ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ব গণমাধ্যম (১০)

‘বাংলার বুদ্ধিজীবীদের লাশ ডোবায় পড়ে আছে’

প্রকাশিত: ২২:৩৭, ৩০ ডিসেম্বর ২০২০

‘বাংলার বুদ্ধিজীবীদের লাশ ডোবায় পড়ে আছে’

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় আত্মসমর্পণ করার আগে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী রাজধানীতে তখনও বেঁচে থাকা বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ৫০ জনেরও বেশিকে গ্রেফতার করে গুলি করে হত্যা করে। বিশিষ্ট বাঙালী নাগরিকদের নিশ্চিহ্ন করার এক সুচিন্তিত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ঝটিকা সামরিক অপারেশন চালিয়ে এ কাজটি করা হয়। কাজেই কমান্ডিং অফিসার জেনারেল নিয়াজীসহ পাকিস্তানী হাইকমান্ড এ ব্যাপারে অবগত ছিল। বুদ্ধিজীবীদের এই লাশ পাওয়ার ঘটনা ঢাকাতে উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলবে। এতে প্রতিশোধমূলক হত্যা ও দাঙ্গার সম্ভাবনা বাড়তে পারে। এমনকি মুক্তি বাহিনী গেরিলা ও ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে’। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বিজয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করতে পরিকল্পিতভাবে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে পাকিস্তানী হায়নার দল ও তাদের এ দেশীয় দোসররা। এ ঘটনা শেষ পর্যন্ত চাপা থাকেনি। ১৪ ডিসেম্বরের পর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এভাবেই ওঠে আসে পাক সেনাদের বর্বরতার চিত্র। যা গোটা বিশ^বাসীকে আরেকবার বিস্মিত করেছিল। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম নিউজউইকে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ঢাকা থেকে নিকোলাস টোমালিন এই প্রতিবেদন পাঠান। প্রকাশিত খবরের শিরোনাম ছিল, ‘বাংলার বুদ্ধিজীবীদের লাশ ডোবায় পড়ে আছে...’। মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ফজলুল কাদের কাদেরীর মূল সংগ্রহ ও সম্পাদিত বাংলাদেশ জেনোসাইড এ্যান্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস গ্রন্থ সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। গ্রন্থটি বাংলা অনুবাদ সম্পাদনা করেছেন দাউদ হোসেন। প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ‘হত্যাকাণ্ডের শিকার বুদ্ধিজীবীদের লাশগুলো পাওয়া যায় নগরীর উপকণ্ঠের রায়েরবাজারে এক ডোবায়। আমি নিজে সেখানে ৩৫টি লাশ দেখেছি। পচনশীল লাশগুলো দেখে মনে হয় চার থেকে পাঁচদিন আগে তাদের হত্যা করা হয়েছে। তবে আরও অনেককেই হয়তো এভাবে হত্যা করা হয়েছে। অপহরণের খবর অনুযায়ী অনেকেই ধারণা করছেন, নিহতের সংখ্যা ১৫০ পর্যন্ত হতে পারে।’ ইউপিআইর খবরে বলা হয়, ‘নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের প্রধান কার্ডিওলজিস্ট ডাঃ ফজলে রাব্বী এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ড. মুনীর চৌধুরী। হত্যাকাণ্ডের স্থানটির অবস্থান ঢাকার মধ্যবিত্তদের আবাসিক এলাকা ধানমণ্ডি ছাড়িয়ে একটি ইটের ভাঁটিতে। ডোবার মধ্যে ফুটে থাকা কচুরিপানার ফুলের শোভা সত্ত্বেও জায়গাটা অদ্ভুত রকমের বিরান। ঢাকার শত শত লোক জায়গাটা দেখতে আসেন। তাদের অনেকেই