুখোশ বদল। ‘বন্ধুর ভঙ্গুর কাঁচ ভাঙ্গা কবিতা। আর ঠাকুরের গান কাটা রেকর্ডে নয়, যতি চিহ্নহীন অসীম ডিজিটাল সায়রে- ধূসর জীবনের গোধূলিতে ক্লান্ত আলোয় ম্লান ছায়া—-। রেক্সের ছায়া মিলায় না ——- * কবি শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, বুড়োভাই, বিপ্লব, আবুল হাসান কেউ নেই, ছায়া আছে প্রবল!
×