ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

২০২০ সালে হবিগঞ্জ হারিয়েছে তিন গুণীজনকে

প্রকাশিত: ২১:২৬, ৩১ ডিসেম্বর ২০২০

২০২০ সালে হবিগঞ্জ হারিয়েছে তিন গুণীজনকে

নিজস্ব সংবাদদাতা, হবিগঞ্জ ॥ ২০২০ সালে হবিগঞ্জ থেকে তিনজন গুণী মানুষ বিদায় নিয়েছেন। এরা হলেন- মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সৈয়দ আফরোজ বখত, আল্লামা তাফাজ্জুল হক ও মহান মুক্তিযুদ্ধের একটি সেক্টর কমান্ডার মেজার জেনারেল (অবঃ) সিআর দত্ত। মেজর জেনারেল সিআর দত্ত মুক্তিযুদ্ধের চার নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) চিত্ত রঞ্জন দত্ত (সি আর দত্ত) বীর উত্তম গত ২৫ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৯টায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি আসামের শিলংয়ে তার জন্ম। পৈত্রিক বাড়ি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার মিরাশি গ্রামে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য চিত্ত রঞ্জন দত্ত বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত হন। এছাড়া ঢাকার কাঁটাবন থেকে কারওয়ানবাজার সিগন্যাল পর্যন্ত সড়কটি ‘বীরউত্তম সি আর দত্ত’ সড়ক নামে নামকরণ করা হয়। চিত্ত রঞ্জন দত্ত ১৯৭২ সালে রংপুরে ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন। সেখানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সীমান্ত রক্ষা প্রহরী গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সরকার। এই বিষয়ে চিত্ত রঞ্জন দত্তকে দায়িত্ব দেয় বাংলাদেশ সরকার। পরবর্তীকালে তিনি সীমান্ত রক্ষা প্রহরী গঠন করেন এবং নাম দেন বাংলাদেশ রাইফেলস। এখন এ বাহিনীর নাম বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। চিত্ত রঞ্জন দত্ত ছিলেন বাংলাদেশ রাইফেলসের প্রথম ডিরেক্টর জেনারেল। এছাড়া ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তাকে নানা ধরনের দায়িত্ব পালন করতে হয়। ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি হেড কোয়ার্টার চিফ অব লজিস্টিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। ১৯৭৯ সালে বি আর টি সির চেয়ারম্যান হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালনের পর ১৯৮২ সালে তিনি পুনরায় মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৯৮৪ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। আল্লামা তাফাজ্জুল হক আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী ছিলেন একজন ইসলামি পন্ডিত, রাজনীতিবিদ, হানাফি সুন্নি আলেম এবং সমাজ সংস্কারক। তিনি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সহ-সভাপতি ছিলেন। তিনি জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া উমেদনগরের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তার সম্মানে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভার মেইন রোড থেকে দক্ষিণমুখী বিরামচর-সাবাসপুর এলাকার রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে “হাফেজ তাফাজ্জল হক (রহ.) সড়ক। তাফাজ্জুল হক ১৯৩৮ সালে হবিগঞ্জ শহরের অদূরে কাটাখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আব্দুন নূর ছিলেন একজন আলেম। তার নানার নাম আল্লামা আসাদুল্লাহ, যিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ৫ ভাইয়ের মধ্যে তাফাজ্জুল হক বড়। মৃত্যুবরণ করেছেন ২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি। তাকে জামিয়া উমেদনগরের কবরস্থানে দাফন করা হয়। তিনি ১৯৬৭ সালে ময়মনসিংহের মাওলানা আরিফ রব্বানীর কন্যার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার ৫ ছেলে ও ৪ মেয়ে। হবিগঞ্জী প্রথমে মুফতি ফয়জুল্লাহর নিকট বায়আত হন। তার ইন্তেকালের পর সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার বৃহত্তর রেঙ্গা এলাকার আল্লামা বদরুল আলম (শায়খে রেঙ্গার) নিকট বায়আত হন। তিনি হুসাইন আহমদ মাদানীর ছাত্র ও খলিফা ছিলেন। দীর্ঘদিন রিয়াযত-মুজাহাদার পর শায়েখে রেঙ্গা তাকে ইজাযত ও খেলাফত দান করেন। তিনি জমিয়তে উলামায়তে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও হবিগঞ্জ জেলার সভাপতি ছিলেন। ২০১০ সালে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ গঠিত হলে এর সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সৈয়দ আফরোজ বখত হবিগঞ্জের প্রিয়মুখ ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক অ্যাডভোকেট সৈয়দ আফরোজ বখ্ত (৮৫) বুধবার (২৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে জেলা শহরের ইনাতাবাদের বাসা থেকে চিকিৎসার জন্য সিলেট যাওয়ার পথে তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, তিন ছেলে, এক মেয়েসহ অনেক গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। বৃহস্পতিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) সকালে বানিয়াচং উপজেলা করচা গ্রামে জানাজার নামাজ শেষে পারিবারিক কবরস্থানে এ ভাষা সৈনিককে দাফন করা হয়। জানা গেছে, ১৯৩৫ সালে জন্ম নেওয়া অ্যাডভোকেট সৈয়দ আফরোজ বখ্ত সুশিক্ষা গ্রহণ করে নিজেকে দেশসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। ভূমিকা পালন করেন ভাষা আন্দোলনে। মহান মুক্তিযুদ্ধেও তার বিরাট অবদান রয়েছে। তিনি একজন ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। সাদা মনের এ মানুষটি মূলত ঢাকায় আইন পেশায় যুক্ত হন ১৯৬৬ সালে। আর ১৯৬৭ সালে হবিগঞ্জে এসে এ পেশায় কাজ শুরু করেন। তারপর থেকে অতি সুনামের সঙ্গে স্থায়ীভাবে হবিগঞ্জে এ পেশায় কাজ করে আসছিলেন। এ হিসাবে ২০১৮ সালে আইন পেশায় তাঁর ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছিল। এ পেশার ৫২ বছরে এসে তিনি মারা গেছেন। সাবেক এমপি কেয়া চৌধুরী বলেন, ‘শৈশব থেকে পিতৃতুল্য সাদামনের এ বরেণ্য ব্যক্তিকে দেখে আসছি। যার মধ্যে কোনদিন দেখিনি লোভ-লালসা। তিনি আইন পেশায় থেকে তৃণমূল মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। যার বর্ণাঢ্য জীবন সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। তিনি আমাদের মাঝে আর নেই। মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে।’
×