নিজেদের আপনজনদের খুঁজছিলেন’। সরেজমিন এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘সম্ভবত গত মঙ্গলবার ভোরে এদেরকে অপহরণ করা হয়। পাঞ্জাবী সৈন্যদের স্কোয়াড ঠিকানা ধরে ধরে হানা দেয় এবং সশস্ত্র পাহাড়ায় আটককৃত নারী পুরুষদের নিয়ে যায়। তাদের সম্ভবত রায়ের বাজার ইট ভাঁটিতেই নিয়ে গিয়ে তাৎক্ষণিক গুলি করা হয়। লাশগুলো যাতে ডোবায় পড়ে, সেজন্য তাদের মাটির তৈরি গর্তের ধারে লাইন করিয়ে গুলি করা হয়। বুদ্ধিজীবীদের লাশগুলো এখনও সেখানে পড়ে আছে। পচতে শুরু করা তাদের শরীরে জমেছে ধুলোর স্তর। বাঁধের ওপর এক জায়গায় বেওয়ারিশ কুকুরের টেনে তোলা এক কঙ্কালের নগ্নতা চোখকে ধাক্কা মারছিল’ হত্যাযজ্ঞের স্থানটির বিবরণ তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘অদ্ভুত আর শান্ত এক ভঙ্গিতে জনতা ডোবাগুলো ঘুরে দেখছিল। এখানে তাদের বিক্ষুব্ধ মনে হচ্ছে না। অন্যত্র তারা ছিল উদ্দাম। কিন্তু এখানে তারা ধীরপদে হাঁটছে, কথা বলছে অস্ফুটস্বরে, যেন কোন ক্যাথিড্রালে আসা টুরিস্টের মতো’। ‘একটা ডোবায় দেখা গেলো বেশ বড়সড় ভিড়। সেখানে লাশের স্তূপটা সবচেয়ে বড়। ডোবার পাশে একজন লোক আহাজারি করছিল। মাফলার দিয়ে মুখ চেপে আছে সে। তার কণ্ঠনিঃসৃত শব্দকে মোয়াজ্জিনের আযানের ধ্বনির মতো মনে হলো আমার কাছে। লোকটার কাছে তার পরিচয় জানতে চাইলাম আমরা। সে বলল তার নাম আবদুল মালেক, ঢাকার একজন ব্যবসায়ী। সামনের পানিতে পাশাপাশি পড়ে থাকা তার তিন ভাই বদরুজ্জামান, শাহজাহান এবং মুল্লুকজাহানের লাশ সে শনাক্ত করতে পেরেছে। আব্দুল মালেকের আর কোন ভাই নেই। মালেক বলল ‘মঙ্গলবার সকাল সাতটায় পাকিস্তানী সৈন্যরা ওদের ধরে নিয়ে যায়। কাকতালীয়ভাবেই আমি সেদিন একটু আগে উঠেই বাইরে গিয়েছিলাম’। এই পর্যায়ে আমার সঙ্গীটি কাঁদতে শুরু করল, সে ঢাকার এক ছাত্র। নাম নাজিউর রহমান। সেই আমাকে পথ দেখিয়ে এই ইটভাঁটিতে নিয়ে এসেছে। নাজিউর তার বোনের স্বামীকে খুঁজছিল। অক্সফোর্ডের পিএইচডিধারী ড. আমিনউদ্দীন বেঙ্গল রিসার্চ ল্যাবরেটরিজের প্রধান। মঙ্গলবার সকাল সাতটায় পাকিস্তানী সৈন্যরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর আর তাঁর খোঁজ পাওয়া যায়নি। রহমান বললো, ‘আমি দুঃখিত, আমাকে উনার খোঁজ করতে হবে এখন। তার মাফলারও এখন মুখে উঠে এসেছে’। প্রতিবেদনে ঢাকার সেদিনের চিত্র তুলে ধরা বলা হয়, ‘আমি গতকাল মাত্র তিন ঘণ্টা ঢাকায় ছিলাম। এ খবরটা তখনও ছড়ায়নি বললেই চলে। জনতাকে উত্তেজিত দেখাচ্ছিল।’ কিন্তু তারা ছিল বেশ সুশৃঙ্খল। তখনও তারা হাসিমুখে ভারতীয় সৈন্যদের হাত নেড়ে অভিনন্দন জানাচ্ছিল এবং ইতস্তত এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছিল। কিন্তু বেশকিছু গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে, বিশেষ করে রাতে। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে অবস্থানরত সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, পরিস্থিতি বিস্ফোরণমুখ। লোকজন অভিযোগ করছে যে, সীমান্তের ওপার থেকে আসা মুসলিম বিহারিরা বাঙালীদের হত্যা করতে পাকিস্তানী সৈন্যদের সাহায্য করছে। আট মাস আগে আমি যখন যশোরে ছিলাম তখন ঠিক এ কারণেই সেখানে এক দাঙ্গা বাধে এবং বেশকিছু বিহারিকে হত্যা করা হয়।’ ঢাকার বুদ্ধিবীজীদের এই হত্যাকাণ্ড নিঃসন্দেহে যশোরে যা ঘটেছিল, তার চেয়ে আরও অনেক খারাপ ব্যাপার। একথা উল্লেখ করে খবের বলা হয়, ‘কাজেই কিছু প্রতিশোধমূলক ঘটনা অনিবার্য। নানান গুজব-গুঞ্জন আর অন্য সাংবাদিকদের মুখে এ ধরনের প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ডের কথা শোনা ছাড়া আমি নিজে কেবল মুক্তিবাহিনীর দুজন তরুণের কথা বলতে পারি। তারা আমাকে গাড়ি চালিয়ে বিমানবন্দর পৌঁছে দিয়েছিল। পারভেজ মামা সালেক নামে তাদের একজন আমাকে গর্বভরে বলল আগের দিন সে বিহারি খুঁজে বেরিয়েছে’। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ ছিল, ‘আমরা হঠাৎ কিছু গুলির শব্দ শুনতে পাই। আগেই জানতে পেরেছিলাম এই বেজন্মা বিহারিরা আমাদের ছেলেদের হত্যা করছে। আমরা ওদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলি। স্টেন হাতে আমাদের দু’জন ওদের বাড়িতে ঢোকে।’ বিহারিরা বাগানের একটা গাছে গিয়ে ওঠেছিল। মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা ওদের কাকের মতো গুলি করে মারে। “অবশ্যই আমরা ওদের মেরেছি। ওরা এতদিন আমাদের মেরেছে”। বিজয় নিশ্চিত এমন আঁচ পেয়ে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠেছিল পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা। ১৪ ডিসেম্বর তারা বুদ্ধিজীবী নিধনে মেতে ওঠে। সেদিন যাদের তুলে নেয়া হয়েছিল তাদের একজন, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সার। স্ত্রী, সন্তানসহ পরিবারের লোকদের চোখের সামনে তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় ঘাতকরা। সেদিনের ঘটনা তুলে ধরে শহীদুল্লা কায়সারের স্ত্রী শহীদ জায়া অধ্যাপক পান্না কায়সার বলেন, একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় খালেক মজুমদারসহ কয়েকজন আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে যায়। খালেক শহীদুল্লাকে মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের হাতে তুলে দেয় বলেও স্বীকার করেছে। তিনি বলেন, রাজাকারদের অত্যাচার বেড়ে গেলে শহীদুল্লা কায়সার ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর বিজয়ের আগ মুহূর্তে নিরাপত্তার জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে যান। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই ফিরে আসেন। ১৪ ডিসেম্বর কার্ফিউ শিথিল না হওয়ায় শহীদুল্লা কায়সার বাড়িতেই থেকে যান। ওই দিন স্বামী তাঁকে একটি চিরকুট দেন। সেখানে লেখা ছিল, ‘পান্না, আমি যদি কোন দিন না থাকি, তাহলে তুমি সন্তানদের আমার আদর্শে মানুষ করবে।’ এটুকু পড়েই তিনি চিরকুটটি ছিঁড়ে ফেলে চিৎকার করে ওঠেন। পান্না কায়সার বলেন, ১৪ ডিসেম্বর বিকেলে বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি কয়েকজন যুবক আমাদের বাড়ি দেখিয়ে দিচ্ছেন। সন্ধ্যায় স্বামীর পাশে সোফায় ছয় মাস বয়সী ছেলে অমিতাভ কায়সার শুয়ে ছিল। তিনি মেঝেতে বসে দেড় বছরের মেয়ে শমী কায়সারকে ফিডারে দুধ খাওয়াচ্ছিলেন। এ সময় তাঁর দেবর ওবায়দুল্লাহ বলেন, দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হচ্ছে। কী করব? শহীদুল্লা কায়সার বলেন, মুক্তিযোদ্ধা এসেছে, দরজা খুলে দাও।’ এক-দুই মিনিট পর চার-পাঁচজন মুখবাঁধা আগন্তুক ঘরে এসে জানতে চায়, শহীদুল্লা কায়সার কে? শহীদুল্লা স্পষ্টভাবে নিজের পরিচয় দিলে আগন্তুকদের একজন ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। আমিও স্বামীর হাত ধরে টানতে থাকি। এ অবস্থায় বারান্দায় গেলে বাতি জ্বালাই। ননদ সাহানা এগিয়ে এলে আমরা দুজনে মিলে আগন্তুকদের একজনের মুখের কাপড় খুলে ফেলি। পরে অস্ত্রের মুখে তাঁরা শহীদুল্লাকে কাদামাখা একটি মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যায়। স্বামীর খোঁজে কোতোয়ালি থানায় টেলিফোন করলে এক পাকিস্তানী মেজর জানান, শহীদুল্লা তাদের কাছে আছে। জিজ্ঞাসাবাদ করে ফিরিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু ও ফিরে না এলে ১৬ ডিসেম্বর দেবর জাকারিয়া হাবিবকে নিয়ে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে যাই। সেখানে অনেক শহীদ পরিবারকে দেখতে পাই। বধ্যভূমির কাদা পানিতে অনেক খুঁজেও লাশ পাইনি। সেখানেই সিদ্ধান্ত নেই, শহীদুল্লা কায়সার অন্তরেই থাকবেন। পান্না কায়সার বলেন, স্বাধীন হওয়ার পর জহির রায়হান ফিরে এসে ভাইকে (শহীদুল্লা কায়সার) বিভিন্ন স্থানে খুঁজতে থাকেন। একপর্যায়ে এক ব্যক্তিকে তিনি বাড়িতে ধরে আনেন। আমি তাকে চিনতে পারি। স্বামীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় আমি ও সাহানা যে ব্যক্তির মুখের কাপড় খুলেছিলাম, তিনিই ওই ব্যক্তি। তার নাম খালেক মজুমদার। ওই সময় খালেক মজুমদার তাঁদের জানান, শহীদুল্লাকে ধরে নিয়ে মুঈনুদ্দীনের হাতে তুলে দিয়েছেন। ১৯৭২ সালে খালেক মজুমদারের বিচার শুরু হলে আদালতে খালেক বলেন, শহীদুল্লা কায়সারকে তিনি ধরে নিয়ে মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের হাতে তুলে দেন। বাংলাপিডিয়ার হিসাব বলছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় ১ হাজার ১১১ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানী বাহিনী। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল ঢাকায়। ১৪৯ জন। ইতিহাসবিদরা বলছেন, সংখ্যার দিক থেকে বিবেচনা না করে যদি জনসংখ্যা আর মৃত্যুর হার হিসেবে হিসাব করা হয় তাহলে অন্যান্য ঢাকার বাইরে জেলাগুলোতে আরও বেশি সংখ্যক বুদ্ধিজীবী মারা গেছেন। কিন্তু তাদের আসলে সেভাবে স্মরণ করা হয় না। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক আফসান চৌধুরী বলেন, ‘অন্যান্য এলাকায় যদি খেয়াল করেন তাহলে সেখানেও অনেক বড় সংখ্যায় মারা গেছে। আমাদের একটু তাদেরও স্মরণ করা উচিত। পুরো বিষয়টা একটু ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। এ নিয়ে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন, সুনির্দিষ্ট করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার যে পরিকল্পনা সেটি আলবদরদের হাতে তুলে দেয়া হয় জুন মাসের দিকে যখন এই বাহিনী গঠিত হয়। এরপর থেকে আলবদর বাহিনী এই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটিয়েছে এবং সঙ্গে অন্যরাও ছিল। ১৬ ডিসেম্বর এসে সবাই বুঝতে পারে যে আসলে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা হয়েছে। তিনি বলেন, ১৪ ডিসেম্বরটাকে করা