ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী

মিজান- আমার সাংবাদিকতার অনুজ প্রতিবেশী

প্রকাশিত: ২০:৪৪, ১৪ জানুয়ারি ২০২১

মিজান- আমার সাংবাদিকতার অনুজ প্রতিবেশী

মিজান চলে গেল। মিজানুর রহমান খান। সাংবাদিকতা তার পেশা এবং নেশা ছিল। মাত্র তিপ্পান্ন বছর বয়সে তার অকাল প্রয়াণ। শুধু করোনাতেই তার মৃত্যু হয়েছে তা বলা যাবে না। দীর্ঘদিন যাবত সে রোগে ভুগছিল। শেষ পর্যন্ত করোনা তাকে মরণাঘাত করেছে। এবার বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যু হয়েছে অনেক সাংবাদিকের। কিন্তু মিজানের মৃত্যু বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় এক বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি করে গেল। তার মতো শক্তিশালী কলামিস্ট সম্ভবত বর্তমান প্রজন্মের কলামিস্টদের মধ্যে কম পাওয়া যাবে। একুশ সালে পা দিয়ে আমার জীবনে আরেকটি শোকের আঘাত মিজানের মৃত্যু। গত সোমবার যখন টেলিফোনে খবরটা পেয়েছি তখন সহসা বিশ্বাস করে উঠতে পারিনি। পরে ‘প্রথম আলোর’ সম্পাদক মতিউর রহমানকে টেলিফোনে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি খবরটা কনফার্ম করলেন। বুকটা ভেঙ্গে গেল। এটাতো আমার একার ব্যক্তিগত শোক নয়, সারা জাতির শোক। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্রান্তিলগ্নে যখন মিজানের মতো আরও গবেষক ও মেধাবী সাংবাদিকের আবশ্যকতা ছিল, তখন মিজান চলে গেল। তাহলে একুশ সালও কি বিশ সালের মতো আমাদের চোখের অশ্রু শুকাতে দেবে না? সদ্য বিদায়ী ’২০ সালের কথা ভাবলে মনটা শিউরে ওঠে। আমরা আশা করেছিলাম, ২০ সাল হবে আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ বছর। সালটি ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর বছর। মুজিববর্ষ। সারাদেশ আনন্দে উল্লাসে উত্তাল হবে, জাতির পিতার ধর্মনিরপেক্ষ বাংলা গড়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে বুক বাঁধবে, এটাই ছিল জাতির প্রত্যাশা। আর এই প্রত্যাশার বছরে দেখা দিল বন্যা, প্লাবন, ঝড়, করোনার মতো বিশ্বত্রাস দানব এবং কট্টর মৌলবাদীদের উত্থান। করোনা দেশের এক বিরাট সংখ্যক বুদ্ধিজীবী ও মনীষীর প্রাণ হরণ করেছে। আমার বয়সী এবং কমবয়সী বহু বন্ধু আজ আর নেই। এক হাতে চোখের জল মুছেছি এবং অন্য হাতে এই সদ্যপ্রয়াত বন্ধুদের ওবিচুয়ারি লিখেছি। কিন্তু ভাবতে পারিনি, নতুন একুশ সালের সূচনাতেই আমার চাইতে বয়সে ৩৪ বছরের ছোট এক ক্ষণজন্মা মেধাবী তরুণের ওবিচুয়ারি আমাকে লিখতে হবে। এর চাইতে আমার নিজের ওবিচুয়ারি আমার নিজের লেখা উচিত ছিল। মিজানুর রহমান খানের সঙ্গে আমার পরিচয় কবে? তাও তো বহু বছর হবে। ঢাকা থেকে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকা বের হবে। পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক গোলাম সারওয়ার (তিনিও আজ নেই)। তার পত্রিকায় আমাকে লেখার আমন্ত্রণ জানিয়ে বললেন, আপনার সঙ্গে মিজানুর রহমান খান নামে এক যুবক যোগাযোগ করবে। আমার এডিটোরিয়াল এসিস্ট্যান্ট। তরুণ এবং মেধাবী সাংবাদিক। পরিচিত হলে খুশি হবেন। বৃহত্তর