ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

তবু বোধোদয় হয়নি ওদের

প্রকাশিত: ২০:১৩, ২৮ ডিসেম্বর ২০২০

তবু বোধোদয় হয়নি ওদের

চলছে মহান বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। এই অর্জনের মাসে (৩ ডিসেম্বর) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করতে এসেছিলেন একাত্তরের ঘাতক শক্তি পাকিস্তানের বাংলাদেশ নিযুক্ত হাইকমিশনার। একাত্তরে হার না মানা যুদ্ধে সাগরসম রক্তক্ষরণ আর লাখো প্রাণ বিসর্জিত কষ্টের অসহনীয় বোঝা বয়ে বেড়ানো বাঙালীর প্রতিনিধি ও বঙ্গবন্ধু তনয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কথা বলেছেন সেই অভিশপ্ত শত্রু রাষ্ট্রের হাইকমিশনার ইমরান আহমেদ সিদ্দিকীর সঙ্গে। তিনি সাফ বলে দিয়েছেন, ‘বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান যে নৃশংসতা চালিয়েছিল, তা ভোলা যায় না। সেই ক্ষত চিরদিন রয়ে যাবে।’ স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তৎকালীন পাকিস্তানের ঘৃণ্য আচরণের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, পাক গোয়েন্দা সংস্থার নথি নিয়ে প্রকাশিত ‘সিক্রেট ডকুমেন্ট অব ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ বইয়ে ১৯৪৮-৭১ সাল পর্যন্ত অনেক ঐতিহাসিক সত্য জানতে পারবে সবাই। এছাড়া জাতির জনকের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ (উর্দু সংস্করণ) পাকিস্তানে অন্যতম বেস্ট সেলার বই বলেও উল্লেখ করেন তিনি। এই কথাগুলোর মর্মার্থ কী অনুভব করতে পারছে পাকিস্তান। সর্বাগ্রে পিছিয়ে পড়া ভঙ্গুর পাকিস্তান হয়তো কিছুটা অনুধাবন করতে পারছে একাত্তরের কুকর্মের কথা। কিন্তু ক্ষমা চেয়ে পাপের ভারি বোঝাটা কমানোর মন-মানসিকতা এখনও সৃষ্টি হয়নি তাদের। আমি মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্ম। একাত্তরের ভয়ানক দিনগুলো স্বচক্ষে দেখা সম্ভব হয়নি। দেখা হয়নি মুক্তিযোদ্ধা ও পাক বাহিনীর মধ্যকার মরণ যুদ্ধ। তখন জন্ম হয়নি বিধায় দেখা হয়নি রক্তে ভেজা বাংলাদেশ আর মড়া লাশের গন্ধে এই দেশ কতটা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। কতটা কঠিন কষ্ট বুকে ধারণ করে গুমড়ে কেঁদে উঠেছিল এ দেশের মাটি ও মানুষ। তবে টেলিভিশনে প্রচারিত ভিডিও ফুটেজ ও পত্রিকান্তরে প্রকাশিত বিবরণ দেখে অনুমান করতে পারি মহান মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর। যা দেখে ও পড়ে নিজের রক্ত খাবলে-খোবলে খায় নিজেকে। একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ ও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের করুণ পরিণতি নিজ চক্ষে দেখা সম্ভব হয়নি ঠিক। কিন্তু দেখা হয়েছে শহীদের রক্তস্নাত এই স্বাধীন দেশের মাটিতে রক্তে ভেজা পতাকা উড়িয়ে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীরা কিভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত হয়েছিল। দেশ, মাটি ও মানুষের প্রকাশ্য বিরোধিতা করে যারা সরাসরি হত্যাকাণ্ডসহ নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছিল তাদের ক্ষমতাকালীন হুঙ্কার শুনে কিছুটা হলেও আঁচ করতে পেরেছি একাত্তরে এরা কতটা দুর্ধর্ষ ছিল। যাই হোক অবশেষে জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধের বিচার ও রায় কার্যকর দেখে মনে তৃপ্ততা জেগেছে। কলঙ্কের কালিমা মোচনকৃত বাংলাদেশের উত্থান দেখে একাত্তরে গণহত্যার নেতৃত্বদানকারী পাকিস্তান ও এ দেশীয় দোসররা এখনও বাঙালী, বাংলাদেশকে খাঁমচে ধরার সুযোগ খুঁজে বেড়াচ্ছে। এ থেকে সতর্ক থাকতে হবে। পাকিস্তান যতই কাকুতি-মিনতির ভাব দেখিয়ে যাক, তাদেরকে সুযোগ দেয়া চলবে না। তারা সুযোগ পেলেই ধূলিসাৎ করে দিতে পারে সব অর্জন। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশ যতটা এগিয়েছে অভিশপ্ত পাকিস্তান ততটাই ভয়ঙ্কর পরিণতি ভোগ করছে। তবে এখন পর্যন্ত একাত্তরের শাপ মুক্তির জন্য বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেনি দেশটি। যুদ্ধ চলাকালীন নয় মাসে ঘৃণ্য পাকি প্রেতাত্মারা এই ভূখণ্ডে যে রোমহর্ষক নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। পলি মাটির এই উর্বর বঙ্গরাজ্যে হত্যা, গুম, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ এমন কোন দুষ্কর্ম নেই যে তারা সংঘটিত করেনি। এই দুষ্কৃতকারীরা রক্তের লোনা ধারায় ভাসিয়েছে শহর থেকে গ্রাম-গ্রামান্তর। রক্তে লাল হয়েছে বাংলার হাওড়-বাঁওড়, খাল-বিল, সাগর-নদী। পাক দোসর ও তাদের মিত্র বাহিনীর অপকর্মে ভারি হয়ে উঠেছে আকাশ-বাতাস। তাদের বিকৃত লালসায় ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে বাংলা মায়ের বুক। পাক বাহিনীর অমার্জনীয় অপরাধের শিকার হয়ে কত মা তার সন্তান