হয়েছে এই কারণে যে, বিজয় দিবস হচ্ছে ১৬ ডিসেম্বর। ১৪ ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবী হত্যা হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ বা সরকার বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের যাদের ৫২ বা ৪৭ থেকে একটা বড় অবদান আছে মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত আন্দোলনের, তাদের সম্মান জানানোর জন্য। অধ্যাপক ড. আহমেদ আমিনুল ইসলাম তার এক লেখায় বলেছেন, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মহান মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের প্রাক্কালে ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর আলশামস বাহিনী বাঙালী জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হাজার হাজার বরেণ্য শিক্ষাবিদ, গবেষক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, চিকিৎসক, শিল্পী, কবি, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক ও সাহিত্যিককে রাতের অন্ধকারে চোখ বেঁধে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের ওপর নির্মম ও নিষ্ঠুর অত্যাচার চালিয়ে নারকীয়ভাবে হত্যা করা হয়। পাকিস্তানের দোসর এদেশীয় দালালচক্র যখন ক্রমশ উপলব্ধি করছিল যে, মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে পাকিস্তানিরা ছিন্নভিন্ন এবং তাদের পরাজয় অনিবার্য তখন তারা বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা করে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি মফিদুল হক এক লেখায় বলেছেন, ‘১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ যে বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে ঘর থেকে তুলে নিয়ে একত্রে হত্যা করা হয়েছে, সেটা তো জানা গেল বিজয় অর্জনের পর। তিন দিন খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকা ক্ষত-বিক্ষত অনেক লাশ শনাক্ত করা যায়নি। অনেকের লাশের কোন সন্ধান আর মেলেনি, হয়তো খুবলে খেয়েছে শকুন কিংবা কুকুর, কিংবা ফেলা হয়েছে আর কোন গর্তে, যা আর কেউ কখনও খুঁজে পায়নি।’ তিনি বলেন, দেশব্যাপী পরিচালিত নয় মাসের গণহত্যায় অগণিত মানুষের প্রাণদানের সীমাহীন ট্র্যাজেডিতে ভয়াবহ মাত্রা যোগ করেছিল বুদ্ধিজীবী হত্যা, যার কোন সামরিক কার্যকারণ ছিল না, তবে বাঙালী জাতির বিরুদ্ধে প্রবল আক্রোশ যে এখানে ফুটে উঠেছে, সেটা বুঝতে ভুল হওয়ার অবকাশ ছিল না। অচিরেই জানা গেল দুই ঘাতকের পরিচয়, চৌধুরী মঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খান এবং হন্তারক সংগঠন, ইসলামী ছাত্রসংঘের পরীক্ষিত সদস্যদের নিয়ে গঠিত আলবদর বাহিনী-সম্পর্কিত কিছু তথ্য। গবর্নর হাউসে প্রশাসনের প্রধান মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর ডেস্ক ডায়েরিতে পাওয়া গেল অনেক বুদ্ধিজীবীর নাম, কারও নামের পাশে আছে ক্রসচিহ্ন, কোথাও বা লেখা বাড়ির নম্বর, অথবা কোন মন্তব্য। নোটশিটের এক জায়গায় লেখা ছিল, ক্যাপ্টেন তাহির ব্যবস্থা করবে আলবদরদের গাড়ির। বুঝতে পারা যায়, সামরিক বাহিনী ও রাজনৈতিক শক্তির যোগসাজশ, কিন্তু এর পেছনের দর্শন ও তথাকথিত ধর্মাদর্শ বিচার-বিশ্লেষণ অনেকটা থেকে যায় আড়ালে...’।
×