ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শাহরিয়ার কবির

বিচারপতি কে এম সোবহান মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনের ধ্রুবতারা

প্রকাশিত: ২১:০৫, ৩১ ডিসেম্বর ২০২০

বিচারপতি কে এম সোবহান মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনের ধ্রুবতারা

২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী সংক্রমিত করোনা মহামারীর মহাছোবল বাংলাদেশকেও রেহাই দেয়নি। ফেব্রুয়ারি থেকে আরম্ভ করে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে এই ভয়ঙ্কর মহামারীতে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় সাড়ে সাত হাজার, যাদের ভেতর দেশের খ্যাতিমান শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী এবং আমাদের মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী নাগরিক আন্দোলনের পুরোগামী নেতৃবৃন্দও আছেন। ১৯৯২ সালে আমরা শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের দাবিতে যে অভূতপূর্ব নাগরিক আন্দোলনের সূচনা করেছিলাম, তাদের অন্যতম ছিলেন বিচারপতি কে এম সোবহান, যিনি ২০০৭-এর ৩১ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেছেন। আজ তাঁর ত্রয়োদশ মৃত্যুবার্ষিকী। যদিও তিনি পরিণত বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন- দেশের যে কোন সঙ্কট মুহূর্তে তার অভাব আজও আমরা প্রচণ্ডভাবে অনুভব করি। মুক্তিযুদ্ধের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনের জন্য যে সংস্থা স্থাপন করেছিলেন তার সার্বিক দায়িত্ব বিচারপতি কে এম সোবহানকেই তিনি অর্পণ করেছিলেন। তখন থেকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক দোসরদের নজিরবিহীন গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ তাকে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করেছে, যে কারণে পরবর্তীকালে এদের বিচারের দাবিতে তিনি সর্বদা ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। ১৯৮৪ সালে সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতির দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণের পরই নিজেকে তিনি যুক্ত করেন মানবাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে। সেই সময় সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের যে কোন মিছিলের পুরোভাগে তাঁকে দেখেছি। জেনারেল এরশাদ যখন সংবিধানের ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন তার তীব্র প্রতিবাদ করেছিল এদেশের সচেতন নাগরিক সমাজ। বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজের তথাকথিত ইসলামীকরণের প্রতিবাদে আমরা ১৯৮৮ সালেই গঠন করেছিলাম ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী নাগরিক কমিটি।’ বিচারপতি কে এম সোবহান ছিলেন ১০০১ সদস্যবিশিষ্ট এই নাগরিক কমিটির সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য। আমরা তখন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কয়েকটি সমাবেশ করেছি, রাজপথে মিছিল করেছি, এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে মামলাও করেছি। তিনি ছিলেন আমাদের অন্যতম পথপ্রদর্শক। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে আমরা ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠনের মাধ্যমে গণআদালতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারের কর্মসূচী ঘোষণা করি। তিনি ছিলেন নির্মূল কমিটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৯৩ সালে কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের দুষ্কর্ম অনুসন্ধানের জন্য বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল ‘জাতীয় গণতদন্ত কমিশন।’ বিচারপতি কে এম সোবহান ছিলেন এই কমিশনের প্রাণপুরুষ। ১৯৯৪ ও ১৯৯৫ সালে ‘জাতীয় গণতদন্ত কমিশন’ দুই দফায় ’৭১-এর ১৫ জন শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীর দুষ্কর্মের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় রমনা কালী মন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞের তদন্তের জন্য ২৭ মার্চ ২০০০ তারিখে বিচারপতি কে এম সোবহানের নেতৃত্বে আরেকটি গণতদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিল। এই কমিশন একটানা ছয় মাস বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার শতাধিক ব্যক্তি, ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞের ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দী নথিবদ্ধ করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। ২০০১ সালের ১-২ জুন আমরা ঢাকায় মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দক্ষিণ এশীয় সম্মেলনের আয়োজন করেছিলাম। এই সম্মেলনের বিভিন্ন অধিবেশনে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের শতাধিক বরেণ্য নাগরিক বক্তব্য উপস্থাপন করেন। বিচারপতি কে এম সোবহান ছিলেন এই সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা। সম্মেলনের একটি কর্ম অধিবেশনের বিষয় ছিল ‘মৌলবাদ ও যুদ্ধাপরাধ।’ এই অধিবেশনের প্রধান বক্তা ছিলেন বিচারপতি কে এম সোবহান। পাকিস্তানের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও মানবাধিকার নেতা এয়ার মার্শাল (অব) আসগর খান এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলেন। আলোচকদের ভেতর ছিলেন পাকিস্তানের প্রাক্তন আমলা এ্যাডভোকেট আলমদার রাজা, সাংবাদিক এম বি নাকভি ও কবি আহমেদ সেলিম, ভারতের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব) বিনোদ সায়গল, নেপালের সাংবাদিক যুবনাথ লামসাল, শ্রীলঙ্কার মানবাধিকার নেতা এস বালাকৃষ্ণন এবং বাংলাদেশের প্রাক্তন সচিব কূটনীতিক ওয়ালিউর রহমান। সম্মেলনের শেষে গঠিত হয় ‘মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলন’ এবং বিচারপতি কে এম সোবহান পাঁচ দেশীয় এই সংগঠনের অন্যতম সভাপতি নির্বাচিত হন। দীর্ঘ দুই দশক তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। বহু নাগরিক উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম আমরা। মানবাধিকার লংঘনের বিরুদ্ধে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং মৌলবাদ সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের আন্দোলনে, ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক সমাজ গড়ার আন্দোলনে যখনই যে কাজের দায়িত্ব তাঁর উপর অর্পণ করা হয়েছে তিনি নির্দ্বিধায় তা পালন করেছেন নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে। সংবিধান কিংবা কোন আইনের ব্যাখ্যার জন্য যখনই তাঁর শরণাপন্ন হয়েছি তিনি আমাদের শিক্ষকের পরম ধৈর্য নিয়ে বুঝিয়েছেন, আমাদের উপলব্ধির অস্বচ্ছতা দূর করেছেন। ২০০৪ সালে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি তাঁকে ‘জাহানারা ইমাম স্মৃতি পদক’ প্রদান করে। সরকার না করলেও বহু সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন তাঁকে পুরস্কৃত করেছে। ২০০৬ সালে ‘জাহানারা ইমাম স্মারক বক্তৃতা’ প্রদানের জন্য তাঁকে নির্বাচন করা হয়। তাঁর বক্তৃতার শিরোনাম ছিল ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং বাংলাদেশের সংবিধান।’ এই বক্তৃতার উপসংহারে তিনি লিখেছিলেন ‘বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশে যুদ্ধ হচ্ছে। তার সঙ্গে ঘটছে যুদ্ধাপরাধ। বিশ্ব বিবেক এখন জাগ্রত এই যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য হেগে এখন আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত গঠিত হয়েছে এবং তা সক্রিয়। বাংলাদেশও এই আদালত সম্পর্কে সমর্থনসূচক স্বাক্ষর করেছে। এ আদালতে ইউগোস্তাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মিলোসভিচের বিচার হয়েছে। লাইবেরিয়ার চার্লস ক্লার্ক শীঘ্রই এই আদালতের সামনে হাজির হবে। চিলিতে পিনোচেটের মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য নিজ দেশে বিচার হতে যাচ্ছে। বিশ্ববিবেক বর্তমানে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ প্রভৃতির বিরুদ্ধে অনেক বেশি সংবেদনশীল এবং সোচ্চার। ‘আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি শহীদ জননী জাহানারা ইমাম যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে গণআদালত গঠন এবং গণতদন্ত কমিশন গঠন করে তাদের যে শাস্তির ব্যবস্থা করেছিলেন তা অদূর ভবিষ্যতে বাস্তবায়িত হবে এ দেশের বিশেষ আদালতে। তাদের ঐ সব অপরাধের বিচার নিশ্চয়ই হবে।’ বাংলাদেশে নিরীহ ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং আহমদীয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক দোসরদের ধারাবাহিক হামলা, নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিচারপতি কে এম সোবহান সব সময় সোচ্চার ছিলেন। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, ছুটে গেছেন উপদ্রুত এলাকায় শুধু রাজধানী বা বড় বড় শহরে নয়, প্রত্যন্ত অঞ্চলের দুর্গম জনপদেও। অসহায়, আক্রান্ত মানুষের প্রচণ্ড ভরসা ও সাহসের অবলম্বন ছিলেন বিচারপতি কে এম সোবহান। ২০০১ থেকে ২০০৬ খালেদা-নিজামীদের চার দলীয় জোটের সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের সকল আন্দোলন ও সংগ্রামে তিনি ছিলেন অকুতোভয় সেনাপতি। একবার প্রচণ্ড রোদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানব বন্ধনে দাঁড়িয়ে জ্ঞান হারিয়ে তিনি আমার পাশেই রাস্তায় ঢলে পড়েছেন। তুলে ধরে হাসপাতালে নিয়ে গেছি, হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে আবার মিছিলে যোগ দিয়েছেন তিনি। ২০০৫ সালের ১৭ জুন লন্ডনে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রবীণ সদস্য সর্বদলীয় মানবাধিকার কমিটির উপপ্রধান লর্ড এরিক এভবরির উদ্যোগে বাংলাদেশে মানবাধিকারের ওপর ইউরোপীয় সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। এই সম্মেলনে বাংলাদেশের বারো সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিচারপতি কে এম সোবহান। সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে তিনি ভাষণ দিয়েছেন, একটি কর্ম অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছেন, অপর একটিতে আলোচক হিসেবে অংশগ্রহণ করেছেন এবং সম্মেলনের ঘোষণা রচনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বিদেশে মানবাধিকার বিষয়ক বহু আন্তর্জাতিক সম্মেলন, সেমিনার ও কর্মশালায় তার উজ্জ্বল উপস্থিতি এবং পান্ডিত্যপূর্ণ বক্তব্য বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে। ৮৪ বছর দক্ষিণ এশিয়ার হিসেবে পরিণত বয়স হলেও তাঁর মৃত্যু আমাদের আন্দোলনে এক বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। বিশেষভাবে এই করোনা মহামারীকালেও দেশের সর্বত্র ওয়াজ ও ইসলামী জলসার নামে করোনার চেয়ে ভয়ঙ্কর ধর্মব্যবসায়ী ওয়াজকারীরা যেভাবে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙ্গার হুমকি দিচ্ছে, যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, চেতনা এবং ৩০ লাখ শহীদের রক্তে লেখা সংবিধান লাঞ্ছিত করছে- এ দুঃসময়ে তাঁর মতো সাহসী নেতৃত্বের অভাব তীব্রভাবে অনুভব করছি। তাঁর মৃত্যুতে জাতি হারিয়েছে এক মহান কৃতী সন্তানকে, আমরা হয়েছি অভিভাবকশূন্য। বাংলাদেশের নির্যাতিত, অধিকারবঞ্চিত অসহায় মানুষের পাশে তিনি আর সাহস ও সমবেদনার আলোকবর্তিকা হয়ে দাঁড়াবেন না। আমরা তাঁর উত্তরসূরী ধর্ম-বর্ণ-জাতিসত্তা নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা আদায় না করা পর্যন্ত, যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত রাজপথ ছেড়ে যাব না। আমাদের চলার পথে তিনি চিরকাল অফুরন্ত প্রেরণা হয়ে উজ্জ্বল ধ্রুবতারার মতো বিরাজ করবেন। ২০২১ সালে আমরা আশা করি করোনা মহামারীর বিস্তার রোধ করতে সক্ষম হব। একইভাবে আশা করব করোনা ভাইরাসের চেয়ে ভয়ঙ্কর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিনাশী মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার ভাইরাস প্রতিহতকরণের ক্ষেত্রে সরকার ও জনগণ সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। ২০২১ সাল হোক শান্তি ও মানবতার অগ্রযাত্রার বছর। ৩০ ডিসেম্বর ২০২০
×