ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

যোগ্য-অযোগ্যের সংজ্ঞা কী?

প্রকাশিত: ২০:৪৬, ১৪ জানুয়ারি ২০২১

যোগ্য-অযোগ্যের সংজ্ঞা কী?

ঢাকা দক্ষিণের সাবেক এবং বর্তমান মেয়রের বচসায় মুখরোচক আলোচনা চলছে সর্বত্র। ৯ জানুয়ারি রাজধানীতে এক মানববন্ধনে শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন বলে দাবি করেছেন সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। লিখিত বক্তব্যে সাঈদ খোকন বলেন, দক্ষিণ সিটির বর্তমান মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস তার পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন। পরদিন ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে শেখ ফজলে নূর তাপস সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, এগুলো তার কাছে কোন গুরুত্ব বহন করে না। ‘ব্যক্তিগত আক্রোশের’ কোন বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেয়া সমীচীন নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন। একটু পেছন ফিরে দেখা যাক-গত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ঠিক আগের কিছু ঘটনাপ্রবাহ। উন্নত বিশ্বের মতো উন্নয়নশীল আমাদের এই বাংলাদেশে ক্ষমতার হাত বদল কখনও কোন দল বা কোনো ব্যক্তির জন্য সুখকর কিছু বয়ে আনেনি। অন্যভাবে বললে, কেউ হাসিমুখে ক্ষমতা ছাড়েননি বা হস্তান্তর করেননি। যার সর্বশেষ নজির আমরা দেখি ঢাকা সিটি কর্পোরেশন দক্ষিণের প্রার্থী পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। যে পরিবর্তনকে স্বাগত জানানোর পরিবর্তে কেঁদেছেন সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন। তাকে পরিবর্তন করে শেখ ফজলে নূর তাপসকে মেয়র পদে নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। বিষয়টি হয়ত আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিলেন সাঈদ খোকন। তাই ক্ষমতায় শেষ দিকে তার সময়ে সংস্কার কাজ করা লালবাগের শহীদ আব্দুল আলীম খেলার মাঠ আর বাসাবোতে শহীদ আলাউদ্দিন পার্কের উদ্বোধন করতে গিয়ে বার বার মেয়র নির্বাচনের কথা উপস্থিত সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছেন। দক্ষিণের উন্নয়নে কি কি কাজ করেছেন, তা উল্লেখ করেছেন। ভুল-ত্রুটির জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। নগরবাসীকে তার পাশে থাকার জন্য অনুরোধ জানিয়ে বলেছেন, আবার মেয়র নির্বাচিত হলে তার অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করবেন। মেয়র থাকাকালীন সর্বশেষ রাজধানীর বকশিবাজারে কারা কনভেনশন সেন্টারে ঢাকা সমিতির বার্ষিক সাধারণ সভায় ডিএসসিসির বাসিন্দাদের আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমি ফেরেশতা না মানুষ, ভুল-ত্রুটি হতেই পারে। আমার ছোটখাটো ভুল-ত্রুটি হয়ে থাকলে আপনাদের সন্তান, আপনজন হিসেবে ধরিয়ে দেবেন। এ ভুলগুলো সংশোধন করার জন্য আরেকবার যদি সুয়োগ পাই, তাহলে আমার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আগামী পাঁচ বছর আপনাদের সুখে-দুঃখে পাশে থেকে সেবা করব। অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করে নতুন রূপে আপনাদের কাছে এ ঢাকাকে ফিরিয়ে দেব। