ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কোন্নয়ন

প্রকাশিত: ০০:২৪, ৩ জানুয়ারি ২০২১

ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কোন্নয়ন

বাংলাদেশের সঙ্গে ভুটানের অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ)। স্বাক্ষর হয়েছে। এই চুক্তির কালে বাংলাদেশে ভুটানের ১০০টি পণ্যে এবং ভুটানে ৩৪টি পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। ভুটানের সঙ্গে এই চুক্তির ফলে দেশে বিনিয়োগ রফতানি আয় ও কর্মসংস্থান বাড়বে বলে মনে করেন খাতসংশ্লিষ্টরা। প্রথমবারের মতো কোন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যচুক্তি হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ কতটা লাভবান হবে এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সহ-সভাপতি মোঃ সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতির প্রসারকে আরও বাড়াতে হলে এই মুক্ত বাণিজ্য আরও বাড়াতে হবে। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল ও চীনের মতো দেশগুলোতে আমাদের বাজার আরও বাড়াতে হবে। এ ছাড়া দেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে। এগুলোতে বিনিয়োগ বাড়বে এবং রফতানি বাণিজ্যও বাড়বে। ব্যবসা, কর্মসংস্থান ও অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে এই চুক্তি। ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম বাংলাদেশে (আইবিএফবি) এর সভাপতি মোঃ হুমায়ুন রশিদ বলেন, এটা দেশের প্রথম পিটিএ। এ চুক্তির ফলে বিশ^বাণিজ্যে বাংলাদেশের আগামীর পথচলায় বড় ধরনের সহায়ক হবে। দেশের বাণিজ্য প্রসার ঘটাতে চাইলে বিশেষ করে আসিয়ান দেশগুলোর বাজার যদি আমরা মুক্তি বাণিজ্য করতে পারি, তাহলে বিশ^বাজারে আমাদের পণ্যের চাহিদা আরও বাড়বে। তবে ট্রানজিটসহ ভারতের সঙ্গে যেসব বাধা হচ্ছে, তা দূর করতে দেশটির সঙ্গে অর্থনৈতিক কূটনৈতিক তৎপরতা আরও জোরদার করতে হবে। ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশ ভুটানকে ১৮টি পণ্যে শুল্কুমুক্ত বাজার সুবিধা দিচ্ছে। আর বাংলাদেশের ১০টি পণ্য ভুটানে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পাচ্ছে। ভুটান আরও কিছু পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা চাওয়ায় দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্যচুক্তি’ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ২০১৯ সালের ১২-১৫ এপ্রিল ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময় এ নিয়ে আলোচনা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় এই বছরের ২১-২৩ আগস্ট দুই দেশের মধ্যে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে একটি বৈঠক হয়। এসব বৈঠকের আলোকে গত সেপ্টেম্বরে বাণিজ্যচুক্তির খসড়ায় অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। সঙ্গত কারণেই পিটিএ চুক্তি স্বাক্ষর এবং দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপন অনুষ্ঠানটিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও একটি ‘ঐতিহাসিক মুহূর্ত’ হিসেবে উল্লেখ করেন। এই বাণিজ্য চুক্তি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদার করবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আগামী ৫০ বছর আমাদের অঞ্চলের বাসিন্দাদের টেকসই উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির সাক্ষী হবে।’ ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ডাঃ লোটে শেরিং অনুষ্ঠানে যোগ দেন। বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং সহযোগিতা আরও জোরদার করার ইচ্ছা পোষণ করে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ সব সময় আমার মনের মধ্যে আছে।’ স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার কারণে ঐতিহাসিক মিত্র ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক থমকে গিয়েছিল। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য হয়েছিল মাত্র ১২ দশমিক ৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের। এর মধ্যে আমদানিই ছিল বেশি ১২ দশমিক ১৬ মিলিয়ন ডলারের। আর রফতানি ছিল মাত্র ০ দশমিক ৬১ মিলিয়ন ডলারের। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৭ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে আমদানি ছিল ৪৯ দশমিক ৯০ মিলিয়ন ডলারের, বেড়েছে চারগুণ। আর রফতানি হয়েছে ৭ দশমিক ৫৬ মিলিয়ন ডলারের, বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১২ গুণ। পিটিএ সই হওয়ার ফলে বর্তমানে বাণিজ্য, পযটন জলবিদ্যুত, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, স্বাস্থ্য জীববৈচিত্র্য, কৃষি আইসিটি, শিক্ষা, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনাসহ অনেক ক্ষেত্রেই এই সম্পর্ক বিস্তৃত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভুটানকে বাংলাদেশের তিনটি সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। বন্দর সুবিধা না থাকা দেশটির আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে এটি অনেক বেশি সাশ্রয়ী হবে। লালমনিরহাট পর্যন্ত নৌপথ সংস্কারকাজ সম্পন্ন হলে ভুটানের জন্য তা হবে আরও বেশি লাভজনক। বাংলাদেশও তা থেকে লাভবান হবে। ত্রিদেশীয় যৌথ উদ্যোগে ভুটানে জলবিদ্যুত উৎপাদনের প্রক্রিয়া এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালকে নিয়ে গড়ে ওঠা উপ-আঞ্চলিক জোট বিবিআইএন আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধির যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা-ও এই অঞ্চলের দেশগুলোকে আরও কাছে টানবে। ঐতিহাসিক মিত্র ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের যে নবযাত্রা সূচিত হয়েছে, আমরা