ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তিন হাজার টাকার জন্য সাইফুলকে এক থাপ্পড়ে হত্যা করে আসামিরা

প্রকাশিত: ২২:৫১, ৩০ ডিসেম্বর ২০২০

তিন হাজার টাকার জন্য সাইফুলকে এক থাপ্পড়ে হত্যা করে আসামিরা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ মাত্র এক থাপ্পড়ে সাইফুল নামের এক যুবক হত্যার সেই আলোচিত ঘটনার রহস্য উদঘাটিত হয়েছে। পাওনা তিন হাজার টাকার জন্য ওই যুবককে হত্যা করা হয়। পাওনা টাকা দিতে না পারায় পাওনাদার কানে প্রচণ্ড জোরে থাপ্পড় দিলে কান ফেঁটে রক্ত বেরিয়ে তার মৃত্যু হয়। এ নিয়ে এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল। টানা দুই বছরের তদন্ত শেষে চাঞ্চল্যকর সেই হত্যার রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআই। গ্রেফতার হয়েছে দুই খুনী। দুই খুনী ছাড়াও হত্যার প্রত্যক্ষদর্শী চার সাক্ষী আদালতে সাইফুল হত্যার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীও দিয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের খুনের মামলার তথ্য মোতাবেক, ২০১৮ সালের ১২ ডিসেম্বর হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটে। ওইদিন দুপুর একটার দিকে কিশোরগঞ্জ সদরের যশোদল ইউনিয়নের সিদ্দেশ্বরী এলাকার ইব্রাহীমের অটোবাইকের গ্যারেজের সামনে থেকে সাইফুল (৩৫) এক যুবককে টেনে হিচড়ে নিয়ে যায় কিছু লোক। সাইফুলকে গ্যারেজের ভেতরে নিয়ে মুখ ও ঘাড়সহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত করে। এরমধ্যে একজন কান বরাবর জোরে একটি থাপ্পড় মারে। এক চড়ে সাইফুল অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। সাইফুলকে কিশোরগঞ্জ আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে সাইফুলকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে ভর্তির পাঁচ মিনিট পরেই চিকিৎসকরা রাত নয়টায় তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পোস্টমর্টেমে চিকিৎসকদের দেয়া মতামত মোতাবেক, থাপ্পড়ের কারণে কানের ভেতরে মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হয়। আর তাতেই সাইফুলের মৃত্যু হয়েছে। এ ব্যাপারে ২০১৮ সালের ১৩ ডিসেম্বর সাইফুলের পিতা খুরশীদ উদ্দিন (৬৫) বাদী হয়ে কিশোরগঞ্জ মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা নম্বর-২৪। কি কারণে কে বা কারা সাইফুলকে হত্যা করল তার কোন হদিস মিলছিল না। এমনকি মামলায় কাউকে আসামিও করা হয়নি। কিশোরগঞ্জ মডেল থানার এসআই মোঃ মাসুদুর রহমান মামলাটির তদন্ত করেন। প্রায় সাড়ে চার মাস তিনি তদন্ত করেন। তদন্ত শেষে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে ফাইনাল বা চূড়ান্ত চার্জশীট দাখিল করেন। এমন চার্জশীটের বিরুদ্ধে আপত্তি করেন মামলার বাদী। বাদীর নারাজী আবেদনের কারণে আদালত মামলাটির তদন্তভার পিবিআই কিশোরগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপারকে দায়িত্ব দেন। পিবিআইয়ের কিশোরগঞ্জ জেলার বিশেষ পুলিশ সুপার মোঃ শাহাদাত হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় পিবিআইয়ের উপ-পরিদর্শক পঙ্কজ কুমার আর্চাযকে। তিনি প্রায় এক বছর তদন্ত করেন। এরপর তার বদলি হলে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয় পিবিআইয়ের