ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

করোনা সঙ্কটেও সঞ্চয়ে ঝুঁকছে মানুষ

প্রকাশিত: ২১:০৮, ৩০ ডিসেম্বর ২০২০

করোনা সঙ্কটেও সঞ্চয়ে ঝুঁকছে মানুষ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ সঙ্কটের মধ্যেও বাড়ছে সঞ্চয়। নিরাপদ আগামী নিশ্চিত করতে সঞ্চয়পত্রে আবারও ঝুঁকছে মানুষ। সবশেষ একক মাস হিসেবে শুধু অক্টোবর মাসেই নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। চলতি বাজেটে সঞ্চয়পত্র কেনার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, ৪ মাসেই পূরণ হয়েছে তার সিংহভাগ। অন্যসব ক্ষেত্রে সুদের হার কমে গেছে। এজন্য নিরাপদ বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে সঞ্চয়পত্রে সাধারণ মানুষ ঝুঁকছে বলে মনে করেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, হঠাৎ করে ধারাবাহিকভাবে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের বড় উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। আগে কেনা হলেও, এখন রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ায় এই অঙ্ক বেড়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্য যে কোন সঞ্চয় প্রকল্পের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বেশি হওয়ায় এই দিকে ঝুঁকছে সবাই। করোনার কারণে আর্থিক টানাপড়েন তীব্র আকার ধারণ করেছে। কাজ হারিয়েছে বড় সংখ্যক মানুষ। তার মধ্যেও সঞ্চয়ের আকাক্সক্ষা তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ বাড়তি অর্থ হাতে থাকলেই কেনা হচ্ছে সঞ্চয়পত্র। করের হার বাড়িয়ে, কড়াকড়ি আরোপ করেও ‘সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ’ হিসেবে পরিচিত সঞ্চয়পত্রের বিক্রি ঠেকাতে পারছে না সরকার। চলতি অর্থবছরের প্রতিমাসেই বিক্রি বাড়ছে। এরই ধারাবাহিকতায় অর্থবছরের ৪ মাসে (জুলাই-অক্টোবর) নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি ১৫ হাজার ৬৪২ কোটি টাকা। এরমধ্যে শুধু অক্টোবরেই বিক্রি হয়েছে ৪ হাজার ৩৪ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র। জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের সবশেষ প্রতিবেদনে এ চিত্র পাওয়া গেছে। চলতি অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় ২০ হাজার কোটি টাকা। সঞ্চয় অধিদফতরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে ১৫ হাজার ৬৪২ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এই অঙ্ক গেল ২০১৯-২০ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে তিনগুণ বেশি। গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে ৫ হাজার ৫২০ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৩ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। আর আগস্টে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে ৪ হাজার ২০৭ কোটি টাকা। আর অক্টোবরে নিট বিক্রির পরিমাণ ৪ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এর আগে ২০১৯ সালের অক্টোবরে মাত্র ৮২৩ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। প্রতিবেদন অনুযায়ী, সর্বশেষ অক্টোবর মাসে মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৯ হাজার ২৫০ কোটি টাকার। সুদ-আসল বাবদ গ্রাহকদের শোধ করা হয়েছে ৫ হাজার ২১৫ কোটি টাকা। তাহলে নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। নিট বিক্রির মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে পরিবার সঞ্চয়পত্র। যার পরিমাণ ১ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা। ৩ মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৬২৩ কোটি টাকার। আর পেনশনার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ২২৯ কোটি টাকার। ৫ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৬০৮ কোটি টাকার। সঞ্চয় অধিদফতরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, কোভিড-১৯ মহামারীর ধাক্কা বাংলাদেশে লাগতে শুরু করার পর গত এপ্রিলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি তলানিতে নেমে আসে। ওই মাসে মোট ৬৬১ কোটি ৭৮ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। সুদ-আসল বাবদ শোধ করা হয় তার প্রায় দ্বিগুণ ১ হাজার ২৮৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। নিট বিক্রি ছিল ৬২১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এরপর মে মাসে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪৩০ কোটি ২৩ লাখ টাকা। গত অর্থবছরের শেষ মাসে জুনে মোট বিক্রি মে মাসের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেড়ে ৯ হাজার ৩২২ কোটি ৮০ লাখ টাকায় দাঁড়ায়। বিক্রির চাপ কমাতে গতবছরের ১ জুলাই থেকে সঞ্চয়পত্রে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। একইসঙ্গে ১ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) বাধ্যতামূলক করা হয়। ব্যাংক এ্যাকাউন্ট না থাকলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি না করার শর্ত আরোপসহ আরও কিছু কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ফলে কমতে শুরু করে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি। কিন্তু এখন তা আবার বাড়ছে। ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট ৬৭ হাজার ১২৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এরমধ্যে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ ৫২ হাজার ৬৯৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা শোধ করা হয়েছে। এ হিসাবে নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। সঞ্চয় অধিদফতর ২০২০-২১ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির মোট লক্ষ্য ধরেছে ৮৬ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে সুদ-আসল বাবদ শোধ করতে হবে ৬৬ হাজার ২৫৫ কোটি টাকা। নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়াবে ২০ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার এই ২০ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেবে।
×