ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিজয়ের মাসে পদ্মা জয়

প্রকাশিত: ২০:১২, ২৮ ডিসেম্বর ২০২০

বিজয়ের মাসে পদ্মা জয়

যে চিনে-সেই কিনে, আবার যে জানে-সেই মাথা নত করে মানে, সম্মান-শ্রদ্ধা করে-এটি আমার ব্যক্তি জীবনের অভিজ্ঞতা-উপলব্ধি। কারণ, যে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেনি, তার কাছে জয়-পরাজয় একটা খেলা মাত্র। যে দুর্যোগ মোকাবেলা করেনি, তার কাছে বৃষ্টি-জলোচ্ছ্বাস বিলাসিতার উপমা মাত্র। আর যে পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করে, সেই জানে শুধু সাঁতার কাটার কৌশল জানা থাকলেই হবে না, তীব্র স্রোতে কিভাবে নিজেকে ভাসিয়ে জীবন রক্ষা করতে হয়, স্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আত্মরক্ষা করতে হয়- এগুলো অভিজ্ঞতার বিষয়, সময়ের গতির আগেই সিদ্ধান্তের বিষয়। কিন্তু দুঃখজনক হলো, আমাদের দেশের একশ্রেণির মানুষ আছেন যারা সব সময় কৃত্রিম স্রোতের পক্ষে থাকতে ভালোবাসেন। গুজবের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেন। সত্য-মিথ্যা কিংবা তথ্য উপাত্ত আর অভিজ্ঞতা-সাহসের অভাবে যেন নিজেরাই নিজেদের মনোবল হারিয়ে ফেলেন। স্বাধীনতাবিরোধী-রাজাকার মহল যখন মিথ্যাচার-অপপ্রচারের মাধ্যমে কুখ্যাত রাজাকার দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেল বলে কৃত্রিম স্রোত তৈরি করল, তখন একশ্রেণীর মানুষ ওই স্রোতে জড়িয়ে পড়ল। আবার স্বপ্নের পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে এদেশের স্বাধীনতাবিরোধী, উন্নয়নবিরোধী ব্যক্তি ও মহল যখন পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হওয়ার গালগপ্পের স্রোত তৈরি করল, তখনও এ দেশের একশ্রেণীর তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, অর্থনীতিবিদ, লেখক, গবেষক, সাংবাদিক রীতিমতো সেই অপপ্রচারের স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিল। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার কাজে লেগে পড়ল। পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিরুদ্ধে দেশে ও বিদেশে বাংলাদেশবিরোধী প্রকল্প প্রণয়ন করল। কিন্তু যার আছে সততার উদ্যোম, আত্মপ্রত্যয়ের অঙ্গীকার- সেই শেখ হাসিনাকে কখনও দাবায়ে রাখা সম্ভব? যে দেশ ও জনগণের জীবন মান উন্নত করতে জীবনের প্রতিটি সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা মিথ্যাচার,অপপ্রচার রোধ করে সত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন, যিনি মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মোকাবেলা করেছেন, তাঁকে দুর্নীতির গালগপ্প দিয়ে বিতর্কিত করতে পারেননি, পারবেনও না। কারণ, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক শিক্ষক বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ হাসিনার শরীরে বহমান হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালীর রক্ত, যাকে পাকিস্তানের কারাগারের পাশেই কবর খুঁড়ে হত্যার চূড়ান্ত নীল নকশা প্রণয়ন করেও বাঙালী ও বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত আর রাজনৈতিক দিক্ষায় আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে ২৪ বার মৃত্যুর চূড়ান্ত সীমারেখা অতিক্রম করে শেখ হাসিনাও বাঙালীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছেন, বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে বাংলাদেশের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন। ২০১২ সালের ১০ জুলাই নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মাণের নিশ্চয়তা দিয়ে ২০২০ সালে বিজয়ের মাসের এই ১০ তারিখেই বেলা ১২টা ২ মিনিটে সেতুর মাওয়া প্রান্তের ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটির সঙ্গে ‘জোড়া’ দিয়ে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার সেতুর পুরো মূল কাঠামো দৃশ্যমান করা হয়। কিন্তু পদ্মা সেতুর প্রকল্পের বিরুদ্ধে কী হয়েছিল-এটি আমাদের সবারই জানা। তবে একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয় যে, ‘পদ্মা সেতুর স্বপ্ন দেখাচ্ছে সরকার। কিন্তু পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের আমলে হবে না। এ সেতু জোড়াতালি দিয়ে বানানো হচ্ছে। এ সেতুতে কেউ উঠবেন না। অনেক রিস্ক আছে’- এভাবেই দেশের জনগণকে আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু নিয়ে বিভ্রান্ত করেছেন, অপপ্রচার আর মিথ্যাচার করে পদ্মা সেতুর বিরোধী অবস্থান-ষড়যন্ত্র সৃষ্টি করেছেন বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া যা পরবর্তী সময়ে নানা রকম ‘গুজব’ প্রতীয়মান হয়েছে। ‘জোড়াতালি’ দিয়ে পদ্মা সেতু বানানো হচ্ছে, উঠবেন না, রিস্ক আছে-এই ধরনের বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত করা হয় দুর্নীতির ‘গালগপ্প’। আবার সেতুর পুরো মূল কাঠামো দৃশ্যায়ন করার আগ পর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়ায় নানামুখী অপপ্রচার যেমন, ছোট বাচ্চাদের তাজা রক্ত লাগবে, একমাত্র সন্তানের (এক মা’র সন্তান) মাথা লাগবে, পদ্মা সেতু এই চায়, ওই চায়-এর মতো জঘন্য রূপে ছড়ানো গুজব একশ্রেণীর সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল, বিভ্রান্ত করেছিল। আর ২০১৭ সালে কানাডার আদালত দুর্নীতির চেষ্টার অভিযোগকে ‘গালগপ্প’ বলে উড়িয়ে দেয়ার আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা কী ধরনের ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেছেন, কী জঘন্য ব্যক্তিগত আক্রমণাত্মক মন্তব্য সহ্য করেছেন-আশা করি এটিও ভুলে যাবার কথা নয়। কিন্তু মূল কথা হচ্ছে, শেখ হাসিনার একক দৃঢ় বিশ্বাস আর আত্ম উপলব্ধিই বিশ্বের মাঝে আমাদের সক্ষমতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে পদ্মা সেতু। কারণ, বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে একাট্টা হয়ে এদেশের কতিপয় রাজনীতি-অর্থনীতিবিদ, সুশীলসমাজখ্যাত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পিত মিথ্যাচার, অপপ্রচার আর দুর্নীতির গালগপ্পের সঙ্গে জোড়ালোভাবে যুক্ত হয়েছিল তাদের বিশ্বাসহীনতাও। আর ওই বিশ্বাসহীনতা আওয়ামী লীগের অনেক সিনিয়র নেতাদের মাঝেও প্রতীয়মান হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে চা-এর আড্ডায় পদ্মা সেতু নিয়ে বিভিন্ন ট্রল করা হয়েছে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে নিয়ে, শেখ হাসিনার উদ্যোম-উদ্যোগ নিয়ে। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন সংসদে দাঁড়িয়ে দৃঢ় চিত্তে আর আত্ম মনোবল নিয়ে পদ্মা সেতুর নির্মাণের কথা বলেন, তখনকার বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া শেখ হাসিনাকে ‘পাগল’ বলেও মন্তব্য করতে ছাড়েননি। আসলে পদ্মা নদী কী- এটি দেশের একমাত্র দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষই ভাল করে জানে এবং বুঝে। ওই অঞ্চলের মানুষের অভিজ্ঞতায় পদ্মা নদী রীতিমতো ‘সর্বনাশা পদ্মা’ হিসেবেই মন-মগজের জায়গাজুড়ে ভয়-আতঙ্ক বিড়াজমান। আর ভরা বর্ষা কিংবা শীত-দুই মৌসুমেই এই নদীপথে চলাচলে দেখা দেয় এক অজানা ভয়-আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা। কখনও পানিতে ডুবে যায় ফেরির পল্টুন, কখনও ভাঙতে থাকে পদ্মার কূল। অনেকে বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্যান্য যানবাহনে পার হতে গিয়ে জীবন পর্যন্ত হারিয়েছে, খরস্রোতা