আশা করি উত্তরোত্তর তা আরও গতি পাবে এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে উভয় দেশই সমৃদ্ধির শিখরে পৌঁছাবে। ভুটানের সঙ্গে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) স্বাক্ষর বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বড় ঘটনা। বিশে^র কোন দেশের সঙ্গে এটিই বাংলাদেশের প্রথম পিটিএ স্বাক্ষর। বস্তুত দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য এলাকার (সাফটা) আওতায় এমনিতেই বাংলাদেশ ও ভুটান কিছু বাণিজ্য সুবিধা ভোগ করে আসছে। পিটিএর ফলে এর আওতা আরও বাড়বে। সেবা খাতের বাণিজ্যও বাড়তে পারে। বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে বাণিজ্য ক্ষেত্রে ভুটানই এগিয়ে রয়েছে বেশি। ভুটানে আমাদের রফতানির পরিমাণ কম আর দেশটি থেকে আমাদের আমদানির পরিমাণ বেশি। কাজেই চুক্তি করে থেমে থাকলে চলবে না। বাণিজ্য সম্প্রসারণের পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে ভারসাম্যও আনতে হবে। স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি প্রদান করেছিল ভুটান। কাজেই ভুটানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আত্মিকও বটে। বাংলাদেশ ও ভুটান দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্কেরও সদস্য। বর্তমানে সার্কের কার্যকারিতা প্রায় স্তিমিত হয়ে পড়ায় এখন দ্বিপাক্ষিক ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয় দুটি গুরুত্বের সঙ্গে সামনে চলে এসেছে। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভুটানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মাধ্যমে দুই দেশই উপকৃত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে উভয় দেশই এমন অনেক কিছু বিষয় ও পণ্য আছে, যা বিনিময়যোগ্য হয়ে উঠলে দুই দেশেরই সমৃদ্ধি ঘটবে। যেমন, জলবিদ্যুত উৎপাদনে ভুটান বেশ এগিয়ে গেছে। দেশটির কাছ থেকে বিদ্যুত আমদানির বড় সুযোগ রয়েছে আমাদের। বস্তুত এ নিয়ে বেশকিছু দিন ধরেই আলোচনা চলছে। আমরা আশা করব, বিষয়টি অচিরেই চূড়ান্ত হবে। অন্যদিকে ভুটান বাংলাদেশের কাছ থেকে কৃষি, শিক্ষা, আইসিটি ইত্যাদি খাতে সহযোগিতা পেতে পারে। উল্লেখ্য, ভুটানের অনেক শিক্ষার্থী বাংলাদেশে পড়ালেখা করছেন। দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও পড়াশোনা করেছেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে। তিনি ভাল বাংলা বলতে পারেন। ফলে দু’দেশের মধ্যে সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে এখন। বস্তুত দ্বিপাক্ষিক ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ এখন জরুরী হয়ে পড়েছে। আমরা ভুটানের সঙ্গে আমাদের ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্কের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি প্রত্যাশা করছি। বাংলাদেশ-ভুটান নতুন দিগন্তে ভুটানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ডাঃ লোটে শেরিংয়ের সঙ্গেও বাংলাদেশের রয়েছে বিশেষ সম্পর্ক। এ সভায় যুক্ত হয়ে তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রের শিক্ষার্থী হিসেবে ময়মনসিংহ ও ঢাকায় অতিবাহিত সময়ের কথা স্মরণ করে যেভাবে বাংলাদেশকে ‘দ্বিতীয় বাড়ি’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে, তাও যথার্থ। এই তথ্যও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ যে, বাংলাদেশ এই প্রথম কোন দেশের সঙ্গে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি করেছে। দুই দেশের মধ্যে যে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে, এমন অগ্রাধিকার তার আনুষ্ঠানিকতা ছাপিয়ে যায়। বস্তুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সভাতেই স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, ভুটান চাইলে আমাদের চট্টগ্রাম, মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে পারবে। সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক বিমানবন্দর হিসেবে গড়ে তোলার যে প্রয়াস বর্তমান সরকারের রয়েছে, সেটিও দুই দেশকে আরও ঘনিষ্ঠ করে তুলবে আশা করা যায়। ওই বিমনাবন্দরে ভুটানের অবারিত প্রবেশাধিকারের কথাও বলেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ২০২৪ সালে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নীত হবে উন্নয়নশীল দেশে। ফলে বর্তমানে এলডিসি হিসেবে যেসব বাণিজ্য সুবিধা এখন বাংলাদেশ পাচ্ছে তা কিছুটা হলেও কমবে। সেই প্রেক্ষাপটে ভুটানের সঙ্গে প্রথম যে পিটিএ স্বাক্ষর হলো তা একটি অর্থনৈতিক অর্জন। বর্তমান বিশে^ অনেক রাষ্ট্রই পারস্পরিক বাণিজ্য সুবিধা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য বিভিন্ন মাত্রার বাণিজ্য করছে। চীনের নেতৃত্বে ‘রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি)’ নামে নতুন একটি বাণিজ্যিক জোট গঠনের চুক্তি হয়েছে। সেই জোটে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৪টি দেশ যুক্ত হয়েছে। বিশ^বাজারে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামসহ জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এই জোটে যুক্ত হয়েছে। আরসিইপিকে বলা হচ্ছে বিশে^র সবচেয়ে বড় মুক্তবাণিজ্য জোট। এর আকার বিশে^র মোট জিডিপির ৩০ শতাংশ। বাংলাদেশ উক্ত জোটে অন্তর্ভুক্ত হতে পারত কিনা-সে প্রশ্ন উঠেছে। এই জোটের কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশ কোন অসুবিধার সম্মুখীন হবে কিনা, সেটা নিয়ে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। বাণিজ্যিক লাভ-ক্ষতির হিসাব কষে আগামীতে এই জোটে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয়টি সরকারের সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করা দরকার।
×