বরিশালের ঝালকাঠির ছেলে। ঝালকাঠিতো বরিশাল শহরের অদূরেই। বহুবার গেছি। বললাম, ‘সুগন্ধার’ সন্তান। সম্ভবত ভাল লোক রিক্রুট করেছো। সেদিন বিকেলেই বাসায় টেলিফোন বেজে উঠল। রিসিভার তুলতেই শুনতে পেলাম, আমি মিজান বলছি গাফ্্ফার ভাই। এখন থেকে যুগান্তরে লেখার ব্যাপারে আমিই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। আপনার কলামের নাম কি হবে জানাবেন কি? প্রথম পরিচয়েই তাকে আমি তুমি সম্বোধন করেছিলাম। বলেছিলাম, তুমিই একটা নাম সাজেস্ট করো। মিজান বলল, আপনিতো এক সময় ‘তৃতীয় মত’ নামে কলাম লিখতেন। সে নামটাই রিভাইব করতে পারেন। তার সাজেশন আমার খুব ভাল লেগেছিল। সেই যে তৃতীয় মত নামে যুগান্তরে আমার কলাম লেখা, এখনও এই নামেই লিখছি। এরপর থেকেই প্রতি সপ্তাহে মিজানের কণ্ঠ আমার টেলিফোনে বেজে উঠত। শুধু লেখার বিষয় নয়, নিজেদের সুখ-দুঃখের কথা নিয়েও আলোচনা করি। সে বিবাহিত। সন্তানের জনক। তার সাংবাদিকতা হাল্কা সাংবাদিকতা নয়, রীতিমতো গবেষণাভিত্তিক সাংবাদিক। বহুদিন কলাম লিখতে বসে কোন রেফারেন্স খুঁজে না পেলে মিজানকে টেলিফোন করতাম। মিজান সেই রেফারেন্স খুঁজে পেতে আমাকে জানাতে দেরি করত না। মিজান যুগান্তরের কাজ করার সময়ের বহু ঘটনার মধ্যে একটি ঘটনা না উল্লেখ করলেই নয়। যুগান্তরে হঠাৎ একদিন প্রয়াত প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামালের একটি লেখা বেরুলো। তাতে তিনি কেন একাত্তরের ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, তার যৌক্তিকতা দেখিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, ‘জন্মসূত্রে কেউ কোন দেশের নাগরিক হলে সেই নাগরিকত্ব বাতিল করা যায় না।’ লেখাটা পড়ে আমার খুব রাগ হয়। মোস্তফা কামাল এবং আমি একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। শামসুর রাহমান (কবি) এবং আমি দু’জনেই ছিলাম তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। যদিও মোস্তফা কামাল সেই ছাত্রজীবনে ছিলেন ধর্মীয় রাজনীতির অনুসারী, তা আমাদের ব্যক্তিগত বন্ধুত্বে কোন ফাটল ধরায়নি। বিচারপতি মোস্তফা কামালের লেখাটি পড়ে রাগ সামলাতে পারলাম না। মিজানুর রহমান খানকে টেলিফোন করলাম। বললাম, আমি বিচারপতির এই লেখার প্রতিবাদ করব। হোক না চিফ জাস্টিস। আমি তার লেখার প্রতিবাদ জানাব। মিজান কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর আমতা আমতা করে বলল, গাফ্ফার ভাই, লেখাটা বিচারপতি লেখেননি। আমিই তাকে লিখতে বলেছিলাম। তিনি ডিকটেশন দিয়েছেন, আমি লিখেছি। আমি রাগ সামলাতে পারলাম না। একটা খারাপ গালি দিয়ে বললাম, তুমিই না আমাকে বলছিলে কৈশোরে, তুমি যে ভুল রাজনীতি করতে, তা ত্যাগ করেছো। এখন তো তোমার আসল রূপ দেখছি। মিজান প্রায় কেঁদে ফেলল। বলল- বিশ্বাস করুন গাফ্্ফার ভাই, অতীতে যে ভুল বিশ্বাস পোষণ করতাম, তা আমি কাটিয়ে উঠেছি। একটা ঐতিহাসিক দলিল রক্ষার স্বার্থে আমি বিচারপতিকে এই লেখাটা লিখতে অনুরোধ করেছিলাম। আপনি প্রতিবাদ করতে চাইলে করুন। যুগান্তরে সেটাও ছাপা হবে। তখনও রাগ আমার কমেনি। বলেছি, আচ্ছা, লেখা পাঠাচ্ছি। আমার ক্রোধ প্রকাশে সে কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। বিনীতভাবে আমার কথার জবাব দিয়েছে। পরে তাকে খারাপ গালি দেয়ায় অনুতপ্ত হয়েছি। অনুতাপ প্রকাশ করেছি। সত্যি সেতো অন্যায় করেনি। তার গবেষণাধর্মী মন। তাই বিচারপতি মোস্তফা কামালের কাছ থেকে গোলাম আযমের নাগরিকত্বের মামলা সম্পর্কে একটি ঐতিহাসিক তথ্য বের করে আনতে চেয়েছিল। বিচারপতির বক্তব্যের জবাবে ‘যুগান্তরেই’ আমি লিখেছিলাম, নাগরিকত্ব বাতিল সম্পর্কে বিচারপতি কামালের যুক্তি সঠিক নয়। জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব পাওয়া বহু নাগরিকের নাগরিকত্ব বাতিলের বহু প্রমাণ রয়েছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে ব্রিটিশমন্ত্রী স্যার জন এমেরির ছেলে জুনিয়র এমেরি দেশ ত্যাগ করে জামার্নিতে চলে গিয়েছিল। সে নাৎসি প্রোপাগান্ডায় অংশ নিয়ে ব্রিটিশবিরোধী প্রচারণা চালাতো। তার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিল হয়েছিল এবং নাৎসি যুদ্ধাপরাধী হিসাবে বিচার ও দণ্ড হয়েছিল। আমার এ লেখটি ‘যুগান্তরে’ প্রকাশিত হওয়ার পর বিচারপতি মোস্তফা কামাল আবারও লিখেছিলেন। এবার ডিকটেশন দিয়ে নয়, নিজ হাতে লিখে যুগান্তরে পাঠিয়ে ছিলেন। তাতে তিনি আমার বক্তব্যের কোন জবাব দেননি। শুধু লিখেছিলেন, ‘বন্ধু গাফ্্ফার চৌধুরীকে অবহিত করার জন্য জানাচ্ছি, গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব টিকিয়ে দেয়ার রায়ে আমিই শুধু সই করিনি, তার বন্ধু বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমানও সই করেছিলেন।’ আমি তার লেখা পড়ে হতবাক হয়ে যাই। গোলাম আযমের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়ার মামলায় আমাদের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী সমাজের শিরোমণি, আমরা যাকে শেলিভাই- এই ডাক নামে ডাকতে অজ্ঞান হয়ে যাই, তিনি গোলাম আযমের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন, এটা জেনে তার প্রতি সকল শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলি। আমি মিজানকে সে কথা জানাই। মিজান বলল, অযথাই আমাকে গালি দিলেন। আমার জন্যই আপনি একটি প্রকৃত সত্য জানতে পারলেন। যুগান্তরে মিজান সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করার সময় এ ধরনের সত্য উন্মোচনের ঘটনা আরও ঘটেছে। শোকসন্তপ্তচিত্তে সেসব কথা এখন স্মরণ করি। আরেকটি ঘটনা। লন্ডনে আমার কাছে ঢাকা থেকে মিজানের হঠাৎ একদিন টেলিফোন, গাফ্্ফার ভাই, আমি লন্ডনে আসতে চাই। কিন্তু ব্রিটিশ হাইকমিশন ভিসা দিচ্ছে না। বললাম, আমি তাতে কি করতে পারি? তুমি তোমার সম্পাদককে বলো। তিনি সম্পাদক মানুষ। তিনি ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশনকে বললে হয়তো কিছু হতে পারে। মিজান বলল, সারওয়ার ভাইকে বলেছিলাম। তিনি চেষ্টা করেছিলেন। কোন কাজ হয়নি। আপনার কথা তিনিই বললেন। আনোয়ার চৌধুরী এখন ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনার। আপনি তাকে বললে কিছু হতে পারে। আনোয়ার চৌধুরী আমার স্বল্প পরিচিত। তিনি আমার কথা