ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

২০২০-এর অর্থনীতি ॥ প্রাপ্তি ও চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিত: ২০:১১, ২৮ ডিসেম্বর ২০২০

২০২০-এর অর্থনীতি ॥ প্রাপ্তি ও চ্যালেঞ্জ

সরকারী হিসাবে ২০২০ সালের অর্ধেক পড়েছে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এবং শেষ অর্ধেক পড়েছে ২০২০-২১ অর্থবছরে। আলোচিত প্রবন্ধে ক্যলেন্ডার বছর জানুয়ারি-ডিসেম্বর ধরেই ২০২০ সালের অর্থনীতির অগ্রগতি ও আগামী বছরের প্রত্যাশা/চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে বিশ্লেষণের প্রয়াস চালাব। অর্থনীতির গবেষকগণ বেশ কতগুলো চলকের মানদণ্ডে যেমন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, জিডিপিতে কৃষি, শিল্প, সেবা খাতের অবদান, কর জিডিপি অনুপাত, সঞ্চয় -বিনিয়োগ জিডিপি অনুপাত ইত্যাদি দিয়ে অর্থনীতিকে মূল্যায়ন করে থাকে। যদিও এ নিয়ে অর্থনীতিবিদগণের মধ্যে অনেক বিতর্ক রয়েছে, যা চলমান থাকবে। ২০২০ সালের অর্থনীতিকে বলা হয় করোনাকালের অর্থনীতি। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছে ৫ লাখের বেশি, সুস্থ হয়েছে ৪ (৮৮.০৮%) লাখেরও বেশি, মৃত্যুবরণ করেছে ৭ (১.৪৫%) হাজারেরও বেশি, যার মধ্যে রয়েছেন অনেক বরেণ্য ব্যক্তি, যাদেরকে আমরা এই বিজয়ের মাসে শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি। অনেক অর্থনীতিবিদ এবং সমাজতত্ত্ববিদ মনে করেন, এই মুহূর্তে অর্থনৈতিক ক্ষতির হিসাব-নিকাশের চেয়ে মানব সভ্যতার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য করোনা মোকাবেলায় বেশি জোর দেয়া উচিত। তারপরও পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, সাম্প্রতিক বাংলাদেশের অর্থনীতির বেশিরভাগ সূচকই সঙ্কটে থাকলেও ঘুরে ফেরার সামর্থ্য দেশটি রাখে। ২০২০ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসাবে স্থির মূল্যের সমতায় জিডিপির আকার ৩০তম এবং চলতি ডলার মূল্যে অবস্থান ৩৯তম। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদনে ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে বাংলাদেশ। অথচ এক দশক আগেও বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ছিল ভারতের অর্ধেক। অনেকে বাংলাদেশকে ‘এশিয়ান টাইগার’ নামেও অভিহিত করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সদ্যসমাপ্ত ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ২০ শতাংশ। যদিও গত অর্থবছরে জন্য প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮ দশমিক ২০ শতাংশ। পরে তা কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। এর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। যদিও করোনার কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিতেও ধস নামার আশঙ্কা করেছিল উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো। তবে সরকার দৃঢ় মনোবল দেখিয়ে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রায় প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২০ শতাংশই পুনঃনির্ধারণ করে। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতো সংস্থাগুলোও জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২ থেকে ৩ শতাংশ পর্যন্ত নেমে আসার আভাস দিয়েছিল। অবশ্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে বলে আভাস দিয়েছিল। যদিও তাদের আশঙ্কাকে মিথ্যা প্রমাণ করে বাংলাদেশ এই করোনা পরিস্থিতিতেও সন্তোষজনক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। বিগত ৫০ বছরের মধ্যে গত দশকে গড় প্রবৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি ছিল (৬.