ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ইমন মাহমুদ

জমিদারি মেজাজে একদিন

প্রকাশিত: ০০:২৬, ২৭ ডিসেম্বর ২০২০

জমিদারি মেজাজে একদিন

করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাবের কারণে বিশ^বিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে সেই মার্চ মাস থেকে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় প্রেসক্লাবের সদস্যরা এই দীর্ঘ সময়ে বাড়িতেই কাটাচ্ছিলেন ঘরবন্দী জীবন। বাড়িতে একঘেয়ে সময় কাটাতে কাটাতে হাঁপিয়ে উঠেছেন সবাই। রোজ যাদের দিন কাটে মানবন্ধন, মিছিল অথবা সাংস্কৃতিক রিপোর্ট লিখতে লিখতে, তারা তো এমন জীবনযাপনে হাঁপিয়ে উঠবেন প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই। কয়েকবার পরিকল্পনা নেয়া হলো জাবি প্রেসক্লাবের বার্ষিক ট্যুরের জন্য। তবে সুযোগ হয়ে উঠছিল না। এর মধ্যে অনেকেইে চলে এসেছেন ক্যাম্পাসে। থাকছেন আশপাশেই। হাতের কাছে সুযোগ এনে দিল হেমন্তের মৃৃদুমন্দ কুয়াশা। শীত তো চলে এলোই। যারা বাড়িতে ছিল তারাও এক এক করে শীতের কাপড় নিতে ক্যাম্পাসে আসতে শুরু করেছে। এর মাঝেই সিদ্ধান্ত হলো টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী মহেড়া জমিদার বাড়ি ঘুরতে যাওয়ার। ট্যুরের আহ্বায়ক খলিল ভাইয়ের পরিকল্পনায় ট্যুরের যাবতীয় কাজও শেষ হয়ে এলো। এবার শুধু যাওয়ার পালা। দিনটি ছিল বুধবার। সেন্ট্রাল ফিল্ডের ঘাসে জমে থাকা শিশির পায়ে মাখিয়ে সকাল সকাল টি-শার্ট নিয়ে টিএসসিত জাবি প্রেসক্লাবের কক্ষে চলে এসেছে নূর হাছান নাঈম। এর মধ্যেই সকালের নাস্তা নিয়ে হাজির হয়েছেন খাদ্য বিভাগের প্রধান মাকসুদ জুবায়ের ভাই। একসঙ্গে সকালের নাশতা শেষে সবাই জাবি প্রেসক্লাবের লোগো সংবলিত টি-শার্টটি পরে ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে আমাদের বাসও চলে এসেছে। অমর একুশের সামনে আমাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে বাস। একে একে সবাই বাসে উঠে পড়লাম। আমাদের গাড়ি ছাড়ার কিছুক্ষণ পরেই মূসা ভাই, সায়েম ভাই, তানভীর ভাই, নাঈমের কণ্ঠে শুরু হলো গান। তাল লয়ের বিচারে সেগুলো আসলেই গান কিনা তা নিয়ে না হয় বিশেষজ্ঞরা তর্ক করুক। তবে গানে গানে সময়টা কাটল বেশ। তাদের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গলাও মিলাল সবাই। ক্যাম্পাস থেকে মহেড়া জমিদার বাড়ির দূরত্বৃ ৮৩ কিলোমিটার যেন এক মুহূর্তেই পৌঁছে গেলাম। মহেড়া জমিদার বাড়ি গিয়ে দেখা হলো বিশ^বিদ্যালয়ের সিনিয়র, মহেড়া পুলিশ ক্যাম্পের সহকারী পুলিশ কমিশনার শরিফুল ইসলাম ভাইয়ের সঙ্গে। পুরো জায়গাটা তিনি আমাদের ঘুরে ঘুরে দেখালেন অনেকটা সময় নিয়ে। প্রধান গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল জমিদার বাড়ির দৃষ্টিনন্দন সব ভবন। যেখানে নীল আকাশ, ছোট করে ছেঁটে রাখা সবুজ ঘাসের কার্পেট, শতবর্ষের সহস্রাধিক স্মৃতি বিজড়িত সুরমা ভবনসমূহ সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে দর্শনার্থীদের অপেক্ষায় থাকে। যা জমিদার বাড়ির পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যের কথা, শাসনের কথা, সে-সময়ের বিচার ব্যবস্থার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। জমিদার বাড়ি মানেই তো অপূর্ব কারুকাজ করা বিশাল অট্টালিকা। যার প্রতিটি দেয়ালের পরতে পরতে রয়েছে ঐতিহ্য আর সৌন্দর্যের ছোঁয়া। কালের বিবর্তনে ফুলে-ফলে, পত্র-পল্লবে শোভিত হয়ে উঠেছে বিশাল এলাকাজুড়ে অবস্থিত কালের সাক্ষী এ জমিদার বাড়ি। সহসা দেখলে মনে হয়- অতীত প্রতাপের কলরব তুলে সবুজ ঘাষের কোলজুড়ে ফুটে আছে বিশাল শে^তপদ্ম। এই বাড়িটি ১৮৯০ দশকের পূর্বে স্পেনের করডোভা নগরের আদলে নির্মিত। লোককথায় প্রচলিত, কালীচরণ সাহা ও আনন্দ সাহা নামে দুই ভাই কলকাতায় লবণ ও ডালের ব্যবসা করে প্রচুর অর্থ রোজগার করে চলে আসেন মহেড়া গ্রামে। এরপর তারা সুবিশাল বাড়িটি নির্মাণ করেন। ব্রিটিশ আমলে জমিদার প্রথা চালু হলে আশপাশের কিছু এলাকা কিনে নেয় তাদের সন্তানরা। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক বাহিনী মহেড়া জমিদার বাড়িতে হামলা করে এবং কূলবধূসহ পাঁচজন গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। পরে এখানেই মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। স্বাধীনতার পর জমিদার বাড়িটি পুলিশ ট্রেনিং স্কুল হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়। পরে এটাকে পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে উন্নীত করা হয়। এরপর ব্যাপক সংস্কার কাজ চালানোর পর বাড়িটির বর্তমান এই রূপ দাঁড়িয়েছে। জমিদার বাড়িতে চৌধুরী লজ, মহারাজা লজ, আনন্দ লজ ও কালীচরণ লজ নামে চারটি ভবন রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে নায়েব ভবন, কাছারি ভবন ও রানী মহল। প্রতিটি স্থাপনাতে শিল্পীর হাতে করা অসাধারণ কারুকার্য দেখে অভিভূত হতে হয়। সময় ও সভ্যতার বিবর্তনে জমিদার প্রথা বিলুপ্ত হলেও ঐতিহাসিক সাক্ষী হয়ে আজও টিকে আছে মহেড়া জমিদার বাড়ি। জমিদার বাড়িটির সামনেরই রয়েছে ‘বিশাখা সাগর’ নামে বিশাল এক দীঘি। রোদের তেজ ছিল প্রচণ্ড। ঘুরতে ঘুরতে প্রথমে আমাদের চোখে পড়ল কালীচরণ লজের সামনে চোখ ধাঁধানো নকশার একতলা ভবন যা বর্তমানে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। অগত্যা জমিদার বাড়ির জাদুঘরে আশ্রয় নিয়ে রোদ থেকে পালিয়ে বাঁচলাম। জাদুঘরের প্রতিটি বিষয়বস্তু সময় নিয়ে ভাল করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার সুযোগও মিলল। জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে জমিদারদের ব্যবহৃত নানা তৈজসপত্র। এ ছাড়াও সে আমলে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধাতব মুদ্রা এবং সৈন্যদের ব্যবহৃত বিভিন্ন অস্ত্রও সংরক্ষিত রয়েছে। জাদুঘর থেকে বেরিয়ে পাশেই চৌধুরী লজ। এই ভবনের সঙ্গে কালীচরণ লজ এমন জ্যামিতিক বিন্যাসে তৈরি করা হয়েছে, দূর থেকে দেখলে একে কালীচরণ লজের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে হবে। প্রাসাদ কমপ্লেক্সে প্রবেশ করার জন্য কালীচরণ লজ আর চৌধুরী লজের সামনে রয়েছে দুটি সিংহ দরজা। চৌধুরী লজের পেছনে রয়েছে এক তলা আরেকটি ভবন, যা বর্তমানে অতিথি ভবন নামে পরিচিত। ভবনটির সামনের দিকে অনুচ্চ স্তম্ভের ওপরে নির্মিত ত্রিফল আর্চযুক্ত প্রবেশদ্বার আছে। অলঙ্করণের দিক থেকে আনন্দ লজটিকে সবচেয়ে শৈল্পিক মনে হয়। প্রাসাদের সম্মুখভাগে দোতলা পর্যন্ত লম্বা ছয়টি কোরাস্থির স্তম্ভ^, সামনের দিকে দু’পাশে কারুকাজ করা দুটি ভ্যানিসিয় ঝুলন্ত বারান্দা, ছাদের রেলিং এবং কার্নিশে ফুলের মালা আর জ্যামিতিক অলঙ্করণ প্রাসাদটিকে অনুপম সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তুলেছে। দু’পাশের বারান্দার উপরে প্যাঁচানো ধাঁচের লোগো দেখে মনে হয়- এটি মহেড়া জমিদার বাড়ির সিল। জমিদার বাড়ির সর্বপশ্চিমের ভবনের নাম মহারাজ লজ। এই লজ হচ্ছে সর্র্ববৃহৎ স্থাপনা, যা ছিল জমিদার গজেন্দ্র কুমার রায় চোধুরীর আবাসন। উল্লিখিত স্থাপনা ছাড়াও এই জমিদার কমপ্লেক্সের পেছনের দিকে রানী মহল, কর্মচারীদের থাকার জন্য নায়েব ভবন ও দাফতরিক কাজের জন্য কাছারি ভবন নামে দুটি একতল ভবন আছে। ভবনের পেছনে রয়েছে শিশু পার্ক আর মিনি চিড়িয়খানা। পার্কের পাশেই পাসরা পুকুর এবং সঙ্গে লাগোয়া রানী পুকুর। পাসরা পুকুরের পেছনে মিনি পিকনিক স্পট। টাঙ্গাইলের নটিয়াপাড়ার মহেড়ায় চৌধুরী লজ নামে পরিচিত এই অনন্য সুন্দর সাদা ধবধবে জমিদার বাড়ি বেশ কয়েকটি প্রাসাদ নিয়ে গঠিত। বর্তমানে এটি বাংলাদেশ সরকারের অধীন পুলিশ প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। সরকারের নিয়মিত সংরক্ষণের সুবাদে আজও বাড়িটির চাকচিক্য বহাল রয়েছে। মহেড়া এখন পিকনিক স্পট, পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার। তবে ইতিহাস খোঁজা মানুষের কাছে মহেড়া হাসি-কান্না আর্তনাদের ইতিহাস। ঘুরতে ঘুরতে সবাই যখন ক্লান্ত। তখনই ডাক এলো দুপুরের খাবার খাওয়ার। খাওয়ার পর দেখলাম হাতে এখনো বেশ সময় আছে। তখনই রওনা দিলাম মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^দ্যিালয়ের দিকে। আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি দীপঙ্কর দাস।
×