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সাঈদ খোকন সেই সুযোগটি আর পাননি। তাই হয়ত মনোনয়ন ফরম তুলতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে বলেছেন, তার রাজনৈতিক জীবনের কঠিন সময় যাচ্ছে এখন। বলেছেন, তার পিতা অবিভক্ত ঢাকার সাবেক মেয়র প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফের হাত ধরে রাজনীতিতে এসেছেন তিনি। পিতার অবর্তমানে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীই তার অভিভাবক এবং সভানেত্রী তার জন্য যেটা ভাল মনে হবে সেই সিদ্ধান্তই নেবেন। বলা হয়ে থাকে, পুরান ঢাকার অন্যতম ব্যক্তিত্ব মাজেদ সর্দারের নাতি এবং বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ হানিফের ছেলে হিসেবেই সাঈদ খোকনকে দল থেকে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র পদে প্রার্থী করা হয়। রাজধানীবাসীর সেবার মান বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে দুই ভাগে (উত্তর-দক্ষিণ) ভাগ করা হয়। এর প্রায় চার বছর পর দুই সিটিতে নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত দুই মেয়র প্রার্থী আনিসুল হক ও সাঈদ খোকন বিজয়ী হয়ে দায়িত্ব নেন। মেয়াদের একেবারে শেষভাগে এসে নিজের অর্জনের ফিরিস্তি তুলে ধরতে গিয়ে সাঈদ খোকন রাস্তায় সড়কবাতি লাগানো, শান্তিনগর, নাজমুদ্দীন রোড, বংশাল, পুরান ঢাকার জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধানের কথা উল্লেখ করার পাশাপাশি পার্ক ও খেলার মাঠ দখলমুক্ত করা, সেগুলোকে আন্তর্জাতিক মানের করার কথা, পাবলিক টয়লেট স্থাপন, শহরের ময়লা পরিষ্কার করার কথা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তৃতার ফাঁকে ফাঁকে উল্লেখ করেছেন। কাজ করলে তার ফিরিস্তি তিনি দিতেই পারেন। কিন্তু উন্নয়ন বা সেবামূলক কাজ করার ক্ষেত্রে বরাবরই তার বিরুদ্ধে কমিশন নেয়ার কথা অনেক আগেই চাউর হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া অনেক কাজই তিনি পরিপূর্ণভাবে শেষ করতে পারেননি। হঠাৎ সিদ্ধান্তে অগোছালোভাবেই যেন কাজ শুরু করতেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে- ঢাকা দক্ষিণে যে ৩১টি মাঠ ও পার্কের সংস্কার কাজ তিনি ২০১৬ সালের শুরু করেছিলেন, তার মধ্যে মাত্র দুটি তিনি উদ্বোধন করতে পেরেছেন। তাও নামেমাত্র। কারণ তড়িঘড়ি করে উদ্বোধন করা ওই পার্ক এবং মাঠের অনেক কাজই এখনো বাকি। অভিযোগ আছে- কোনো কোনো প্রজেক্ট থেকে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কাজের প্রায় পুরো টাকাটাই তুলে নিয়েছে। আবার কোনো কোনোটা কাজের টাকা না পাওয়ার আশঙ্কায় ঢিমেতালে চলেছে। তার সময়ে বায়ুদূষণে প্রায় দিনই দিল্লীকে ছাড়িয়ে গেছে ঢাকা (এখনো যাচ্ছে)। অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে নগরীর রাস্তা খোড়াখুড়ি বায়ুদূষণের মাত্রা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী বলার পরও ধুলাবালি কমাতে নগরীতে জলসিঞ্চনের ব্যবস্থা করতে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। ২০১৯ সালে যে ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ আকার নিয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ওই বছর ২১ নবেম্বর পর্যন্ত সরকারী হিসেবেই দেশে ডেঙ্গুজ্বরে মৃতের সংখ্যা ১২১ জনে দাঁড়ালেও সাঈদ খোকন বিষয়টিকে ‘গুজব’ বলে প্রথম দিকে দাবি করেন। রাজধানীতে ডেঙ্গু আক্রান্ত নিয়ে ছেলেধরার মতো গুজব ছড়ানো হচ্ছে বলেও ওই সময় মন্তব্য করেন সাবেক