৭৬ শতাংশ)। বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে প্রতি দশকে ১ শতাংশ পয়েন্ট প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। এটি একটি অনন্য অর্জন। যদিও প্রথম প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় ২০২১ সালে প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ ধরা হয়েছিল। এবার আসা যাক মাথাপিছু জাতীয় আয় প্রসঙ্গে, যা একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাপকাঠি ধরা হয়। গত দশকে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। ১৯৯০-এর দশক থেকে তা গতিশীল হতে শুরু করে, যা চলতি দশকে বৃদ্ধি ছিল সবচেয়ে বেশি। দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনার মূল দুটি অভীষ্ট হচ্ছে, ২০৩১ সালের মধ্যে নিম্নমধ্যম আয় থেকে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়া। বিশ্বব্যাংকের শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী, ২০২০-২১ সালে নিম্নমধ্যম আয় থেকে উচ্চমধ্যম আয়ে উন্নীত হওয়ার সীমা হলো মাথাপিছু আয় ৪ হাজার ৪৫ মার্কিন ডলার (এটলাস পদ্ধতিতে)। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ২০৬৪ মার্কিন ডলার (উৎস : বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২০)। স্বাধীনতার পর থেকে মানুষের মাথাপিছু গড় আয় ১৫ গুণ বেড়েছে এবং মাথাপিছু আয়, মানব সম্পদ এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা- এই তিনটি সূচকের দুটিতেই উত্তরণ ঘটলেই একটি দেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের সুযোগ পাবে, যা বাংলাদেশ অনেক আগেই তা অর্জন করেছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়লে মাথাপিছু আয়ও বাড়বে, যদি জনসংখ্যা সে অনুপাতে বৃদ্ধি না পায়, যা বর্তমানে রয়েছে ১.৩৭% হারে। সে কারণে আমাদের উন্নয়ন নীতিতে প্রবৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ। প্রবৃদ্ধি বাড়লে মানুষের চাহিদা বাড়বে। চাহিদা বাড়লে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল হবে এবং বিনিয়োগ বাড়বে। ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং মানুষের আয় বাড়বে। সাম্প্রতিক কালে রাজস্ব নীতিতে অনেক সংস্কার সাধন করেছে সরকার। যার মধ্যে কর ব্যবস্থাপনা অন্যতম। যেমন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ব্যবস্থার বাস্তবায়ন, কর আপাতন হ্রাসকরণ, মূসকের পরিধি বৃদ্ধি ও সম্পূরক শুল্ক আরোপ (উৎস : জাতীয় রাজস্ব বোর্ড)। এরই মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে নিম্ন আয়ের মানুষের কথা বিবেচনায় রেখে আয়কর রহিত সীমা ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা,সাধারণ করদাতাদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ টাকা, মহিলা ও সিনিয়র সিটিজেন করদাতাদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা/প্রতিবন্ধী/উপজাতীদের জন্য করসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ লাখ ৫০ হাজার থেকে ৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা। ক্ষুদ্র করদাতাদের সুবিধার্থে ৫ হাজার টাকার পরিবর্তে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকারী কোষাগারে জমা দেয়ার বিধান করা হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে করদাতাদের সুবিধার্থে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং পাশাপাশি আয়কর মেলারও আয়োজন রয়েছে। এই সকল উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়ার উদ্দেশ্য হলো সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, ঘাটতি বাজেট কমানো ও আয়-ব্যয়ের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন করা। এখন আমরা যদি ২০২০-২১ অর্থবছরের সেপ্টেম্বর, ২০২০ মাস পর্যন্ত রাজস্ব আহরণের বিবরণী (সাময়িক) পর্যালোচনা করি তা হলে দেখা যায় যে, বর্তমান আর্থিক বছরে রাজস্ব আদায়ের মোট লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর, ২০ পর্যন্ত ৬৩,৭১৩.৭৯ কোটি টাকার টার্গেটের বিপরীতে অর্জিত হয়েছে ৪৯,৯৮,৯ ৭২ কোটি টাকা (৭৮.৪৬%)। এতে দেখা যায় যে, এই সময়ে রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধির হার ৪.১১%, যা গত বছরে একই সময়ে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩.৯৮ শতাংশ। আবার যদি খাতওয়ারি রাজস্বের আহরণ বিশ্লেষণ করি তা হলে দেখা যায় যে, আমদানি-রফতানি পর্যায়ে লক্ষ্যমাত্রা আর্জিত হয়েছে সেপ্টেম্বর, ২০ পর্যন্ত ৭৩.১৮%, স্থানীয় মূসক থেকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিতের হার একই সময়ে ৭৮.০৮%আর আয়কর ও ভ্রমণ কর থেকে লক্ষ্যমাত্রা আর্জিত হয়েছে সেপ্টেম্বর, ২০ পর্যন্ত ৮৫.০৯%। গত বছর এই সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩.৯৮%, যার মধ্যে কাস্টমসে প্রবৃদ্ধি ছিল-১৩২%, মূসক ২.১৩% এবং অয়কর ১২.৩৩%। এনবিআরের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় রাজস্ব আদায়ে ইতিবাচক গতি আসছে। তবে ভ্যাট আদায় আগের পর্যায়ে রয়ে গেছে। মহামারীকালে মানুষের আয়-উপার্জন কম হয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য কমে গেছে, আমদানিও কমে গেছে, তাহলে ট্যাক্স আসবে কোত্থেকে? দোকানপাটে বিক্রি নেই, ফলে ভ্যাট আদায়ও কম। যার প্রতিফলন ঘটেছে কর আদায়ে। তবে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে আয়কর ও আমদানি-রফতানিতে গতি ফিরতে শুরু করছে। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকার ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার ঋণ, নগদ অর্থ ও খাদ্য সহায়তার ঘোষণা করে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে অক্টোবর পর্যন্ত এসব প্যাকেজ থেকে ৬৬ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা বিতরণ করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক, মন্ত্রণালয় ও সংস্থা। এমন পরিস্থিতিতে প্যাকেজের ঋণ বিতরণের সমস্যা ও ভবিষ্যত করণীয় নির্ধারণ করতে সব মহলকে নিয়ে বৈঠক করেছে অর্থ বিভাগ। ওই বৈঠকে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে যেসব বাধা শনাক্ত করা হয়, এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের আস্থাহীনতা। এদিকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলা এবং প্যাকেজ দ্রুত বাস্তবায়নে যেসব সুপারিশ করা হয় সেগুলো হচ্ছে- প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের অগ্রগতি স্বাধীন (তৃতীয় পক্ষ দিয়ে) মূল্যায়ন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাকে (এসএমই) আরও সহায়তা দেয়া, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাকে প্যাকেজের সুবিধার আওতায় নিয়ে আসা। এছাড়া প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের ঋণের অর্থ প্রাপ্তি নিশ্চিত, এসএমই খাতে প্যাকেজের অর্থ দ্রুত ছাড় ও ডিজিটাল প্লাটফর্মে এসএমই খাতে নিয়ে আসা। একই সঙ্গে নতুন গরিব হওয়াসহ দরিদ্র মানুষকে সহায়তা করতে দেশব্যাপী ওএমএস কর্মসূচী চালু, কৃষিতে আগ্রহ বাড়াতে ইন্স্যুরেন্স ব্যবস্থা ও প্যাকেজ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া আরও সহজ করা। সেখানে আরও বলা হয়, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হলে এসএমই খাতের প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ দ্রুত ছাড় করতে হবে। এই পরিস্থিতিতে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই অবস্থার উন্নতি হয়েছে এবং এই প্যাকেজ বিতরণের সময়সীমা আগামী ৩০ জুন, ২০২১ পর্যন্ত বাড়ানোর দাবি উঠেছে, যা যৌক্তিক। এ সরকারের সবচাইতে অর্জন কৃষির বহুমুখীকরণ ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন (সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান মাত্র ১৩ শতাংশ, যদিও কৃষি খাতের ওপর নির্ভরশীল শ্রমশক্তি ৩৮ শতাংশ, শিল্প খাতের অবদান ৩৫%, সেবা খাতের অবদান ৫২%)। যার ফলে আমরা দেখছি বাংলাদেশ এখন চাল উৎপাদনে চতুর্থ, স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে দ্বিতীয়, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়। আজ আমরা খাদ্যশস্য উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমরা স্বাধীনতার পর থেকে সাড়ে তিন গুণের বেশি চাল উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছি। বাংলাদেশের এই রূপান্তরের পেছনে যে চালিকাশক্তিগুলো কাজ করেছে, সেগুলো হলো সরকারের উন্নয়ন নীতি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, গ্রামাঞ্চলে সড়ক যোগাযোগের বিস্তৃতি, সামাজিক পরিবর্তন, নারীর ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিকরণ, তৈরি পোশাক শিল্প এবং অন্যান্য সামাজিক সূচকে (প্রত্যাশিত গড় আয়ু, শিক্ষা ও জেন্ডার সমতায়, জনসংখ্যা বৃদ্ধি কমানো) উন্নতি। ৭ম পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনা (২০১৬-২০২০) সমাপ্ত হয়েছে এবং ৮ম পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনা (২০২১-২০২৫) এর দলিল গত একনেক সভার (২৩ ডিসেম্বর,২০২০) অনুমোদন লাভ করেছে, যা এই সরকারের একটি বড় অর্জন বলে প্রতীয়মান হয়। সুনির্দিষ্ট সময়ের জন্য কোনো রাষ্ট্রের জাতীয় অর্থনৈতিক অভিযাত্রা ও উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত দলিল হলো পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। বিরাজমান সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণত পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অন্যূন পাঁচ বছরের জন্য রাষ্ট্রের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, এর অভীষ্টগুলো, সংস্কার উদ্যোগ এবং তার বাস্তবায়ন কৌশল প্রকাশ পায়। সেই বিবেচনায় একটি সময়োপযোগী পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং এর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন অর্থনীতির পর্যায়ক্রমিক অগ্রগতির জন্য বিশেষভাবে তাৎপর্যবহ। কাজেই অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের সুস্পষ্ট রূপরেখার প্রতিফলন ঘটবে। এবারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাটি আরেক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে বর্তমানে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়ন হচ্ছে এবং ২০৪১ সালে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যও রয়েছে সরকারের। এসব লক্ষ্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রয়োজনীয় নীতি সংযোজন এবং তার বাস্তবায়ন কৌশলের সমাবেশ ঘটাতে হবে এতে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতি সত্ত্বেও আগামীতে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। তার মধ্যে আছে (১) আমাদের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী, যারা ১৫-২৯ বছর বয়সের, এখনও ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষা, কাজে ও প্রশিক্ষণে যুক্ত নেই। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে উৎপাদনশীল কাজে লাগাতে হবে, (২) ভবিষ্যতে উন্নত দেশ হতে হলে জ্ঞানভিত্তিক সমাজের বিকল্প নেই (৩) রূপকল্প ২০২১-এর আলোকে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেছি, যার প্রমাণ অনলাইন শ্রমবাজারে ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। বাংলাদেশ বিশ্বে জনসংখ্যায় অষ্টম বৃহত্তম। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে আমাদের ব্যবসায় পরিবেশ উন্নয়নে আরও মনোযোগ দিতে হবে; (৪) আমাদের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ফলে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হবে। রফতানি পণ্যের ভেতরে ও বাইরে বহুমুখীকরণে নজর দিতে হবে, মানসম্মত পণ্য উৎপাদনে প্রতিযোগ সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আমাদের অবকাঠামো খাতে আরও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে;, (৫) বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া এবং অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে করোনা মহামারী নিঃসন্দেহে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক দারিদ্র্য বৃদ্ধি, শ্রমজীবী ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মজীবীদের অনেকের কর্মসংস্থান হারানো এবং নতুন কর্মসংস্থানে ধীরগতি, ভোগ চাহিদায় স্থবিরতা। ফলে কর জিডিপি হার কমে গিয়ে সরকারী আয়ে সীমাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর যথোচিত ও সতর্ক পরিচালনা এবং ব্যবসায়ী মহলকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে দেশ শিগগিরই সঙ্কট কাটিয়ে উঠে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছবে বলে আশা করা যায়; (৬) আমাদের একটি আবর্তনিক সমস্যা হলো নীতির সঙ্গে বাস্তবায়নের বিস্তর ব্যবধান। নীতি-পরিকল্পনায় অনেক সুন্দর সুন্দর কিন্তু তার যথাযথ বাস্তবায়ন হয় না প্রায়ই। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে। আশা করি এ থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী দিনের পথ চলার পথটি সুগম হবে। লেখক : অধ্যাপক, ডিন ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি
×