সম্প্রতি সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ওবায়দুল কাদের সাহেবের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনোনয়ন নিয়ে মিডিয়ায় একটি বক্তব্য আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নেতাকর্মীদের মাঝে হতাশা, দলের তৃণমূলে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের সৃষ্টি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা এবং ফলশ্রুতিতে দলকে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল করতে পারে বলে আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ের অনেক নেতাকর্মী মনে করছেন। তিনি তার বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন যে, যারা অতীতে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করে বিজয়ী বা বিজীত হয়েছেন, আগামীতে যে কোন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন তারা পাবেন না। অতীত বলতে সুদূর অতীত নাকি নিকট অতীত বুঝিয়েছেন, সেটা পরিষ্কার হয়নি। কারণ, সুদূর অতীত হলে নির্বাচন করার মতো খুব বেশি যোগ্য প্রার্থী খুঁজে পাওয়া যাবে না। সমীক্ষায় দেখা যায় যে, ২০১৬ সালে মোট ৪১০৩টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রায় ১২ সহস্রাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী অংশগ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে নৌকা প্রতীক নিয়ে জয়লাভ করেন ২৬৬১ জন আর বিদ্রোহী ৮৯৮। অর্থাৎ, এক তৃতীয়াংশ বিদ্রোহী প্রার্থী জয়লাভ করেন। আর ২০১৯ সালে ৪৬৫টি উপজেলা নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে সরাসরি ভোটে জয়লাভ করেন ১৫৫ জন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন ১১০ জন। আর বিদ্রোহী প্রার্থী জয়লাভ করেন ১৩৬ জন। অর্থাৎ, সরাসরি ভোটে নৌকা প্রতীক প্রাপ্ত এবং বিদ্রোহী বিজয়ীদের অনুপাত প্রায় কাছাকাছি। দলের এই বিশাল বিদ্রোহী অংশ তৃণমূলে বর্তমানে শক্তিশালী অবস্থানে আছেন এবং দলীয় পদও অলঙ্কৃত করে আছেন। সাধারণ সম্পাদক সাহেবের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তৃণমূল পর্যায়ে এখন নতুন মেরুকরণ শুরু হবে আসন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে, যা কোনভাবেই কাম্য নয়। এখানে আরও উল্লেখ করা যেতে পারে যে, যেহেতু বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না, তাই সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেনÑ যেই জয়লাভ করবে দল তাকে স্বাগত জানাবে। এমন একটি বক্তব্য গত উপজেলা নির্বাচনের পূর্বে অনলাইন পত্রিকার মাধ্যমে নেতাকর্মীরা শুনতে পেয়েছিলেন এবং যার কোন প্রতিবাদ কেন্দ্র থেকে করা হয়নি। তথাপি পরবর্তীতে বিগত উপজেলা নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের কারণ দর্শাও নোটিস জারি করা হয়। সাধারণ সস্পাদক বলেছিলেন, যারা সদুত্তর দিতে পেরেছেন তাদের ক্ষমা প্রদান করা হয়েছে এই বলে যে, আগামীতে দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে তাদের আর ক্ষমা করা হবে না। অর্থাৎ, তাদের অতীত ভূমিকার জন্য সম্পূর্ণভাবে ক্ষমা করা হলো। প্রশ্ন হচ্ছে এই ক্ষমা প্রদর্শনের পরও যদি বক্তব্য আসে যে, তাদের আগামীতে কোন নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হবে না, তাহলে তৃণমূলের এই বিরাট অংশটি বিবেচনায় আনবে যে দলে তাদের জন্য সকল দরজা বন্ধ হয়ে গেল। নেতাকর্মী সকলেরই একটা স্বপ্ন থাকে যে, সে একদিন দলে তার কর্মদক্ষতার জন্য মূল্যায়িত হয়ে আরও বড় পদে আসীন হবেন। বর্তমান দেশের পরিস্থিতি যদি একটু গভীরে গিয়ে দেখা যায় তাহলে দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ যতই উন্নতির দিকে ধাবিত হোক, দল, সরকার ও দেশের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী পক্ষ (দেশীয় ও আন্তর্জাতিক) সক্রিয় এবং তারা বিভিন্নভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অসাংবিধানিক উপায়ে উৎখাত করার জন্য অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি খুন, ধর্ষণ, জাতির পিতার ভাস্কর্য ভাঙ্গার ধৃষ্টতা এসবই ষড়যন্ত্রের অংশমাত্র। এমন একটি অবস্থায় দলের ক্ষতি হয় এমন কোন সিদ্ধান্ত অথবা বক্তব্য এই মুহূর্তের দলকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