উপ-পরিদর্শক মোঃ হারুন অর রশিদ চৌধুরীকে। তদন্তকারী কর্মকর্তা মোঃ হারুন অর রশিদ চৌধুরী জনকণ্ঠকে জানান, মামলার তদন্তের ধারাবাহিকতায় জানা যায় নিহত সাইফুলের পিতা ও মামলার বাদী মোঃ খুরশীদ উদ্দিন (৬০)। তার পিতার নাম আব্দুস সাত্তার। বাড়ি কিশোরগঞ্জ সদরের স্বল্প যশোদল খাসপাড়া গ্রামে। তদন্তের এক পর্যায়ে বেরিয়ে আসতে থাকে সাইফুল হত্যার আসল রহস্য। সেই তথ্যের সূত্রধরে চলতি বছরের ৬ সেপ্টেম্বর ওই এলাকার হাফিজ উদ্দিনের ছেলে মোঃ আব্দুর রহমান ওরফে সুমনে (৩২) গ্রেফতার করা হয়। তার দেয়া তথ্য মোতাবেক প্রায় এক মাস পর চলতি বছরের ৪ সেপ্টেম্বর কিশোরগঞ্জ সদরের যশোদল কোনামাটি এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় মোঃ হাফিজ উদ্দিন ও মোঃ ইব্রাহিম খলিলকে (২৭)। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে দুইজন মোঃ আব্দুর রহমান ওরফে সুমন ও মোঃ ইব্রাহিম খলিল আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দী দেয়। এমনকি হত্যার সময় চারজন প্রত্যক্ষদর্শীর নামও তারা প্রকাশ করে। পরে ওই চার স্বাক্ষীও আদালতে হত্যার দৃশ্য দেখার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দী দেয়। জবানবন্দীর বরাত দিয়ে পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার জনকণ্ঠকে জানান, নিহত সাইফুল ইসলাম ও আসামি সুমন পূর্বপরিচিত। পরিচয়ের সূত্র ধরে সাইফুল ইসলাম তিন হাজার টাকা সুমনের কাছ থেকে ধার হিসেবে নেয়। ধার নেয়া টাকা সময় মতো পরিশোধ করতে পারছিল না সাইফুল। টাকা পরিশোধ করতে না পেরে সাইফুল লজ্জায় সুমনের সঙ্গে যোগাযোগ কিছুটা কমিয়ে দেয়। সুমন তার চাচাতো ভাই ইব্রাহিমের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে। ঘটনার দিন দুপুর ১২টার দিকে সাইফুল হেটে পাওনাদার সুমনের চাচাতো ভাই ইব্রাহিমের গ্যারেজের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। এ সময় ইব্রাহিম চাচাতো ভাই সুমনের পাওনা টাকার জন্য সাইফুলকে আটকায়। আটকিয়ে পাওনা তিন হাজার টাকা দাবি করে। সাইফুল টাকা দিতে দেরি হওয়ার কারণে দুঃখ প্রকাশ করে দ্রুত টাকা পরিশোধ করবে বলে আশ্বাস দেয়। ইতোপূর্বেও এমন বেশ কয়েকটি টাকা দেয়ার তারিখ পার হয়। এজন্য ক্ষিপ্ত হয়ে ইব্রাহিম শার্টের কলার ধরে সাইফুলকে টেনে হিচড়ে গ্যারেজে নিয়ে যায়। ইব্রাহিম ফোন করে সুমনকে ডেকে আনে। সুমন ৮-১০ মিনিটের মধ্যে ইব্রাহিমের দোকানে যায়। সুমন কারও কোন কথা না শুনে সাইফুলের বাম ও ডান কানে ঘুষি, চড় থাপ্পড় দিতে থাকে। এ সময় আদালতে জবানবন্দী দেয়া চার সাক্ষীর অনুরোধে সুমন মারধর বন্ধ করে। সুমনের বেপরোয়া মারধরের কারণে দয়া করে সাক্ষী হানিফ দোকানদার তার পরিচিত জামালের কাছ থেকে ১৫শ’ টাকা ধার নিয়ে সুমনকে দেয়। হানিফ বাকি ১৫শ’ টাকা ৩-৪ দিনের মধ্যে পরিশোধ করার আশ্বাস দেন। এরপর সাইফুলকে ছেড়ে দেয় সুমন ও ইব্রাহীম। এদিকে মারধরের কারণে সাইফুল অজ্ঞান হয়ে ইব্রাহিমের গ্যারেজেই পড়ে যায়। হানিফ রিক্সায় করে সাইফুলকে বাড়ি পৌঁছে দেয়। বাড়িতে যাওয়ার পরেও জ্ঞান না ফিরলে প্রথমে কিশোরগঞ্জ আধুনিক সদর হাসপাতালে এবং পরে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই সাইফুল মারা যায়।
×