ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পঞ্চাশ দশকের আধুনিক কথাসাহিত্যিক

প্রকাশিত: ২৩:৩৯, ৮ জানুয়ারি ২০২১

পঞ্চাশ দশকের আধুনিক কথাসাহিত্যিক

পঞ্চাশ দশকের আধুনিক কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের প্রথম উপন্যাস ‘মধুমতী’ ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পরেই তিনি সাহিত্যিক মহলে ভীষণভাবে সমাদৃত হন। আমার মায়ের প্রিয় সাহিত্যিকের এই উপন্যাসটি আমি পড়ি ১৯৬৯ সালে দশম শ্রেণীতে পড়ার সময়ে। পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম তাঁতিদের নিয়ে লেখা অসাধারণ উপন্যাস। মনে দাগ কেটেছিল। সেই তাঁতিদের জীবন আমি দেখেছিলাম অনেক বছর পরে কুমারখালীতে, গড়াই নদীর তীরে। তখন আমার রাবেয়া আপার উপন্যাসের কথা মনে হয়েছিল। অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৯) প্রদান অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে রাবেয়া আপাকে কথাটা বলতেই তিনি শুনে একটু হাসলেন, খুশি হয়ে বললেন সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকা এই বইয়ের খুব সুন্দর সমালোচনা করেছিল। সেই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে প্রকাশিত সকল কাগজসমূহে (দৈনিক পূর্বপাকিস্তান, ইত্তেফাক, সংবাদ) এই উপন্যাসের আলোচনা হয়। রাবেয়া খাতুন আপার আরেকটি অসাধারণ উপন্যাস ‘বায়ান্নো গলির এক গলি’ আমার খুব প্রিয়। এই উপন্যাসটি নিয়ে কেন যে কেউ চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেন না! মনে পড়ে, ১৯৮২ সালে তখনকার সবচেয়ে নান্দনিক পত্রিকা সচিত্র সন্ধানীতে ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত হলো তার লেখা ভীষণ আলোচিত ‘নীল নিশীথ’। বিরূপ আলোচনায় সাহিত্যিকের নীল’ হয়ে যাওয়ার অবস্থা। একজন নারীর হাত দিয়ে এমন যৌনতা দুষ্ট সামাজিক চিত্রের উপস্থাপন! এ কি সহ্য করা যায়। সমাজে গলদ থাকবে কিন্তু একজন নারীর কলম দিয়ে তা বেরুবে কেন? তদুপরি, তিনি শিক্ষকতা করেন। এসব কিভাবে জানেন? লেখার গুণের চেয়ে এই আলোচনা বেশি গুরুত্ব পেল। আমরা রাবেয়া আপার জন্য গর্ব অনুভব করেছি। তার দৃষ্টির গভীরতা চিন্তা করে। বেগম’ পত্রিকার কোন ঈদসংখ্যা রাবেয়া খাতুনের লেখা ছাড়া প্রকাশিত হয়নি। রাবেয়া খাতুন পঞ্চাশটির মতো উপন্যাস লিখেছেন। চারশ’র বেশি ছোটগল্প। শিশুদের জন্য লিখেছেন। কিশোরদের জন্য লিখেছেন। ভ্রমণকাহিনী,আত্মজীবনী কী লিখেন নাই? তাঁর লেখা স্মৃতিকথা ‘জীবন ও সাহিত্য’; মুক্তিযুদ্ধের সময়ে লেখা ‘একাত্তরের নয় মাস’ আমার আরও দুটি প্রিয় গ্রন্থ। নারী জীবনের যন্ত্রণা, দুঃখ-কষ্ট যেমন তাঁর সাহিত্যে অবলীলায় সাবলীলভাবে ওঠে এসেছে; তেমনি তাঁর নারী চরিত্র দারিদ্র্যের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে ঘুরে দাঁড়াতেও পারে। দাঁড়ায়। মুক্তিযুদ্ধ তাঁর লেখা গল্পে-উপন্যাসে বারে বারে এসেছে। সবচেয়ে ভাল লেগেছে একাত্তরে নয় মাস’ (১৯৯০ সালে প্রকাশিত) বইয়ের ১৬ মার্চ ১৯৭১ সালের স্মৃতিচারণে, তিনি যেখানে লিখেছেন- ’মহিলাদের সংখ্যা কম হলেও মিছিলের মুখ তাদের দিয়েই। পূর্ব পাকিস্তান লেখক সংগ্রাম শিবিরের বিরাট ব্যানারের একদিকে দণ্ড ধরে লায়লা সামাদ। অন্যদিকে কাজী রোজী এবং আমি। মাঝে ফেস্টুন হাতে সুফিয়া কামাল।...সুফিয়া কামালের দুপাশে শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা, নতুন লেখক সুফিয়া খাতুন, আরও কবি, কথাশিল্পী এবং কয়েকজন সঙ্গীতশিল্পী’। উল্লেখ্য তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিন অনেক চেনামুখের সঙ্গে কামরুল হাসান, শামসুর রাহমান, কাইয়ুম চৌধুরী, আনিসুজ্জামান, শামসুজ্জামানকেও দেখে ছিলেন। তাঁর দৃষ্টির স্বচ্ছতা, উপলব্ধির প্রগাঢ়তা, ঝরঝরে ভাষা তাঁকে পাঠকপ্রিয়তা দিয়েছে। ঢাকার বিক্রমপুরে রাবেয়া খাতুন ১৯৩৫ সালে ২৭ ডিসেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মৌলভী মোহাম্মদ মুল্লুক চাঁদ। মা হামিদা খাতুন। ১৯৫২ সালে চিত্রপরিচালক ও সিনেমা পত্রিকার সম্পাদক এটিএম ফজলুল হকের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তাতে তাঁর লেখার ক্ষেত্র প্রসারিত হয়। তিনি ‘অঙ্গনা’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। তৎকালীন সকল বাংলা পত্রিকায় লিখেছেন। তাঁর সাহিত্য ভাণ্ডার খুব সমৃদ্ধ। সৃজনশীল সাহিত্যকর্মের জন্য অনেক পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন। স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক (১৯৯৩), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭৩), বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ (১৯৯৪), নাসিরুদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৯৫), টিভি নাটকের জন্য টেনাশিনাস পুরস্কার (১৯৯৭), অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৯), বাচসাসসহ অনেক পুরস্কার অর্জন করেন। ব্যক্তিগত জীবনে চার কৃতী সন্তানের জননী। মাত্র কয়েকদিন পূর্বে তিনি ৮৫ বছর পূর্ণ করে ৮৬ বছরে পা রাখলেন। বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। সদা প্রফুল্ল, সতত সপ্রতিভ রাবেয়া খাতুন অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। রাবেয়া খাতুনের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘মেঘের পরে মেঘ’ বাংলাদেশের সকল চলচ্চিত্রমোদীদের খুব প্রিয় চলচ্চিত্র। কতবার যে দেখেছি! ‘কখনও মেঘ কখনও বৃষ্টি’, মধুমতি’ চলচ্চিত্রগুলো অনেক দিন মানুষ দেখার সুযোগ পাচ্ছে না। প্রখ্যাত সাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন ৩ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে, সন্ধ্যা ৬টায় মৃত্যুবরণ করেন। এক রক্ষণশীল সময়ে তিনি শক্তিশালী কলম ধরেছিলেন। আমাদের এগিয়ে যেতে সাহস দিয়েছেন। তাঁকে অভিবাদন জানাই। শ্রদ্ধা জানাই।
×