কি কারণে তৃণমূলে দলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে তার কিছু উদাহরণ তুলে ধরলাম। একজন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বয়স আনুমানিক ৯০ বছর, যিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, দলের উপজেলার শাখার সিনিয়ন সহ-সভাপতি এবং উক্ত এলাকায় আওয়ামী লীগের ঝান্ডা নিয়ে আজও রাজপথে বীর বিক্রমে দলের বিপদে আপদে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান হয়েছেন। এখন তার ভবিষ্যৎ কি? আরেকজন উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে লড়ে অল্প ভোটে পরাজিত হয়েছেন। যদিও স্থানীয় পর্যায়ে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ব্যালটের মাধ্যমে তিনি প্রার্থী হিসেবে সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছিলেন এবং উপজেলা কমিটি তার নাম সুপারিশ করে কেন্দ্রে প্রেরণ করেছিলেন, কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তিনি নোমিনেশন পাননি। সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যের পর এই ব্যক্তির অন্তরের রক্তক্ষরণ কে থামাবে? যিনি গত সংসদ নির্বাচনেও রাজপথে নৌকার জন্য জীবন বাজি রেখে কাজ করেছিলেন। এছাড়াও এমন অনেক সংসদ সদস্য আছেন যারা অতীতে দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র নির্বাচিত হয়ে পুনরায় দলে যোগদান করেছিলেন। সম্প্রতি একজন দলের সহযোগী সংগঠনে উচ্চপদে আসীন হয়েছেন, যিনি দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যের বিরুদ্ধে নির্বাচন করে দু’দুবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
ওপরে উল্লিখিত তিনটি বিষয় পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, একই ধরনের অপরাধে কেউ কেউ নোমিনেশন পাচ্ছেন না। আর কারও কারও ক্ষেত্রে বিদ্রোহী প্রার্থী প্রমোশনও পাচ্ছেন। এই দ্বৈতনীতি থেকে যদি আওয়ামী লীগ বের হয়ে আসতে না পারে, অতীতে যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন সে বিষয়ে দল যদি তার অবস্থান পরিষ্কার করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ভবিষ্যতে যদি খারাপ সময় আসে তাহলে রাজপথে লড়াই করার মতো নেতাকর্মী পাওয়া যাবে না।
দল যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে, বিশেষ করে বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিষয়ে। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত আসা উচিত যে কোন নির্বাচনের পূর্বে, নির্বাচনের পরে না। দলের সিদ্ধান্ত অত্যন্ত কঠোরভাবে কার্যকর করা উচিত দলের শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য। আরেকটি বিষয়ও অতি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা প্রয়োজন। তা হলো প্রার্থী বাছাই পর্বে কোন ভুল হচ্ছে কিনা! বাছাই ক্ষেত্রে কেউ প্রভাবিত করার প্রয়াস পাচ্ছে কিনা! অতীতে অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে যিনি প্রতীক পেয়েছেন তার এলাকায় অবস্থান সন্তোষযোগ্য নয়। ইদানীং অনেককে দেখা যাচ্ছে এলাকার সঙ্গে বহু বছর যোগাযোগ নেই। নির্বাচনকে ঘিরে জনসংযোগও করছেন না। কিন্তু কেন্দ্রে প্রতীক নেয়ার জন্য লবিং করে যাচ্ছেন। দীর্ঘ সময় দল ক্ষমতায় থাকার কারণে এসব তথাকথিত প্রার্থী মনে করেন প্রতীক পেলেই আমি নির্বাচিত হয়ে যাব। যা কিনা ভবিষ্যতে দলে মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। ইতিহাসের পাতা একটু ওল্টালে আমরা কি দেখতে পাই? কেউ সারা জীবন একই অবস্থান ধরে রাখতে পারে না। প্রকৃতির মতো সকল ক্ষেত্রে জোয়ার ভাটা থাকে। আওয়ামী লীগ তথা নৌকা এখন পূর্ণ জোয়ারে ভাসছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, ভাটাও একসময় আসবে। ভাটায় থাকা অবস্থায় আবার পূর্ণ জোয়ারের অপেক্ষায় থাকাকালীন সময় প্রয়োজন শক্তিশালী তৃণমূল, যা দলের মূল ভিত্তি। দল যত দুর্বল হয় সরকারের ওপর প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ চাপ তত বৃদ্ধি পায়। তাই দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে প্রয়োজন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করা এবং তার জন্য প্রয়োজন তৃণমূল থেকে দলকে সুসংগঠিত করা।
পরিশেষে বলতে চাই, সাধারণ সম্পাদক মহোদয় স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা আরও পরিষ্কারভাবে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মাঝে উপস্থাপিত হওয়া প্রয়োজন।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক