ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মিহির কুমার রায়

গ্রামীণ জনগণের দোরগোড়ায় এজেন্ট ব্যাংকিং

প্রকাশিত: ০০:২৫, ৩ জানুয়ারি ২০২১

গ্রামীণ জনগণের দোরগোড়ায় এজেন্ট ব্যাংকিং

বাংলাদেশে দারিদ্র্যজনের কাছে আর্থিকসেবা পৌঁছানোর জন্য সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে অনেক মডেলের জন্ম হয়েছিল যার মধ্যে সোনালী ব্যাংকের কৃষি শাখা মডেল, কৃষি ব্যাংকের লিংকেজ মডেল (বস্তিবাসীদের ঘরে ফেরা), ব্র্যাকের আরডিপি মডেল, আশার ক্ষুদ্রঋণ মডেল, গ্রামীণ ব্যাংক মডেলের ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচী, বার্ডের এসএফডিএফ মডেল উল্লেখযোগ্য। তারপরও দেশের অগণিত প্রান্তিকজন আর্থিক সেবার আওতা থেকে বাহিরে রয়ে গেছে যার পরিমাণ একেবারেই কম নয়। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ে একক কোন মডেল উদ্ভব হয়নি যার মাধ্যমে প্রান্তিকজনের কাছে আর্থিক সেবা পৌঁছানো যায়। সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে দেশে বর্তমান সময়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী চার কোটি জনসংখ্যার সঙ্গে আরও ১ কোটি ৫০ হাজার যোগ হয়ে তা দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৫০ হাজার যা দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৩০ ভাগের উপরে রয়েছে। সেই সকল জনগোষ্ঠীর অনেকেই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে আবার কেউ ভাগ্যের অন্বেষণে বিদেশে পাড়ি জমায় এবং দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা আনয়ন করে যার ফলে বর্তমানে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা দিয়ে আট মাসের আমদানি বিল পরিশোধ করা যায়। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা যায় যে, বাংলাদেশে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী গ্রাহকদের কাছে সুলভে বিভিন্ন রকম আর্থিক সেবা পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে প্রধানতম ভূমিকাটি পালন করেছে ডিজিটাল প্রযুুক্তির কার্যকর প্রয়োগ। এক্ষেত্রে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এক দশক আগে এমএফএসের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জগুলো বিবেচনায় নিয়ে ‘ব্যাংক লেড মডেল’ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তিন-চার বছরের মধ্যেই সর্বস্তরের নাগরিকদের এমএফএস সেবার আওতায় নিয়ে এসে সারা বিশ্বের ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রোভাইডারদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সে সময়ের সাহসী ও সুবিবেচনাপ্রসূত উদ্যোগের সুফল পাওয়া গেছে করোনা পরিস্থিতিতে। করোনার মাসগুলোয় প্রতি মাসেই এমএফএস লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে। কারণ আংশিক লকডাউনের সময় প্রায় সর্বস্তরের মানুষই নির্ভর করেছে মোবাইলভিত্তিক আর্থিক লেনদেনের ওপর। আলোচ্য প্রবন্ধটিতে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে বিশেষত: আর্থিক সেবা দারিদ্র্যজনের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য। এখন অনেকের মনে প্রশ্ন থাকতে পারে আসলে বিষয়টি কি এবং তার কার্য পদ্ধতিই বা কি? এজেন্ট ব্যাংকিং হলো একটি আর্থিক সেবা যার মাধ্যমে যেখানে প্রথাগতভাবে যারা আর্থিক সেবা গ্রহণের সুযোগ পায় না তাদের দরজায় আর্থিক সেবা পৌঁছে দেয়া একটি নিয়ম তান্ত্রিক পদ্বতিতে যা দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই ব্যাংকিং মডেলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো নির্দিষ্ট ব্যাংক একটি চুক্তির মাধ্যমে এজেন্ট নিয়োগ দেবে যিনি ব্যাংকের প্রতিনিধি হিসাবে গ্রাহকদের আর্থিক সেবা দিয়ে যাবে বিশেষত: সেই সব দুর্গম এলাকায় যেখানে ব্যাংকের শাখা খোলা সম্ভবপর হয়ে উঠে না অবস্থানগত কারণে। সঠিক সময়ে লেনদেন সম্পাদনের জন্য অনলাইন পদ্বতিতে একটি সফটওয়ার ব্যবহার করা হয় এবং এই লেনদেন নিশ্চিত করা হয় টু ফেক্টর মেকানিজমের মাধ্যমে যেখানে গ্রাহক ও এজেন্ট বায়োমেট্রিক পদ্বতির মাধ্যমে তাদের লেনদেন নিশ্চিত করে যা এসএমএস এর মাধ্যমে গ্রাহককে অবহিত করা হয়। যেহেতেু এটি আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত তাই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ব্যাংক একটি নীতিমালার মাধ্যমে এজেন্ট নিয়োগ দিয়ে থাকে যেমনÑ এজেন্টকে বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে, লাইসেন্সধারী