ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিষাক্ত পানি ॥ হুমকিতে জলজপ্রাণী

প্রকাশিত: ২১:১৭, ৩১ ডিসেম্বর ২০২০

বিষাক্ত পানি ॥ হুমকিতে জলজপ্রাণী

স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট অফিস ॥ ভারতের মেঘালয় রাজ্যের লুখা নদীর বিষাক্ত পানি বাংলাদেশে লুভাছড়া নদী দিয়ে সুরমা নদীতে প্রবেশ করার ফলে নদীর মাছসহ জলজপ্রাণী হুমকির মুখে পড়েছে। প্রতিবছরের মতোই এ বছরও মেঘালয়ের পূর্ব জয়ন্তীয়া পাহাড়ে লুভা তথা লুখা নদীর জল পুরো নীল হয়ে গেছে। সেখান থেকে আট কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে সোনাপুরের কাছে লুভা নদী বাংলাদেশে ঢুকে লুভাছড়া নাম নিয়ে সিলেট জেলার সুরমা নদীতে এসে পড়েছে। লুভার বিষাক্ত পানি সুরমা নদীতে মিশে বিপন্ন প্রজাতির গোয়ালপাড়া লোচ মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। মেঘালয় সরকার এই সমস্যার সমাধানে কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি। কেন এভাবে নদীর পানির রং বদলে যায়- তার কারণও নির্দিষ্ট করে জানাতে পারেনি। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায় ২০০৪ সাল ও ২০০৬ সালে সেখানে দু’টি সুবৃহৎ সিমেন্ট কারখানা স্থাপন করা হয়। এরপরেই ২০০৭ সাল থেকে লুভার পানি নীল হতে থাকে। থাংস্কাই ও লামস্নং এলাকায় থাকা চুনাপাথর খনি, সিমেন্ট কারখানা ও কয়লা খনিগুলোই নদীর পানির রং বদলের জন্য দায়ী। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, পানিতে অম্লতা বেশি। ক্যালসিয়াম ও সালফেটের মাত্রাও বেশি। এই অবস্থা চলতে থাকলে গোয়ালপাড়া লোচ মাছসহ আরও অনেক জলজ প্রাণীই লুভা-সুরমা থেকে হারিয়ে যাবে। গোয়ালপাড়া লোচ মাছটি আগে লুভাছড়া ও সুরমা নদীতে প্রচুর পরিমাণে দেখা যেত। কিন্তু পানির চরিত্র বদল, বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হওয়ার জেরে সেই মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। লুভার পানির রং বদলের সঙ্গে পানির চরিত্রও বদলে যায়। পানি বিষাক্ত হয়ে ওঠে। জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ অক্সিজেন পায় না। শুধু লুভাই নয়, মেঘালয়ের মিন্ত্রা নদীও জোয়াইয়ের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে লামু ও উমসিয়ারিং নামে পাহাড়ি দু’টি নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে জৈন্তাপুর লালাখাল দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে সারি নদী নামে প্রবাহিত হয়েছে। সেটিও পরে সুরমা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। মিন্ত্রার পানির দূষণ ও রাসায়নিকও সুরমায় মিশে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) ‘রেড লিস্ট অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মেঘালয়ের পূর্ব জৈন্তিয়া পার্বত্য জেলার থাংস্কাই ও লুমশনং অঞ্চলের চুনাপাথরের খনি ও সিমেন্ট কারখানার নিষ্কাশিত বর্জ্যরে কারণে শীতের সময় নদীটির পানি গাঢ় নীল বর্ণ ধারণ করে। লুখা নদীর পানি দূষণে জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর ধ্বংসের জন্য ‘টপসেম সিমেন্ট’ ও ‘স্টার সিমেন্ট’ নামের দুটি সিমেন্ট কারখানাকে দায়ী করা হয়। এ দুটি প্রতিষ্ঠানই মেঘালয়ের পূর্ব জৈন্তিয়া পার্বত্য জেলার বৃহৎ সিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। টপসেম সিমেন্টের উৎপাদনকেন্দ্র থাংস্কাইয়ের নিকট আমদহে, খনি অবস্থিত দক্ষিণ খলিয়াজড়িতে। স্টার সিমেন্টের কারখানা অবস্থিত লুমশনং-এ। জানা গেছে, ২০০৭ সাল থেকেই নদীর পানি নীল হওয়া শুরু করে। ২০০৪ সালে স্টার সিমেন্ট এ অঞ্চলে উৎপাদন শুরু করে, টপসেম সিমেন্ট শুরু করে ২০০৬ সালে। সিলেটের লুভাছড়া নদীতে বিগত বছরগুলোতে গোয়ালপাড়া লোচ মাছের দেখা মেলেনি। এ মাছটি প্রায় ৩.৬ সে.মি. দৈর্ঘ্যরে হয়ে থাকে। মাছটির বিলুপ্তি বাংলাদেশের জন্য বড় ক্ষতির কারণ। আইইউসিএন এর প্রতিবেদনে জানা গেছে, বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলার সুসং দুর্গাপুরের সোমেশ্বরী নদীতে ২০০৯ সালের ২৫ মার্চ শেষবারের মতো মাছটির দেখা মেলে। মাছটির আবাসস্থলের হুমকি বিবেচনায় মাছটি একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আইইউসিএন। বাংলাদেশের পরিবেশ সংরক্ষণবাদীরা জানিয়েছেন, লুভাছড়া নদীর বিষাক্ত পানি ছাড়াও কানাইঘাটের বৃহৎ পাথর খনিও গোয়ালপাড়া লোচ মাছের বিলুপ্তির আরেকটি কারণ হতে পারে।
×