হারানোর যন্ত্রণায় কেঁদে ফিরেছেন, কত স্ত্রী তার স্বামী হারানোর বেদনায় ছটফট করেছেন, কত স্বামীর সামনে তার স্ত্রী, কত ভাইয়ের সামনে তার বোন ও কত বাবার সামনে তার বিয়েবয়সী কন্যার সম্ভ্রম কেড়ে নিয়ে দেহ ভোগের বিকৃত উল্লাসে ফেটে পড়েছে ওই ইমরান আহমেদ সিদ্দিকীর পূর্বসূরিরা। কী দোষ ছিল স্বাধীনতাকামী নিরীহ বাঙালীর? এর কোন উত্তর দিতে পারবেন জনাব হাইকমিশনার ইমরান সিদ্দিকী? মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস জুড়ে এতসব অপকর্ম চালানোর পর পাকি গোষ্ঠী বীর বাঙালীর সঙ্গে পেরে উঠতে না পেরে এই ডিসেম্বরেই নাকে খত দিয়ে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। বাঙালী বীরত্বে পাক অমানুষেরা পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হলেও ত্রিশ লাখ শহীদপ্রাণ ও কয়েক লাখ মা- বোনের ইজ্জত লুণ্ঠনকারী অভিশপ্ত জাতি হিসেবে পাকিস্তান আজ অবধি বাঙালী ও বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা ভিক্ষে চায়নি। এ জন্য তাদেরকে এড়িয়ে চলাই উত্তম। স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতি দেখে পাপিষ্ঠ পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার বোধোদয় না হলেও আমাদের অনুসরণ করে এগিয়ে যাওয়ার মন ধরেছে তাদের। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এসে পাক হাইকমিশনার ইমরান আহমেদ সিদ্দিকী বলেছেন, বাংলাদেশের বিস্ময়কর উন্নয়ন সম্পর্কে জানতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী তাদের পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়া পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো রকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়া দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করতে চায় বলেও জানিয়েছেন তিনি। পাকিস্তানের এই ইচ্ছাশক্তির ভেতরে লুকিয়ে থাকতে পারে বদ চিন্তা-চেতনা। যদি অতীতের কিছু ঘটনা সামনে আনি তাহলে হয়তো কিছুটা পরিষ্কার হবে। ঢাকায় পাকিস্তান দূতাবাসের ভিসা কর্মকর্তা মাযহার খান ও ‘সেকেন্ড সেক্রেটারি’ ফারিনা আরশাদের কথা অবশ্যই মনে আছে। প্রথমে মাযহার খানের কথায় আসি। ২০১৫ সালের কথা। ঐ বছরের ২ ফেব্রুয়ারি শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিকে ‘হাইকমিশনে বসে পাকিস্তানী কর্মকর্তার এত অপকর্ম!’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। খবরে বলা হয়, ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশনের এক কর্মকর্তা এ দেশে জঙ্গি সংগঠনের অর্থায়ন, মুদ্রাপাচার, জাল মুদ্রা সরবরাহসহ নানা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। মোহাম্মদ মাযহার খান নামের এই কর্মকর্তাকে পুলিশ গত মাসে হাতেনাতে আটক করলেও পরে হাইকমিশনের তৎপরতায় বনানী থানা থেকে মুক্ত হন তিনি। গোয়েন্দা অনুসন্ধানেও পাকিস্তান হাইকমিশনের এই সহকারী ভিসা কর্মকর্তার জঙ্গী কানেকশনের পাশাপাশি নানা অপতৎপরতার তথ্য-প্রমাণ মিলেছে। সে সুবাদে দ্রুত সময়ের মধ্যে মাযহার খানকে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কারের পাশাপাশি এ দেশে অবস্থানকারী পাকিস্তানী নাগরিকদের ওপর নজরদারি বাড়ানোর জোর সুপারিশ করা হয়েছিল গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। [সূত্র : কা. কণ্ঠ, ০২.০২.২০১৫] তারই প্রেক্ষিতে মাযহার খানকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। এবার সুন্দরী ফারিনা আরশাদের কথায় যেতে হয়। মাযহার খানকে পাকিস্তান দূতাবাস থেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার পর তার নেটওয়ার্কের সমন্বয় করে আসছিলেন ফারিনা। দূতাবাসটির ‘সেকেন্ড সেক্রেটারি’ (রাজনৈতিক) পদমর্যাদার সুন্দরী এই কর্মকর্তা বাংলাদেশে বসে এই দেশের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর সব কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছিলেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তিনি যেমন জঙ্গী নেটওয়ার্ক মনিটর করছিলেন, তেমনি জাল মুদ্রার ব্যবসাতেও নেপথ্যে থেকে পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছিলেন তিনি। ইংরেজী, উর্দু ও বাংলায় অনর্গল কথা বলতে সক্ষম এই সুন্দরী বাংলাদেশে বসে বাংলাদেশকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা করে আসছিলেন। [সূত্র : বা.প্রতিদিন, ১৪.১২.২০১৫] বর্বর পাকিস্তানকে সুযোগ দিলে সে দেশের ঘৃণ্য মানুষগুলো আমাদের বাড়িতে বসে আমাদেরকেই ঘায়েল করার চেষ্টা করবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। তাই এদের থেকে সজাগ থাকাটাই উত্তম। নইলে তাদের কূট তৎপরতা বাংলাদেশকে ধ্বংস করে দিতে পারে। লেখক : সাংবাদিক [email protected]
×