ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পতিত জমি ও আইলে রোপণ করা হচ্ছে

ঔষধি গাছে কমছে দারিদ্র্য- বেড়েছে নারীর ক্ষমতায়ন

প্রকাশিত: ২২:৫৪, ২৯ ডিসেম্বর ২০২০

ঔষধি গাছে কমছে দারিদ্র্য- বেড়েছে নারীর ক্ষমতায়ন

সমুদ্র হক ॥ রাস্তার ধারে একদার ফেলে দেয়া পাতার গাছের চারা এখন রোপণ হচ্ছে গ্রামের পতিত জমি ও আইলে। এই পাতা গ্রামের গরিব মানুষকে দেখাচ্ছে বাড়তি আয়ের পথে। কমছে দারিদ্র্য। দেশ অতি দ্রুত সময়ে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যে (এসডিজি) অন্তত ছয়টি অর্জনে পৌঁছেছে। নারীর ক্ষমতায়নের শাখা-প্রশাখার বিস্তৃতি ঘটছে। গ্রামের নারী নিজেকে এবং পরিবারকে সমৃদ্ধ করার পথ খুঁজে পেয়েছে। তারা আর ঋণের বোঝা নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়াতে চায় না। পথের ধারে, নদী তীরে, ঝাউবনে, আঙ্গিনার কোনায় অযত্নে বেড়ে ওঠা চেনা ও অচেনা কিছু গাছ, লতাপাতা দারিদ্র্যবিমোচনের সঙ্গে মানবকল্যাণের পথ চিনিয়েছে। গায়ের খুব কম লোকই জানত এসব লতাপাতার গুণাগুণ। কয়েক বছর ধরে এসব গাছগাছালির ঔষধি গুণাগুণ ও বাণিজ্যিক মান জেনে গ্রামের লোক অবাক। পাতা শুকিয়ে ও শিকড় বেঁচে অনেক পরিবারের আয় বেড়েছে। সড়কের দুই ধারে প্রয়োজনীয় অনুমতি ও ইজারা নিয়ে যত কিলোমিটার সম্ভব এসব গাছের চারা রোপণ করা যায়। এছাড়াও জমির আইলে, পতিত কোন ভূমিতে, গৃহস্থ ও কিষান বাড়ির উঠানের ধারে রোপণ করা যায় এসব গাছের চারা। বিষয়টি জেনে প্রথমে ছোট কৃষক পরিবার মাঠে নামে। এরপর একের দেখাদেখি আরেকজন রোপণ করতে থাকে বাসক, তুলসী, কালোমেঘ, অশ^গন্ধা ও শতমূলীসহ অন্যান্য গাছ। বর্তমানে বগুড়া, গাইবান্ধাসহ উত্তরাঞ্চলের গ্রামে রাস্তার দুই ধারে চোখে পড়ে ওইসব ঔষধি গাছ। মাঝারি আকৃতির এসব গাছ গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়নে এবং নেতৃত্বে বড় ভূমিকা রেখেছে। বছর দশেক আগে যে বাসক পাতা বিক্রি হতো ৭/৮ টাকা কেজি দরে, তা এখন বিক্রি হয় ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে। ওষুধ কোম্পানিগুলো গ্রামে গিয়ে পাতা সংগ্রহ করছে। বিপণনের নিশ্চয়তা পেয়ে অনেক কৃষক এখন নিজে ধান পাট আখ ভুট্টা শাকসবজি আবাদের পর রাস্তার দুই ধারে জমি ও আইলে ঔষধি গাছ লাগিয়েছে। মাঠপর্যায়ে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ সহযোগিতা দিয়ে উদ্বুদ্ধকরণের কাজ করছে সরকারী সংস্থাসহ কয়েকটি বেসরকারী সংস্থা। সূত্র জানায়, উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের জেলাগুলোর পাশপাশি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোর মানুষ এখন অনেক ঔষধি গাছ চিনে আবাদ করছে। যাদের ৮০ শতাংশই নারী। গ্রামের গৃহস্থ ও কৃষক আবাদি ভূমির বাইরে ফেলে রাখা জায়গায় ঔষধি গাছ লাগিয়ে গাছের পাতা বেঁচে আয়ের অঙ্ক বাড়াচ্ছেন। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, সড়ক ও জনপথ বিভাগের কাছ থেকে রাস্তার ধারের পতিত জায়গা নিয়ম অনুযায়ী লিজ নিয়ে ঔষধি গাছ লাগাচ্ছেন। বৃক্ষ পরিচর্যা থেকে উৎপাদন এবং পাতা শুকিয়ে বিপণন পর্যন্ত প্রতিটি পয়েন্টে একসঙ্গে কাজ করে নারী ও পুরুষ। পাতার মান নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি তাদের শেখানো হয়েছে। কখনও সমবায়ের ভিত্তিতে গাছ রোপণ করা হয়। বগুড়া সদরের লাহিড়িপাড়া নামুজা ও নুনগোলা ইউনিয়নের অন্তত ১০ হাজার নারী-পুরুষ ঔষধি গাছ চাষাবাদ করে নিজেদের সংসারের আয় বাড়িয়েছেন। লাহিড়ীপাড়ার নতুন পরিচিতি এখন ‘ঔষধি গ্রাম’। প্রতিমাসে এই তিন ইউনিয়ন থেকে প্রায় সাত হাজার কেজি লতাপাতা সংগ্রহ করে ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। বাসক পাতা ৫/৬ ইঞ্চি। পাতা ও কাণ্ড দেখতে সবুজ। রোপণের চার মাসের মধ্যে পাতা সংগ্রহ করা যায়। তুলসী, কালোমেঘ, অশ্বগন্ধা ও শতমুল উঁচু বা নিচু জমিতেও চাষ হয়। লাহিড়ীপাড়ার ইউনুস আলী জানান, প্রায় দুই কিলোমিটার পথের ধারে বাসক চারা লাগিয়েছেন। মাঝারি গাছ থেকে বেশি পাতা পাওয়া যায়। প্রতিকেজি বাসক পাতা ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে, অশ্বগন্ধা পাতা ও ফল মান ভেদে ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা কেজি। কালোমেঘ ৫০ টাকা, তুলসী ৫০ টাকা, শতমুল ২০ থেকে ২৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। নামুজা ইউনিয়নের হুকুমাপুর গ্রামের আব্দুল গফুর জানান, ২/৩ বছর অন্তর গাছগুলো ছেঁটে দিলে নতুন পাতা গজায়। তিনি প্রতিমাসে প্রায় দুই মণ বাসক পাতা বিক্রি করেন। একই সময়ে অশ্বগন্ধার শিকড় বিক্রি করেন অন্তত ৫০ কেজি। কালোমেঘের গোটা গাছই বিক্রি করা হয়। আগে গাইবান্ধা ও নাটোর থেকে ঔষুধি চারা সংগ্রহ করা হতো। এখন বগুড়ায় চারা তৈরি হচ্ছে। লাহিড়ীপাড়া গ্রামের আকলিমা জানালেন, পাতা বেঁচে তিনি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ যোগাচ্ছেন। দীঘলকান্দি গ্রামের ইউনুস আলী বললেন, এক কিলোমিটার রাস্তায় বাসক তুলসী পাতা বেঁচে টিনশেডে ইটের ঘর দিয়েছেন। গাইবান্ধার পলাশবাড়ি উপজেলার মেহেদীপুর গ্রামের প্রায় প্রত্যেক পরিবার ধান পাট গম আলু সবজি আবাদের পাশাপাশি রাস্তার ধারে ঔষধি গাছের চাষ করছে। ববিতা রানী সরকার বললেন, পুরুষ এখন নারীর ওপর চোখ রাঙায় না। নারী কৃষি কাজে পরামর্শ দিচ্ছে। রফিকুল ইসলাম বললেন, এক কিলোমিটার রাস্তার দুই ধারে দুই হাজার ৩৪৬টি চারা রোপণ করেন। প্রতিকেজি শুকনো পাতা ৫০ টাকা দরে বেঁচে এক লাখেরও বেশি টাকা পেয়েছেন। উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে টিকেছে ৭২ হাজার টাকারও বেশি। তুলসী কালোমেঘ গাছের পাতা একই প্রক্রিয়ার উৎপাদন ও বিপণন হয়। গ্রামে ঔষধি গাছগুলোর স্থানীয় নামও আছে। যেমন বাসক পাতার নাম ‘হাড়বাক্স’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসিউটিক্যাল ও টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক বললেন, ফার্মেসি বিভাগের অনেক শিক্ষার্থী এখন এলাকায় গিয়ে ঔষধি গাছের চারা রোপণ করে বাড়তি আয় করছেন। দীর্ঘদিনের ঠাণ্ডা, কাশি বা শ্বাসকষ্টের জন্য ব্যবহার করা হয় বাসক পাতা। আর এসিডিটি, পরিপাকতন্ত্র ও পেটের বিভিন্ন পীড়া, আমাশয় রোধে কালোমেঘ ব্যবহার করা হয়। তুলসী পাতা সব ওষুধ কারখানায় কমবেশি লাগে। শক্তি বর্ধনের জন্য অশ্বগন্ধা বেশি কাজ দেয়। প্রতিটি ঔষুধি উদ্ভিদের বহুমুখী গুণাগুণ আছে। বিশে^র দেশে দেশে ভেষজ ওষুধের চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারী হাসপাতালে ভেষজ চিকিৎসার আলাদা ইউনিট আছে।
×