ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘যুদ্ধের ভেতর দিয়ে নতুন একটি রাষ্ট্রের জন্ম...’

প্রকাশিত: ২২:৩৫, ৩১ ডিসেম্বর ২০২০

‘যুদ্ধের ভেতর দিয়ে নতুন একটি রাষ্ট্রের জন্ম...’

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ‘জয় বাংলা, জয় বাংলা’! ‘পদ্মা আর ব্রহ্মপুত্রের মতো বিশাল নদীর তীর, সবুজ প্রান্তর আর অসংখ্য গ্রামের অগণন চত্বর থেকে উঠেছে বাংলার এই বিজয় ধ্বনি। বাসের ছাদে চড়ে নাচতে নাচতে শহর প্রদক্ষিণ করছে উল্লসিত মানুষ। মুখে জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’। গোপন জায়গা থেকে লাল সবুজ আর সোনালি রঙের পতাকা বের করে ছাদে ছাদে লাগিয়ে দিয়েছে তারা। রাতারাতি ট্রাকের উইন্ডশিল্ড, ঘর-বাড়ি আর সাইন বোর্ডে শোভা পেতে লাগল কারাবন্দী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিশাল ছবি। ভারতীয় সৈন্যরা যশোর ও কুমিল্লা হয়ে একের পর এক ঢাকার উপকণ্ঠে হাজির হলে উৎফুল্ল শিশুর দল উঠে বসল তাদের ট্রাকে। ভারতীয় সৈন্যদের সর্বত্র মুক্তিদাতা হিসেবে অভিনন্দন জানাচ্ছে বাঙালীরা। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী মিত্রবাহিনীর কাছে রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এর তিনদিন পর ২০ডিসেম্বর বিজয়ের খবর প্রকাশিত হয় প্রভাবশালী গণমাধ্যম ‘টাইম’ সাময়িকীতে। খবরের শিরোনাম ছিল ‘যুদ্ধের ভেতর দিয়ে একটি জাতির জন্ম’। সেই খবরে এভাবেই উঠে আসে বাংলাদেশের জন্মের বিজয়গাথা। ১৬ ডিসেম্বর থেকেই একে একে বিজয়ের খবর স্থান পেতে থাকে ভারতসহ বিশে^র বিভিন্ন প্রভাবশালী সব গণমাধ্যমে। টাইম সাময়িকীতে প্রকাশিত খবরে আরও বলা হয়, ‘এভাবেই গত সপ্তাহে চলমান এক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নিলো নতুন এক রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’। এ পর্যন্ত কেবলমাত্র ভারত, ভুটান আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে, বিশে^র ১৪৮টি দেশের মধ্যে জনসংখ্যার বিচারে সাত কোটি ৮০লাখ নিয়ে তাদের অবস্থান কিন্তু অষ্টম। আগের সাতটি দেশ হচ্ছে চীন, ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়া, জাপান ও ব্রাজিল। তাছাড়া তাদের সামনে গুরুতর জটিলতার আবর্তে পড়তে পারে দেশটি। পরাজয় ও বিচ্ছিন্নতার প্রেক্ষাপটে পশ্চিম পাকিস্তানে যে রাজনৈতিক তোলপাড় হবে, তা চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়। ইসলামাবাদ দু’সপ্তাহ আগে অন্তত আটটি ভারতীয় বিমান ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালানোর পর পাকিস্তানের পূর্বাংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াটা কার্যত নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল একথা উল্লেখ করে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ‘প্রবল পরাক্রমের সঙ্গে পাল্টা জবাব দিয়ে ভারতীয় বিমানবাহিনী দু’দিনের মধ্যে পূর্ব অংশের পাকিস্তানী বিমানবাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়, যার মাধ্যমে আকাশে ভারতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গোপসাগর এবং গাঙ্গেয় দ্বীপ অঞ্চলেও ভারতের নৌবাহিনীর একচ্ছত্র প্রাধান্য আসে। চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরে ভারতীয় অবরোধ পাকিস্তানী বাহিনীর সকল রি-ইনফোর্সমেন্ট, রসদ সরবরাহ ও পশ্চাদপসরণের পথ বন্ধ করে দেয়। পাকিস্তানীরা সংখ্যায় ভারতীয় বাহিনীর কাছে নগণ্য হয়ে পড়ে; ভারতের দুই লাখের বিপরীতে মাত্র ৮০হাজার। পশ্চিম অংশের নিজস্ব ঘাঁটি থেকে এক হাজারের বেশি মাইল দূরবর্তী এক ছিটমহলে আটকা পড়ে তারা’। ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তানের ১৪শ’ মাইল সীমান্তে আরও বেশি প্রচণ্ড ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে একথা উল্লেখ করে খবরে বলা হয়, এরমধ্যে ছিল পাঞ্জাবের সমতল এবং দক্ষিণের মরুভূমিতে ট্যাংক লড়াই। ঐ সীমান্তে দু’দেশের বাহিনী মোট প্রায় আড়াই লাখ সৈন্য মোতায়েন করেছে। সীমান্ত এলাকা থেকে বেসামরিক নাগরিকরা পালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া করাচী, রাওয়ালপিন্ডি ও ইসলামাবাদের বেসামরিক অধিবাসীরা ভারতীয় বিমানের দিবারাত্রি হানায় চরম আতঙ্কের মধ্যে অবরুদ্ধ দিন কাটাচ্ছে। জাতিসংঘ যুদ্ধ বন্ধের জন্য তার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, কিন্তু তার এই সাধ্যমতোটা আসলে যথেষ্ট ছিল না। তিনদিনের পদ্ধতিগত টানাহেঁচড়া আর নিস্ফল আলোচনার পর নিরাপত্তা পরিষদে সোভিয়েত ভেটোর কারণে প্রস্তাব পাস হওয়া আটকে গেল। নিরাপত্তা পরিষদ যদিও বাগাড়ম্বরপূর্ণ এবং কম কার্যকর সাধারণ পরিষদের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে দিলো। সেখানে অবিলম্বে যুদ্ধ বিরতি ও সীমান্ত থেকে ভারত ও পাকিস্তানের নিজ নিজ সৈন্য ফিরিয়ে নেয়ার আহ্বান সংবলিত একটি প্রস্তাব দ্রুতই ১০৪-১১ ভোটে বিপুলভাবে পাস হলো। এর প্রেক্ষিতে পাকিস্তানীরা বলল, ভারত মানলে তারা যুদ্ধ বিরতি মানবে। ইতোমধ্যেই পাকিস্তানী সৈন্যরা পশ্চাদপসরণ করছিল। অন্যদিকে অদূরেই বিজয়ের সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে ভারত বলল, তারা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ‘বিবেচনা করছে’। তার অর্থ দাঁড়ায় পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তারা যুদ্ধবিরতি বিলম্বিত করতে চাইবে। সাধারণ পরিষদের হাতে তার প্রস্তাব কার্যকর করার কোন উপায় নেই। মজার ব্যাপার হলো, নিজেরা মানতে না চাইলেও জাতিসংঘের প্রস্তাবকে সম্মান দেখানোর নৈতিক দায়িত্বের কথা তুলে, এই ভারতই বিভিন্ন দেশকে নসিহত করে গেছে। ভারতের মদদদাতা সোভিয়েত ইউনিয়ন ইসরাইলকে জাতিসংঘের প্রস্তাব মান্য করার জন্য তাগিদ দিতে কখনই পিছপা হয়নি। অসম্ভব কাজ ॥ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যাই হোক না কেন, যুদ্ধবিরতি পূর্বাঞ্চলের সামরিক পরিস্থিতির কোন রদবদল ঘটাবে বলে মনে হয় না। গত সপ্তাহের শেষদিকে ভারতীয় পদাতিক সৈন্যদের ঢাকায় ২৫ মাইলের মধ্যে পৌঁছে যাওয়ার এবং রাজধানীর প্রান্তে পাঁচ হাজার প্যারাট্রুপার নামতে যাচ্ছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়ায়, পাকিস্তানী বাহিনীর মরন কামড়ের ভয়ে হাজার হাজার লোক পালিয়ে গেছে। ভারতীয় বিমানগুলো ঢাকা,করাচী ও ইসলামাবাদের বিমানবন্দরে প্রতিদিনই কখনও ঘণ্টায় ঘণ্টায় হামলা চালাচ্ছে...। ‘...হতোদ্যম ও বিশৃঙ্খল পাকিস্তানীদের বেতারযোগে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয়েছে। ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল শ্যাম মানেকশর ওই ঘোষণা বারংবার প্রচারিত হচ্ছে। সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে যদি পালানোর চেষ্টা করেন, তাহলে আপনাদের সামনে রয়েছে নিশ্চিত মৃত্যু’। তিনি পাকিস্তানীদের আশ^াস দিয়ে বলেন, ‘আত্মসমর্পণ করলে তাদেরকে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধবন্দী হিসেবে গণ্য করা হবে। মুক্তিবাহিনীও যাতে জেনেভা কনভেনশন মেনে চলে সেটা নিশ্চিত করতে ভারত স্থানীয় স্বাধীনতাযোদ্ধাদেরকে তাদের সামরিক কমান্ডের অধীনে ন্যস্ত করেছে। পাকিস্তানী সৈন্যরা ব্যাপক সংঘাতেই আত্মসমর্পণ করেছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে অন্য অনেকেই নাকি গ্রামের দিকে পালিয়ে যাচ্ছে; হয়ত সামরিক লোক সেজে পালানোর সুযোগ খুঁজছে। একজন ভারতীয় মুখপাত্র বলেন, কিছু গ্যারিসন শহরে তারা শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। আর সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করতে চাইলেও জেনারেলরা তাদেরকে বলছে : সময় নাও। বড় কিছু ঘটে যেতে পারে। মাটি কামড়ে থাকো।’ ব্যঙ্গ করে মুখপাত্রটি বললেন, একমাত্র বড় যে ঘটনা ঘটতে পারে, তা হলো পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কমান্ডাররা গা ঢাকা দিতে পারে সহসাই। এদিকে গোটা সপ্তাহজুড়ে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ভারতের সঙ্গে রণদামামা অব্যাহত বাজিয়ে গেছে। একজন কর্নেল জোর দিয়ে বললেন, যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তানের কোন ক্ষতি হয়নি। তার যুক্তি, ‘জিহাদের পথে কারো মৃত্যু হয় না, বরং সে অমরত্ব লাভ করে।’ পাকিস্তানের রেডিও-টেলিভিশনে, ‘সমগ্র পাকিস্তান জেগে উঠেছে’ এবং ‘শহীদের রক্ত কখনও বৃথা যাবে না’ জাতীয় দেশাত্মবোধক সঙ্গীত নিরন্তর বেজে চলার পাশাপাশি তাদের প্রোপাগান্ডার মধ্যে ছিল যুদ্ধ পরিস্থিতির সম্পূর্ণ অসম্ভব এক চিত্র। এক পর্যায়ে সরকারী মুখপাত্ররা দাবি করেন, পাকিস্তান ১২৩টি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করেছে। আর হারিয়েছে মাত্র সাতটি। এই হিসাবে ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষয়ক্ষতির অনুপাত প্রায় ১৮ ঃ ১ দাঁড়ায়, যা একেবারেই অসম্ভব। যশোর মুক্ত হওয়ার ঘণ্টাকয়েক পরেই সাংবাদিকরা সেখানে প্রবেশ করলেও ইসলামাবাদ বলছে, পাকিস্তানী বাহিনী এখনও শহরটি দখলে রেখেছে। তবে গত সপ্তাহের শেষদিকে আভাস মিলে যে, প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের সরকার, সম্ভবত দেশবাসীকে এ সত্যি কথাটা বলার জন্য তৈরি হচ্ছে যে- পাকিস্তানী বিমানবাহিনী আর পূর্ব পাকিস্তানে সক্রিয় নয়। তিনি বলেন, পাকিস্তানী বাহিনী অপেক্ষাকৃত বেশি শক্তিশালী শত্রুবাহিনীর কাছে কোণঠাসা। মুখপাত্রটি আরও বলেন, ভারতীয় সৈন্য ও অস্ত্র, সরঞ্জামের সংখ্যা পাকিস্তানের ছয়গুণ বেশি, যা দৃশ্যত খানিকটা অতিরঞ্জিত...। রাষ্ট্রীয়ভাবে বিজয় দিবস উদযাপনের দিন ঢাকার নিজ বাসায় অবস্থান করছিলেন ইতিহাসবিদ ড. ফিরোজ মাহমুদ। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমার এখনও মনে আছে, ওই বিজয় দিবস নিয়ে সারাদেশের মানুষ উদ্বেলিত ছিল। খুব উত্তেজনার মধ্য দিয়ে গিয়েছি আমরা। আগেরদিন থেকেই রেডিও চালু করা ছিল। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার জাগরণী গানগুলো বাজছিল। আমরা পরদিন সকাল থেকে সারাদিন টেলিভিশনে চোখ রেখেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের গান- কবিতা-কথিকা ইত্যাদি সেদিন প্রচার করা হয়। বন্ধুরাষ্ট্র ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোতে ফলাও করে বিজয়ের খবর প্রকাশ করা হয়। আবেগ, অনুভূতি আর প্রেম দিয়ে গড়া প্রতিবেদনগুলোর প্রায় প্রতিটিতেই ছিল নির্যাতনের শিকার হওয়া বাংলাদেশের মানুষের বিজয়ের এক অসাধারণ সাফল্যগাথা। ১৭ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার বাংলাদেশের বিজয়ের খবরটিকে প্রধান শিরোনাম করে। ‘পাকিস্তান হার মানল, নিয়াজীর বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ’ শিরোনামে পত্রিকাটি লেখেÑ ‘বাংলাদেশে দখলদার পাক ফৌজ বৃহস্পতিবার আত্মসমর্পণ করেছে। এবং আত্মসমর্পণ করেছে বিনাশর্তে। ঐ ফৌজের সর্বাধিনায়ক লে. জে. নিয়াজী আত্মসমর্পণের শর্তাদি নিয়ে আলোচনার জন্য ইস্টার্ন কমান্ডের অধ্যক্ষ মে. জেনারেল জেকবকে ঢাকায় যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। জেনারেল জেকব তদনুযায়ী বৃহস্পতিবার সকালেই হেলিকপ্টারে ঢাকা রওনা হয়ে যান। এই সম্পর্কে নয়াদিল্লী থেকে প্রকাশিত এক সরকারী ঘোষণায় বলা হয়েছে : জেনারেল মানেকশ আত্মসমর্পণের যে আহ্বান জানিয়েছিলেন, আজ সকালে লে. জে. নিয়াজী তাতে সাড়া দেন। এই সংবাদে আরও জানানো হয়, জেনারেল মানেকশ আত্মসমর্পণের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা।’ একই দিন কলকাতা থেকে প্রকাশিত যুগান্তর পত্রিকার প্রধান শিরোনাম ছিল ‘নিয়াজীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ’। রিপোর্টে ভারতীয়দের আবেগ তুলে ধরে লেখা হয়, ‘পাক দখলদার বাহিনীর বিনাশর্তে আত্মসমর্পণের কথা প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী লোকসভায় ঘোষণা করেন এবং রাজ্যসভায় এই কথা ঘোষণা করেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রী জগজীবন রাম। বিকেল সাড়ে পাঁচটার সময় উভয়কক্ষে একই সঙ্গে এই ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই উভয়কক্ষ উল্লাসে ফেটে পড়ে এবং নির্দিষ্ট সময়সূচীর বাইরেও তারা অধিবেশন চালিয়ে যান।’ যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত বিশ্বের প্রভাবশালী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয়ের খবরটি মূল সংবাদ করে। শিরোনাম ছিল, ‘ওঘউওঅ ঙজউঊজঝ ঈঊঅঝঊ-ঋওজঊ ঙঘ ইঙঞঐ ঋজঙঘঞঝ অঋঞঊজ চঅকওঝঞঅঘওঝ ঝটজজঊঘউঊজ ওঘ ঞঐঊ ঊঅঝঞ.’ সংবাদের সঙ্গে চুক্তিতে স্বাক্ষররত নিয়াজী ও অরোরার ঐতিহাসিক ছবিটি সংযুক্ত করা হয়। দেশটির বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রও বাংলাদেশের যুদ্ধ জয়ের খবর প্রকাশ করে। দৈনিক নেভানডা স্ট্যাট জার্নালের ১৭ ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রধান সংবাদ হয়ে আসে বাংলাদেশ। পত্রিকাটির প্রথম পাতায় বেশ কয়েকটি সংবাদ পরিবেশন করা হয়। বাংলাদেশের বিজয়ের খবরটি দেয়া হয় দইধহমষধফবংয ঢ়ৎড়পষধরসবফ ধং হধঃরড়হ’ শিরোনামে। উল্লেখযোগ্য দৈনিক ‘দি সল্টলেক ট্রিবিউন’র প্রধান সংবাদ ছিল দওহফরধহং ঊহঃবৎ উধপপধ, ঊীঃবহফ ঞৎঁপব ঃড় ডবংঃ’. আমেরিকার কোন কোন পত্রিকায় ১৬ ডিসেম্বরই চলে আসে খবরটি। তেমন একটি পত্রিকার নাম ‘দি ইভিনিং স্টার।’ এর প্রথম পাতায় বাংলাদেশের বিজয়ের খবর চমৎকার একটি ছবিসহ প্রকাশিত হয়। ছবিতে দেখা যায়, যুদ্ধ জয়ী এক তরুণ অস্ত্র উঁচিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে। তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে পত্রিকাটি বলছে, ‘এ ভিক্টোরিয়াস ফ্রিডম ফাইটার।’ ছবির নিচে বড় করে লেখা রয়েছেÑ জয় বাংলা। এভাবে বিজয়ের শুভক্ষণে সারা দুনিয়ার গণমাধ্যম যেন অভিনন্দিত করে বিজয়ী বাংলাদেশকে। ১৯৭১ সালের ২৫মার্চ যখন পাকিস্তানী সেনারা রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে আক্রমণ করেছিল সেদিন পুলিশ প্রতিরোধ যোদ্ধাদের একজন আবু সামা। বর্তমানে কিশোরগঞ্জে অবস্থানরত অবসরপ্রাপ্ত এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, বিজয় ছিল আমাদের সকলের কাছে খুবই কাক্সিক্ষত, প্রত্যাশার। এই দিনটির জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে আমরা সবাই মাঠে স্বাধীনতাবিরোধীদের মোকাবেলা করেছি। যখন শুনেছি আমারা বিজয়ের দিকে যাচ্ছি তখন রাতভর ঘুম হতো না। পাকিস্তানী সেনারা আত্মসমর্পণের খবর দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে যাওয়ার পর সাধারণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের দেখলে মুখে মিষ্টি তুলে দিত। যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার দ্য ফিলাডেলফিয়া এনকোয়রা প্রথম পাতা, ভেতরের পাতার প্রায় পুরোটাসহ মোট খবর প্রকাশ করে সাতটি। সল ফ্রিডম্যানের লেখায় বাংলাদেশের বিজয়ের খবরটি উঠে আসে। ভেতরের পুরো একটি পাতাজুড়ে বাংলাদেশ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে ফ্লোরিডার দ্য মায়ামি হেরাল্ড। টেনেসি অঙ্গরাজ্যের কিংস্পোর্ট নিউজ ‘বাংলাদেশ: নিজেদের নতুন রাষ্ট্র’ শিরোনামের একটি সংবাদ প্রকাশ করে। এ ছাড়া টেনেসির দ্য ডেইলি হেরাল্ড, ওয়াইওমিং থেকে প্রকাশিত ক্যাসপার স্টার ট্রিবিউন, ক্যালিফোর্নিয়ার সান্টা মারিয়া টাইমস, ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশিত পোর্ট অ্যাঞ্জেলেস ইভিনিং নিউজ, ফোর্ট ওয়ার্থ স্টার টেলিগ্রাম একটি করে সংবাদ প্রকাশ করে। মিশিগানের আয়রনউড ডেইলি গ্লোব ও উইসকনসিনের ওয়াকিসা ডেইলি ফ্রিম্যান দুটি করে সংবাদ প্রকাশ করে। পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর যুক্তরাষ্ট্রের ২২টি দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয় বাংলাদেশের মুক্তির যুদ্ধজয়ের সংবাদ। বাঙালীর মুক্তির যুদ্ধ বিজয়ের পরদিন মার্কিন সাংবাদিক কিস বিচ লিখলেন, ‘আজন্ম বঞ্চিত পূর্ব পাকিস্তান আর নেই’। বাংলাদেশের অনলাইন ডিজিটাইজড আর্কাইভ মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর যুক্তরাষ্ট্রের ২২টি দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদগুলো। ১৭ ডিসেম্বর খবর এসেছে ২০টিতে। বাকি দুটিতে এসেছে ২০ ও ২২ ডিসেম্বর। মোট ৪৫টি শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। এর মধ্যে ৭টি সংবাদপত্র বাংলাদেশের খবর ছেপেছিল সেদিনের প্রধান সংবাদ হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের কেনোসা নিউজ পত্রিকায় ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘এখন সেখানে সত্যিই এক বাংলাদেশ’। ‘বাংলাদেশ’ একটি বাস্তবতা শিরোনামে প্রকাশ করে টেকসাসের ব্রাউনউড বুলেটিন নামের আরেকটি সংবাদপত্র। ...ভারতের স্থানীয় সময় বেলা ১১টায় ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’তে ঘোষণা করা হয়- বাংলাদেশকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ভারত। ভারতের পার্লামেন্টের বিশেষ অধিবেশনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের প্রস্তাব উত্থাপন করে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, বাংলাদেশের সব মানুষের ঐক্যবদ্ধ বিদ্রোহ এবং সেই সংগ্রামের সাফল্য এটা ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট করে তুলেছে যে, তথাকথিত মাতৃরাষ্ট্র পাকিস্তান বাংলাদেশের মানুষকে স্বীয় নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে আনতে সম্পূর্ণ অসমর্থ। স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে বিশাল বাধার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রাম এক নতুন অধ্যায় রচনা করেছে। সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করার পর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার বক্তব্য শেষ না হতেই ভারতের সংসদ সদস্যরা হর্ষধ্বনি আর ‘জয় বাংলাদেশ’ ধ্বনিতে ফেটে পড়েন। এরপর একে একে মেলে বিশ্ব স্বীকৃতি। পূর্ব জার্মানি, মঙ্গোলিয়া বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি, পোল্যান্ড স্বীকৃতি দেয় ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি, বুলগেরিয়া স্বীকৃতি দেয় ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি, মিয়ানমার স্বীকৃতি দেয় ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি, নেপাল ১৬ জানুয়ারি, বার্বাডোস ২০ জানুয়ারি। যুগোস্লাভিয়া (সার্বিয়া) বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি, টোঙ্গা ২৪ জানুয়ারি, সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া) ২৪ জানুয়ারি, অস্ট্রেলিয়া ৩১ জানুয়ারি, নিউজিল্যান্ড ৩১ জানুয়ারি, ব্রিটেন ৪ ফেব্রুয়ারি, জাপান ১০ ফেব্রুয়ারি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭২ সালের ৪ এপ্রিল। এভাবে বিশ্বের দেশগুলো একে একে স্বীকৃতি দিতে থাকে বাংলাদেশকে।
×