মেয়র। এ সময় ডেঙ্গু তথ্য নিয়ে গণমাধ্যমের খবর প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। মেয়র যেখানে সন্দেহ পোষণ করেন চিকিৎসা ব্যবস্থা সেখানে কেমন হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়! ফলে, ডেঙ্গুর ওষুধ যথাসময়ে প্রয়োগে ব্যর্থতার পাশাপাশি বেফাঁস মন্তব্যের কারণে বিতর্কের মুখে পড়েন তিনি। তার কারণে আওয়ামী লীগেও দেখা দেয় অস্বস্তি। তার সময় গুলিস্তান এলাকা থেকে হকারদের সরাতে না পারাটাও সাঈদ খোকনের ব্যর্থতা বলে অনেকে মনে করেন। যেখানে উত্তরের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক সফলভাবে তেজগাঁও থেকে ট্রাক স্ট্যান্ড উঠিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাবা মোহাম্মদ হানিফের হাত ধরেই সাঈদ খোকন রাজনীতিতে আসেন। ১৯৮৭ সালে ওয়ার্ড শাখার আইনবিষয়ক সম্পাদক হন। ১৯৯৯ সালে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ২০০৪ সালে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মনোনীত হন। সর্বশেষ তিনি মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহসভাপতি পদে ছিলেন। মেয়র পদে প্রার্থীর নাম ঘোষণার সময় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘মনোনয়ন বোর্ডে যারা ছিলেন, তারা প্রার্থীর জনপ্রিয়তার বিষয়টি দেখেছেন। তার গ্রহণযোগ্যতার দিক বিবেচনায় নিয়েছেন। মনোনয়ন বোর্ডের সবার সম্মতিতে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী মনোনয়ন দিয়েছেন। এটা নিয়ে তার বাড়তি কিছু বলার নেই।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করেন। দক্ষিণের মেয়র মানেই পুরান ঢাকার কেউ প্রার্থী হবেন, এমন ধারণা এবার আর থাকেনি। সেই চ্যালেঞ্জটিই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী নিয়েছেন। ভোট ব্যাংক হলেও পুরান ঢাকা থেকেই প্রার্থী দেয়ার বদ্ধমূল ধারণায় যে পরিবর্তন এসেছে সেটি প্রশংসিত হয়েছে। কাজের প্রতিদান দিতে ভুল করেন না শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ছাড়াও মোহাম্মদ হানিফ ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পেছনে যে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন শেখ হাসিনা সে কথা বিস্মৃত হননি। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় মানববর্ম তৈরি করে যারা প্রিয়নেত্রীকে বাঁচিয়েছিলেন, তাদের একজন ছিলেন মোহাম্মদ হানিফ। ওই হামলায় গ্রেনেডের স্পিøন্টার এসে বিঁধে তার গায়ে। সেই যন্ত্রণায় কাতর হয়েই মারা যান হানিফ। শেখ হাসিনা সেই দিনের কথা ভুলে যাননি বলেই পরবর্তীতে দলের অপেক্ষাকৃত তরুণ মুখ সাঈদ খোকনকে মেয়র পদে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। সাঈদ খোকন কি তার যথাযথ মূল্যায়ন করতে পেরেছিলেন? মেয়র হিসেবে তাপস যোগ্যতা হারিয়েছেন কোন কাজের নিক্তিতে সাঈদ খোকন এমন মন্তব্য করেছেন। মেয়র সম্পর্কে এখন তিনি যা বলছেন, কিছুদিন আগেও কেন তা বলেননি। মামলা হওয়ার পর কেন বলছেন? আলোচনায় এসব বিষয়ও উঠে আসছে। অনেকেই মনে করেন, মেয়র হিসেবে নবীন শেখ ফজলে নূর তাপসকে মূল্যায়নের সময় এখনো আসেনি। নগরবাসী তার দিকে শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পাঁচ বছর পর লাভ-ক্ষতির হিসাব হবে। মেয়র হিসেবে সাফল্য-ব্যর্থতার হিসেব তাকেও দিতে হবে এক সময়। লেখক : সাংবাদিক
×