রাখবেন কিনা বুঝতে পারছিলাম না। তবু মিজানের মন রাখার জন্য তাকে একটা চিঠি দিলাম। মিজান ভিসা পেয়ে গেল। চলে এলো লন্ডনে। মিজানুর রহমান খানের সঙ্গে সেই আমার প্রথম দেখা। মিজান যে ক’দিন লন্ডনে ছিল বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে, বড় বড় সংবাদপত্র অফিসে। তাকে খুব কমই আড্ডা দিতে দেখেছি। তথ্যানুসন্ধানে সে ছিল পাগল। এজন্যই ‘প্রথম আলোতে’ তার উপসম্পাদকীয়গুলো শুধু তথ্যভর্তি ছিল না। তাতে তার গবেষণা এবং তথ্য সংগ্রহে শ্রমের স্বাক্ষরও রয়েছে। প্রথম আলোর রাজনৈতিক মতের সঙ্গে আমি সহমত পোষণ করি না। ফলে এই পত্রিকার পলিসি অনুসরণ করে মিজান যে সব কলাম লিখেছে, আমি তাকে স্নেহ করা সত্ত্বেও তার প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু সকল সময়েই তার লেখার শক্তি, তথ্যনির্ভরতা ও যুক্তিকে মনে মনে সম্মান করেছি। আগের কথা রেখে পরের কথায় চলে গিয়েছি। আগের কথায় ফিরে যাই। যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদক পদে গোলাম সারওয়ার হঠাৎ ইস্তফা দেন এবং সমকাল পত্রিকা বের করেন। মিজানও তার সঙ্গে সমকালে চলে যায়। তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক অব্যাহত থাকে। কারণ আমি সমকালেও কলাম লিখতে রাজি হই। এই লেখা সম্পর্কে প্রতি সপ্তাহে মিজানের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ হতো। খুব বেশিদিন যায়নি। হঠাৎ একদিন মিজান টেলিফোন করলেন, গাফ্ফার ভাই, আমি প্রথম আলোতে চলে যাচ্ছি। ভাল অফার পেয়েছি। আমি কিছুক্ষণ হতবাক। তার পর বললাম, তুমি সর্বাধিক প্রচারিত একটি জাতীয় দৈনিকে যাচ্ছো। আশা করি ভাল লিখবে। ভাল থাকবে। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের সঙ্গে আমার মত ও পথের কোনটার মিল নেই। কিন্তু একটা কথা বলব, তিনি তার কাগজের সাংবাদিক ও কলাম লেখকদের যথেষ্ট যত্ন নেন। ইদানীং মিজানের সঙ্গে খুব একটা টেলিফোন আলাপ হতো না। তবে প্রথম আলোতে প্রকাশিত তার লেখাগুলো নিয়মিত পড়তাম। সে আমার বয়সে অনেক ছোট। কিন্তু সাংবাদিকতায় ছিল বড় মাপের। বহু আইনী জটিলতার বিষয়ে তার লেখা পড়ে বিস্মিত হয়েছি। মনে হতো কোন বিশেষজ্ঞের লেখা পড়ছি। আমেরিকার আর্কাইভ ঘেঁটে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অনেক দুর্লভ তথ্য, অজানা তথ্য তুলে এনে সে জাতিকে উপকৃত ও সমৃদ্ধ করেছে। সংবিধান সংক্রান্ত বিতর্কেও তার লেখায় পাওয়া যেতো সমাধানের সূত্র। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এবং ’৭১ এর ঘাতক দালালদের বিচার সম্পর্কে তার সংগৃহীত ও গবেষণালব্ধ তথ্য বহু বিতর্কের অবসান ঘটাতে সাহায্য করেছে। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই সাংবাদিক, ইতিহাসবিদ, গবেষক এবং তথ্যসন্ধানী বড় অল্প বয়সে চলে গেল। এটা শুধু একটি জাতীয় দৈনিকের ক্ষতি নয়, বাংলা সাংবাদিকতার ক্ষতি, বাংলাদেশের ক্ষতি। তার শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজনদের, তার সাংবাদিক সহকর্মীদের আন্তরিক সমবেদনা জানাই। তাদের শোকের শরিক আমিও। [লন্ডন, ১৩ জানুয়ারি, বুধবার, ২০২১ ॥]
×