ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের ॥ পাঁচ দশকের অর্থনীতি

প্রকাশিত: ০০:২৩, ৩ জানুয়ারি ২০২১

বাংলাদেশের ॥ পাঁচ দশকের অর্থনীতি

বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর গত ৪৯ বছরে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে উন্নয়নের মহাসড়কে স্থান করে নেয়া এক বিস্ময়ে পরিণত হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচন, মাথাপিছু আয়, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভসহ অর্থনৈতিক প্রায় প্রতিটি খাতেই অগ্রগতি দেখাতে সমর্থ হয়েছে। একই সময়ে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার। বেড়েছে দেশের মানুষের গড় আয়ু। ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি দিয়েছে পোশাক খাত। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের অর্থনীতি ও বর্তমানে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হওয়া দেশটির তুলনামূলক আলোচনা করেছেনÑ জলি রহমান মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) : বাংলাদেশ বর্ধিত জনসংখ্যার আধিক্য সত্ত্বেও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এর মূল কারণ হচ্ছে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের জানুয়ারি ২০২০ পর্যন্ত তথ্যানুসারে বাংলাদেশ সবজি, ধান ও আলু উৎপাদনে বিশ্বে যথাক্রমে ৩য়, ৪র্থ ও ৭ম। এ ছাড়াও মাছে ৪র্থ, আমে ৭ম, পেয়ারায় ৮ম এবং খাদ্যশস্য উৎপাদনে বিশ্বে ১০ম। জিডিপিতে কৃষির অবদান ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে। এই জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। সবশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে অবশ্য এর পরিমাণ ছিল ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। তবে এর পেছনে ছিল বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি। এই মহামারীতে বিশ্বের অনেক দেশই যেখানে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক ধারায় ছিল, সেখানে বাংলাদেশের ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অনেকের কাছেই বিস্ময়কর। করোনার অভিঘাত কাটিয়ে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরেও ৮ দশমিক ২০ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি আশা করছে সরকার। ইতিবাচক রফতানি : বিশ্বে রফতানি আয় অর্জনের ক্ষেত্রে বৃহৎ রফতানিকারক দেশগুলোর মধ্যে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ছিল ৪২তম। ২০১৮ সালে বৈশ্বিক পোশাক বাজারে বাংলাদেশের অংশ ছিল ৬ শতাংশ এবং পোশাক রফতানিতে একক দেশ হিসেবে বিশ্বে ২য়। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের জিডিপিতে পণ্য ও সেবা রফতানি খাতের অবদান ছিল ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ । সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন ইউনাইটেড স্টেটস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল এর হিসাব মতে তৈরি পোশাক শিল্পে বিশ্বের প্রথম সারির ১০টি উন্নতমানের (পরিবেশবান্ধব) কারখানার ৭টি’ই রয়েছে বাংলাদেশে। স্বাধীনতার পরে যে শিল্প আমাদের অর্থনীতিকে দাঁড় করিয়েছে তার একমাত্র মাধ্যম এই পোশাক শিল্প। মোট প্রবৃদ্ধির প্রায় ৬ থেকে ৮ শতাংশ আসে এ শিল্প খাত থেকে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে ১৯৭২-৭৩ সালে রফতানি আয় ছিল মাত্র ৩৪৮ দশমিক ৩৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যার সিংহভাগ আসত পাট, চা এবং চামড়াজাত পণ্যের রফতানির মাধ্যমে। পরবর্তী চার দশকে বাংলদেশের রফতানি আয় বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছানোর পেছনে প্রধান খাত হলো তৈরি পোশাক শিল্প। অন্যান্য সম্ভাবনাময় রফতানি খাত হলো ওষুধ শিল্প ও জাহাজ নির্মাণ শিল্প। ঈর্ষণীয় রেমিটেন্স অর্জন : ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে বাংলাদেশে প্রায় ১১ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স প্রদান করা হয়েছিল। ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে যা বেড়ে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার এবং ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে যা ৭৫০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। ২০২০ সালে বিশ্ব মন্দা সত্ত্বেও বাংলাদেশের রেমিটেন্স আয় ছিল ২৫০০ কোটি মার্কিনডলার যা ২০১৯ সালে ছিল ১৯০০ কোটি মার্কিন ডলার । ২০১৮, ২০১৭, ২০১৬ ও ২০১৫ সালে রেমিটেন্স এসেছে যথাক্রমে ১,৫৫৩, ১,৩৫৩, ১,৩৬১ ও ১,৫৩১ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২০ সাল থেকে সরকার প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের উপর ২ শতাংশ হারে (১০০ টাকায় ২ টাকা) প্রণোদনা দিচ্ছে। যার বাস্তবায়নে রেমিটেন্সের গতি প্রবাহ বিগত বছরের তুলনায় কয়েকগুণ বেড়েছে। অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও বাংলাদেশের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। ১৫ ডিসেম্বর সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ৪২ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারের সীমা ছাড়িয়েছে। মাথাপিছু গড় আয় ও বাজেট বৃদ্ধি : স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় ছিল মাত্র ১২৯ মার্কিন ডলার। বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে বার্ষিক মাথাপিছু গড় আয় ২ হাজার ৬৪ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ ৪৯ বছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে প্রায় ১৬ গুণ । স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের প্রথম বাজেটের আকার ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা। ৪৯ বছর পেরিয়ে এসে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেটের আকার ৭২২ গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকায়। এছাড়াও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) ১৯৭২ সালে ছিল ৫০১ কোটি টাকার, যা ২০২০ সালে এসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ পাঁচ হাজার কোটি টাকায়। এই তারতম্যই বলে দেয় বাংলাদেশের অর্থনীতির অভূতপূর্ব সফলতা। বাস্তবায়নের পথে দশ মেগাপ্রকল্প : দেশের উন্নয়নে সরকার ১০টি মেগাপ্রকল্প তৈরির পরিকল্পনা করেছে। চলমান মেগাপ্রকল্পগুলো বদলে দেবে বাংলাদেশকে। সরকারের এই মেগাপ্রকল্প হচ্ছে- পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প, ঢাকায় মেট্রোরেল প্রকল্প, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্প, দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ, কয়লাভিত্তিক রামপাল থার্মাল বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ, পায়রাবন্দর নির্মাণ এবং সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করতে যাওয়া এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের চলমান অর্থনীতির চাকা গতিময় হবে। বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব নিরসনে এসব প্রকল্প রাখবে ব্যাপক ভূমিকা। ইতোমধ্যে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শেষের পথে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মনে এটি নতুন আশার সঞ্চার করেছে। অর্থনীতিবিদরা ধারণা করছেন এ সেতুর মাধ্যমে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। এ প্রকল্পগুলো যখন শতভাগ বাস্তবায়ন হবে তখন বাংলাদেশ হবে একটি সমৃদ্ধ দেশ। এর প্রভাব এরই মধ্যে পরিলক্ষিত হতে শুরু করেছে। বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সূচকে দেশের সাম্প্রতিক অগ্রগতি দেখলে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। সম্ভাবনাময় ব্লু ইকোনমি : ব্লু ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি দেশ। এ দেশের মালিকানায় রয়েছে বঙ্গোপসাগরের এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা। বিশাল এ জলসীমাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের যে অঞ্চলের মালিকানা পেয়েছে, সেখানে অন্তত চারটি ক্ষেত্রে কার্যক্রম চালানো হলে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিবছর প্রায় আড়াই লাখ কোটি মার্কিন ডলার উপার্জন করা সম্ভব। এই ক্ষেত্র চারটি হলো তেল-গ্যাস উত্তোলন, মৎস্য সম্পদ আহরণ, বন্দরের সুবিধা সম্প্রসারণ ও পর্যটন। পরিবর্তন এসেছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে : চার দশক আগেও অভাব, দুঃখ, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, কুসংস্কার, অজ্ঞতা, পশ্চাৎমুখী সংস্কৃতির প্রভাব আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতিতে এক ধরনের অচলায়তন সৃষ্টি করে রেখেছিল। গ্রামের মানুষ এখন অশিক্ষা, অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের অভিশাপ থেকে মুক্ত। নগরায়নের ফলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে গেছে আগের তুলনায় বহুগুণ। বিশেষ করে কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রামের সাধারণ কৃষক শ্রেণীর ভাগ্য বদলে যাচ্ছে খুব দ্রুত। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ হচ্ছে। আগে যেখানে অনেক জমি চাষাবাদের আওতার বাইরে থেকে যেত। বছরে একটি মাত্র ফসল উৎপাদনের পর বাকি সময়টা অব্যবহৃত অবস্থায় রয়ে যেত। এখন সেখানে বছরজুড়ে পালাক্রমে বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ হচ্ছে। অব্যবহৃত অবস্থায় কোন জমিই খালি পড়ে থাকছে না। ফসল উৎপাদনের পরিমাণ বাড়াতে প্রতিটি কৃষক নানা কৌশল অবলম্বন করছেন। গ্রামের কৃষক ও অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত মানুষদের জন্য অনুকূল পরিবেশ বজায় থাকায় তাদের আর্থিক সচ্ছলতা ক্রমেই বাড়ছে। এখন তাদেরকে তেমন অর্থকষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে না। বাংলাদেশ তার দারিদ্র্যের হার কমাতে অভাবনীয় অগ্রগতি অর্জন করছে । ১৯৭১ সালে যেখানে দেশে প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত, সেখানে চলতি বছরের শুরুতে এর পরিমাণ ছিল ২০ দশমিক ৫০ শতাংশ। অন্যদিকে ১৯৭১ সালে মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৭ বছরের একটু বেশি। বর্তমানে গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৬ বছর। স্বাধীনতার ৪৯ বছরে দেশের আর্থ-সামাজিক ও অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতির আকার বহুগুণে বেড়েছে। স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে বাংলাদেশ এখন নিম্নমধ্যবিত্ত আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে বিশ্ববাজারের সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ততা বেড়েছে। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রসারের ফলেই ২০২১ সালের মধ্যে এদেশ হবে মধ্যম আয়ের দেশ। ২০৪১ সালের মধ্যে হবে উন্নত দেশ।
×