উদ্যোক্তা হতে হবে, এনজিও হলে এমআরএ কিংবা সমাজসেবা অধিদফতরে নিবন্ধনকৃত হতে হবে, সমবায় সমিতি হলে সমবায় অধিদফতরের নিবন্ধনকৃত হতে হবে, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি, এজেন্ট অব মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর, এজেন্ট মালিককে ন্যূনতম মাধ্যমিক পাস হতে হবে, বয়স অবশ্যই ১৮-৬৪ বছর হতে হবে, এজেন্টকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে হবে, এজেন্টকে আউটলেট তৈরি যেমন ব্রান্ডিং, আসবাবপত্র, আইটি সরঞ্জামাদির জন্য ন্যূনতম এক লাখ থেকে ৩ লাখ টাকা বিনিয়োগের সক্ষমতা থাকতে হবে, মাসিক ভিত্তিতে পরিচালন ব্যয় যেমন স্টেশনারি, আপ্যায়ন ব্যয়, যাতায়াত ব্যয় প্রভৃতি এজেন্টকে বহন করতে হবে, তবে নির্দিষ্ট ব্যাংক হিসাব খোলার ফরম, লেনদেন স্লিপ, ক্যাশ রেজিস্ট্রার, হাজিরা খাতা ইত্যাদি ব্যাংক সরবরাহ করবে। এজেন্ট ব্যাংকের যে কোন গ্রাহক সেই নির্দিষ্ট ব্যাংকের গ্রাহক হতে পারবে এবং ব্যাংকের মতো অফিস সময় ১০ থেকে ৬ পর্যন্ত হলেও এজেন্ট ব্যাংকিং গ্রাহকের সুবিধার্থে ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখলেও কোন অসুবিধা নেই। এজেন্ট ব্যাংক শাখার কোড নাম্বার ও রেটিং নাম্বার থাকবে। একজন এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের গ্রাহক অনলাইন ব্যাংকিংয়ের সকল সুযোগ-সুবিধা পাবে, ডেবিড কার্ড পাবে, চেকবই পাবে তার আউটলেটের মাধ্যমে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেয়ার এই সেবা চালু হয়েছে এশিয়ার দেশ ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশীয়া, ভারত ও বাংলাদেশে। এখন আসা যাক এজেন্ট ব্যাংকিং এর বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের কাজের অগ্রগতি নিয়ে বিশ্লেষণ যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে খুবই প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা বিষয়ে নীতিমালা জারি করে এবং ২০১৪ সালে তা চালু হয় । কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে লাইসেন্স নিয়ে এরই মধ্যে ২৮টি ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের কাজ শুরু করেছে এবং শুরুর বছরের জানুয়ারিতে প্রথম এজেন্ট নিয়োগ পায় ব্যাংক এশিয়া। এরই মধ্যে দেশে ব্যাংকগুলোর এজেন্টের সংখ্যা ১০ হাজার এবং দেশব্যাপী এজেন্ট আউটলেট সংখ্যা ১৪ হাজার (উৎস : বাংলাদেশ ব্যাংক)। এজেন্ট আউটলেট চালুর ক্ষেত্রে সবার শীর্ষে আছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, আর এজেন্টদের মাধ্যমে হিসাব সংখ্যা চালুর ক্ষেত্রে শীর্ষস্থান দখলে রেখেছে ব্যাংক এশিয়া, এজেন্টদের মাধ্যমে আমানত ও রেমিটেন্স সংগ্রহে সবার উপরে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বংলাদেশ লিঃ এবং এজেন্টদের মাধ্যমে ঋণ বিতরণের শীর্ষস্থানে রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক লিঃ। সেবাটিকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে উদার দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও। এজেন্ট নিয়োগ, নতুন নতুন আউটলেট ও ব্যাংক হিসাব খোলায় একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা করছে অন্য ব্যাংকগুলোও। হিসাব মতে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এজেন্টদের মাধ্যমে মোট রেমিটেন্স এসেছিল ১৫ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা। আর বিশ্বব্যাপী মহামারী আঘাত হানার পর মাত্র নয় মাসে এজেন্টদের মাধ্যমে ২২ হাজার ৮০১ কোটি টাকার রেমিটেন্স এসেছে। এর মধ্যে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত এসেছে ৪ হাজার ১ কোটি টাকা। দেশে করোনা ভাইরাস ভয়াবহ মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ার পর এজেন্টদের মাধ্যমে রেমিটেন্স প্রবাহ দ্বিগুণ হয়েছে। এপ্রিল থেকে জুন এ তিন মাসে এজেন্টদের মাধ্যমে ৭ হাজার ১১৫ কোটি টাকার রেমিটেন্স আসে। আর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এ তিন মাসে এজেন্টদের মাধ্যমে এসেছে ১১ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকার রেমিটেন্স। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের বিস্তার অবৈধ হুণ্ডি তৎপরতা বন্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখছে এবং এতে দেশের এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা যত বেশি বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ হবে, হুণ্ডির তৎপরতা তত বেশি কমবে।
×