পানিতে ভেসে গেছে অসংখ্য মানুষের মৃতদেহ। আবার ওপাড়ে বাবা’র মরদেহ, এপাড়ে অপেক্ষমাণ সন্তান। কিন্তু সর্বনাশা পদ্মা রীতিমতো শত্রুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যায়, রাত পেরিয়ে দিন শুরু, তখনও পদ্মা তার মানবিক রূপ ধারণ করে না। যখন ১৮/২০ ঘণ্টা পার হয়ে যায় তখন সন্তান বাবার মৃতদেহের কাছে পৌঁছায়, ততক্ষণে রীতিমতো বাধ্য হয়েই ধর্মীয় বাধ্যবাধকতায় বাবার মরদেহ দাফন করা হয়ে গেছে- এমন হৃদয়বিদারক জীবনের গল্প পদ্মার ওপাড়ের অনেক বন্ধু তাদের ফেসবুকে তুলে ধরে স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের আজকের দিনে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে স্যালুট, দোয়া-মোনাজাত করে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। কারণ, প্রমত্তা পদ্মার যেমন আছে গভীরতা, তেমনি রয়েছে খরস্রোতাও। আর যুগ-যুগ ধরে পদ্মা একদিকে যেমন ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে তার দুই তীরের মানুষকে, তেমনি আবার তার প্রচণ্ড সর্বনাশা রূপ ছড়িয়ে ভয়, আতঙ্ক আর অজানা রহস্যময় করেও রেখেছে। আবার পদ্মার ইলিশ, পদ্মার নানা রকম ঢেউ নিয়ে যেমন বাঙালীর রোমান্টিকতার অন্যতম অনুষঙ্গ-গান রচনা হয়েছে, তেমনি দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষের অসংখ্য দুঃখ-বেদনা আর হাসি-কান্নার নিবির সাথী-সম্পর্কও বজায় রেখেছে এই পদ্মা। পদ্মা সেতুর সর্বশেষ, অর্থাৎ ৪১তম স্প্যান বসানোর ঐতিহাসিক মুহূর্তের পর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ আবেগ-ভালবাসা আর আনন্দ-উচ্ছ্বাসের বর্ণনাগুলো ফেসবুকে ভাইরাল করেছেন। জন্মবধি যাদের অবিশ্বাস-সন্দেহ ছিল যে, পদ্মার বুকে কখনও পদ্মা সেতু হবে, হতে পারে- এর বাস্তবায়ন দেখে অনেক বন্ধু রীতিমতো কেঁদে ফেলেছেন। ফোন করে অভিনন্দন, ধন্যবাদ জানিয়েছেন। আমরা যে পারি, আমাদের যে আত্মমর্যাদা আছে-এটি শেখ হাসিনাই বুঝিয়েছেন, প্রমাণ করেছেন। পদ্মা সেতু নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য-বিবৃতি, সমালোচনা, ষড়যন্ত্র যতটা ছিল, তার চেয়েও বেশি ছিল পদ্মার বুকে পদ্মা সেতু করতে পারবে- এই অবিশ্বাস, সন্দেহ। কিন্তু যিনি বাঙালীকে চেনেন, যিনি বাঙালীর ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস বুঝেন, যিনি দেশের প্রতি বাঙালীর আত্মমর্যাদা আর আত্ম অহংকারের বিষয়গুলো উপলব্ধি করেন- শেখ হাসিনাই সেই আত্মবিশ্বাস নিয়ে একক চিত্তে দৃঢ় মনোবল-বিশ্বাস নিয়ে ছুটে চলেছেন, সকল মিথ্যাচার-অপপ্রচার আর দুর্নীতির গালগপ্প মোকাবেলা করে বাঙালীর স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতুর পুরো মূল কাঠামো দৃশ্যমান করেছেন। প্রতিটি মানব সন্তানের জন্য তার পরিবার যেমন গুরুত্বপূর্ণ, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ধর্ম চর্চার অভিভাবক-নেতৃত্ব যেমন অপরিহার্য; তেমনিভাবে একটি দেশ ও জাতির জন্য বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও নেতার গুণাবলীও সেদেশের জনগণের আত্মমর্যাদা ও সভ্য মনমানসিকতা বিকশিত হতে সাহায্য করে, অনুকরণীয় করে তোলে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমার তার দীর্ঘ ২৪ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করে বাঙালী চেতনাবোধে উদ্বুদ্ধ করে একটি জাতিকে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন, আর পঁচাত্তর পরবর্তী অবহেলিত জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে দীর্ঘ ২৬ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর মাধ্যমে সে জাতিকে ‘আত্মমর্যাদা’ আর ‘সক্ষমতা’র উন্নয়নে নব উদ্যোমের বাংলাদেশ বিশ্বায়নে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)
×