ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আগামীর প্রত্যাশা এবং বৈশ্বিক ভাবনা

প্রকাশিত: ২০:৫৫, ১ জানুয়ারি ২০২১

আগামীর প্রত্যাশা এবং বৈশ্বিক ভাবনা

নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে ২০২০ সাল প্রকৃতির নিয়মেই অতিক্রান্ত হলো। আলোচনা-সমালোচনার উপচে পড়া ঢেউয়ের বছরটি মানব হৃদয়ে বহুমাত্রিক রেখা অঙ্কন করে দিয়েছে। আনন্দ-বেদনার সমন্বিত ভাবনায় কখনও অস্থির কখনও স্বস্তির পরিবেশকে আলিঙ্গন করেই চলতে হয়েছে মানব সমাজকে। বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসে প্রায় বিপর্যস্ত বিশ্বসভ্যতা। সারা বিশ্বে এ পর্যন্ত ১৭ লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে অচেনা এ রোগটি। ৫ কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। প্রতিদিনই মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে নতুন মানুষ। সংক্রমণের গতিও প্রবাহমান। এখন আবার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন দেশ ভ্যাকসিনও আবিষ্কার করেছে। ভ্যাকসিন সরবরাহের ব্যাপকতা লাভ করবে কবে তা সঠিক করে এখনও জানা যায়নি। করোনাকেন্দ্রিক রাজনীতি, অর্থনীতি, দুর্নীতির সমান্তরাল অবস্থা থেকে মানবজাতি কি শিক্ষা পেল, তা প্রমাণ হবে আগামীতে। অর্থনীতিকে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে কোভিড-১৯ জনজীবনকে তছনছ করে দিয়েছে। থমকে গেছে জীবনের গতিপ্রবাহ। অসংখ্য মানুষ চাকরি হারা হয়েছে, কর্ম হারিয়েছে। ওখঙ এর তথ্যমতে সারা পৃথিবীতে প্রায় ১৯ কোটি ৫০ লাখ লোক কর্ম হারিয়েছে। এর মধ্যে এশিয়ায় ১২ কোটি ৫০ লাখ, ইউরোপে ১ কোটি ২০ লাখ, আমেরিকায় ২ কোটি ৫০ লাখ, আফ্রিকা মহাদেশে ৩ কোটির মতো, মধ্যপ্রাচ্যে ৫০ লাখ সম্পূর্ণরূপে কর্মহীন হয়েছে। শতকরা হিসাবে সারা পৃথিবীতে ৬.৭% লোক বেকারত্বের অভিশাপে অভিশপ্ত হয়েছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ে আরও কর্মহীন হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এদিকে বাংলাদেশে প্রায় ৩ কোটি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে অবস্থান করার সম্ভাবনা রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। উল্লেখ্য, করোনায় শিক্ষা ব্যবস্থাকে একেবারে পঙ্গু করে দিয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে গত মার্চ থেকে। অনলাইনে যতটুকু শিক্ষা দেয়া হচ্ছে তা শিক্ষার নামে বাণিজ্যকেই আবৃত করেছে, যা দুঃখজনক। করোনার পাশাপাশি বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমফান ও দীর্ঘস্থায়ী বন্যা ছোবল মেরেছে। তবে করোনার এসব দুর্যোগ মোকাবেলা করে অর্থনীতির গতিপ্রবাহকে অনেকটাই সবল রাখতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশ কোভিড-১৯ কেন্দ্রিক সীমাহীন কেলেঙ্কারির চিত্র জনমনে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে মাস্ক কেলেঙ্কারি, ভুয়া টেস্ট এবং স্বাস্থ্য সরঞ্জামাদি ক্রয়ে দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র দেশের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। তবে এটাও ঠিক আমাদের স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসা বিজ্ঞানী অনেকেই মানবসেবার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। ফ্রন্টলাইনের করোনা যোদ্ধা কেউ কেউ সেবা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণও করেছেন। শতাধিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীও করোনায় প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। তাদের এই ত্যাগ চিরস্মরণীয়। করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী প্রত্যেক সেক্টরে প্রণোদনা দিয়েছেন। তৃণমূল পর্যায়ে আর্থিক অনুদানসহ নানারকম সহযোগিতা দিয়ে দূরদর্শী প্রজ্ঞায় প্রজ্ঞায়িত করেছেন দেশবাসীকে। দেশ ও জাতির প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ভালবাসা উচ্চাদর্শে মণ্ডিত হয়েছে। তিনি আমাদের মাতৃ অঙ্কে লালন করে জাতিকে কৃতার্থ করেছেন। দ্বিতীয় দফা করোনা ঢেউ উঁকি মারার সঙ্গে সঙ্গে আবারও প্রণোদনা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন মানবতার জননী শেখ হাসিনা। এদিকে বৈশ্বিক রাজনীতি নতুন ভাবনার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। মাঠের রাজনীতির বদলে ভার্চুয়াল রাজনীতি আত্মস্থ করতে হচ্ছে। গত নবেম্বরের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ছিল বিস্ময়কর ঘটনা। রিপাবলিকান প্রার্থী চলমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো-বাইডেনের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোট তৈরি করেছে নতুন ইতিহাস। ভোটে জো-বাইডেনের বিজয়কে ট্রাম্প মেনে না নিয়ে আদালতের আশ্রয় নিয়ে নতুন নাটকের জন্ম দিয়েছেন। ট্রাম্পের অরাজনৈতিকসুলভ আচরণ বিশ্বে হাসির খোরাক জুগিয়েছে। এখন ট্রাম্প সামরিক শাসনেরও হুমকি দিচ্ছে, যা মার্কিন গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত বেমানান। বিশ্বের শক্তিধর দেশ যুক্তরাষ্ট্র সারা পৃথিবীকেই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করে। গণতন্ত্রের ঐতিহ্য বহনকারী দেশটি তার মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখতে ব্যর্থ হবে কি-না, এ প্রশ্ন সামনে আসছে। তা ছাড়া করোনা মহামারী নিয়েও ট্রাম্পের নানারকম মন্তব্যে বিস্মিত হয়েছে বিশ্ববাসী। আরও একটি ঘটনা অবাক করেছে বাংলাদেশের মানুষকে, পুরনো অজানা বিষয় সামনে এসেছে। তা হচ্ছে- বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের নিয়ে মেরি এ্যান্ড বিউটিনিয়েসের মন্তব্য। বিউটিনিয়েস বাংলাদেশের সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ১৪ মাসের জন্য তিনি রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আমার পছন্দ কিন্তু রাজনীতিবিদগণ পছন্দের নয়। রাজনীতিবিদগণ তার কাছে নেতৃত্ব শক্তিশালীকরণে তদবির করতেন, যা হাস্যকর মনে হতো।’ ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে দেয়া সাক্ষাতকারে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিকদের ব্যক্তিত্ব ও দক্ষতা নিয়েও নানা কথা বলেছেন। এর আগের মার্কিন রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাস তার কাছে (বিউটিনিয়েস) বলেছিলেন, বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মানেই রাজা বনে যাওয়া। এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার। তাই রাজনীতিকদের জ্ঞানচর্চায় আত্মনিয়োগ করতে হবে। জ্ঞান ও প্রজ্ঞা বিকশিত হলে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কেউ প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। এখানে তৃতীয় পক্ষ কারও খবরদারি বরদাস্ত করা উচিত নয়। যা হোক, পুরনো অব্যবস্থাপনা অস্বচ্ছতা ভুলে তেজোদীপ্ত দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের। পদ্মা সেতু যেখানে নিজস্ব অর্থায়নে করতে সক্ষম আমরা সেখানে পেছনে তাকাবার সুযোগ কোথায়? আমরা বীরের জাতি। যে দেশে বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতার জন্ম হয়, শেখ হাসিনার মতো দৃঢ়চেতা নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে, অর্থনৈতিক সূচকে অগ্রসর হতে সক্ষম হয়, সে দেশের আবার ভয় কী? আগামীতে আমরা চাই স্বতঃস্ফূর্ত স্বাভাবিক জীবন। সমগ্র মানবজাতির জন্য স্বাভাবিক সুন্দর জীবনের প্রত্যাশা। আধুনিককালে কোন সমস্যাই এখন আর কোন দেশের একক কোন সমস্যা ভাবা ঠিক নয়। পৃথিবীটা গ্লোবাল ভিলেজ। বহুত্ববাদ মতবাদ আজ সর্বস্বীকৃত। এই মতবাদের ভিত্তিতে গোটা পৃথিবীকে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। বিশ্ব মানবতা প্রতিষ্ঠিত হোক। আগামীর বিশ্ব হোক শান্তিময়, ঐশ্বর্যময় ও সংস্কৃতিময়। বিশ্ব নেতারা এমন এক অঙ্গীকারে আবদ্ধ হোক, কেউ কারও ওপর প্রভাব বিস্তার করবে না। কেননা, বর্তমান সভ্যতার জগতে এককভাবে কোন দেশই চলতে পারবে না। পারস্পরিক নির্ভরতায় দেশগুলোকে অভিন্ন চেতনায় এগোতে হবে সম্মিলিতভাবে। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি, ধর্মের অপব্যবহার, পরধর্মের নিন্দাচর্চার অবসান ঘটুক। সত্য ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হোক। উন্নত ও সমৃদ্ধ মানব জাতি গঠনে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন অপরিহার্য। সারা বিশ্বের জন্যই এটা প্রযোজ্য। লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক [email protected]
×