ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মোমিন মেহেদী

কর্মময় স্মৃতিময় সব্যসাচী

প্রকাশিত: ২১:৩৮, ২৫ ডিসেম্বর ২০২০

কর্মময় স্মৃতিময় সব্যসাচী

আমি একটুখানি দাঁড়াব। বাংলাদেশে স্বাধীনতা-স্বাধিকার-রাজনীতি-অর্থনীতি-শিক্ষা-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক-সামাজিক কর্মময় অগ্রসরতায় অনবদ্য দাঁড়ানোর স্বপ্ন বোনার কবিতার শিরোনাম। এই শিরোনামের মধ্য দিয়ে আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতি তাঁর অমোঘ ভালবাসা-শ্রদ্ধার্ঘ্য গড়েছেন সৈয়দ শামসুল হক। তিনি নিবিড় ভালবাসায় লিখেছেন- আমি একটুখানি দাঁড়াব এবং দাঁড়িয়ে চলে যাব; শুধু একটু থেমেই আমি আবার এগিয়ে যাব; না, আমি থেকে যেতে আসিনি; এ আমার গন্তব্য নয়; আমি এই একটুখানি দাঁড়িয়েই এখান থেকে চলে যাব। সময়ের রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে যেতে তিনি মায়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংসারের হাল যেমন ধরেছেন, তেমনি নিপুণ কবিতা-কথাশিল্পে প্রত্যয়ে তৈরি করেছেন নিজস্ব স্বকিয়তা। যে কারণে আজ তিনি চলে গেলেও রয়ে গেছে তাঁর প্রচুর কাজ। রয়ে গেছে ছাত্র-যুব-জনতার জন্য নিরন্তর রাজকথা-কাজকথা। তাঁর সমসাময়িক কবি-কথাশিল্পীরা যখন নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেছেন, তখন সকল লোভ মোহহীনতার উর্ধে থেকে করেছেন দেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে নির্মাণশৈলী। কখনও কখনও সকল চাহিদার কথাকে ছুড়ে ফেলে একাট্টা হয়েছেন নির্মল দেশের উজ্জ্বল আগামী গড়ার কারিগরদের সঙ্গে। সবাইকে পেছনে ফেলে তাঁর এগিয়ে চলা সহ্য না হলেও তাঁর সমসাময়িক একান্ত বাধ্য হয়েই সঙ্গে ছিলেন। যখন নিরন্তর রাজনীতি-শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে তিনি উজ্জ্বল লেখালেখির কারণে; সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হককে কেউ কেউ চেষ্টা করেছেন থামিয়ে দিতে। হয়ত তা উপলব্ধি করতে পেরেই কবি বরাবরের মতো শিল্পসাহসের সঙ্গে লিখেছেন- আমি চলে যাব তোমাদের এই শহরের ভেতর দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি এর মার্চপাস্টের যে সমীকরণ এবং এর হেলিকপ্টারের যে সংক্রমণ, তার তল দিয়ে তড়িঘড়ি; আমি চলে যাব তোমাদের কমার্শিয়াল ব্লকগুলোর জানালা থেকে অনবরত যে বমন সেই টিকার-টেপের নিচ দিয়ে এক্ষুনি; আমি চলে যাব তোমাদের কম্পিউটারগুলোর ভেতরে যে বায়ো-ডাটার সংরক্ষণ তার পলকহীন চোখ এড়িয়ে অবিলম্বে; আমি চলে যাব যেমন আমি যাচ্ছিলাম আমার গন্তব্যের দিকে ধীরে ধীরে বহুকাল ধরে আমি একটি দুটি তিনটি প্রজন্ম ধরে। সাহসের-সত্যের-স্বচ্ছতার সাহসমানুষ সৈয়দ হক তার বৈচিত্র্যময় জীবন ও লেখায় আমাদেরকে ঋদ্ধ করেছেন বারবার। চলে যাওয়ার পরও যিনি নির্মাণের কারণে ভাস্বর হয়ে আছেন ভালবাসায়। ‘খেলারাম খেলে যা’ থেকে শুরু করে ‘তরঙ্গের অস্থির নৌকায়’ পর্যন্ত প্রতিটি গ্রন্থে তিনি নিরেট সাহসকারিগর। এই সাহসের জন্য সবাই যখন স্রোতে গা ভাসিয়েছেন, তিনি ছিলেন উল্টোপথের পথিক। বলতে পারি উজানের রোদেলাগাহন। দীর্ঘ পথ চলার ধারাবাহিকতায় বাংলা সাহিত্য জগতে সৈয়দ শামসুল হকের পরিচয় ‘সব্যসাচী লেখক’ হিসেবেই কেবল পরিচত নন; পরিচিত হন স্বাধীনতা-স্বাধিকার-অধিকারের কবি-সংগঠক হিসেবে। তাঁর প্রমাণ আমরা পেয়েছি ছাত্র-যুব-জনতার মেলবন্ধনে নিজস্ব অবস্থান। দীর্ঘ সাহিত্য জীবনে তিনি তার মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস এবং নাটকসহ শিল্প-সাহিত্যের নানা অঙ্গনে। বাঙালী মধ্যবিত্ত সমাজের আবেগ-অনুভূতি-বিকার সবই খুব সহজ কথা ও ছন্দে উঠে এসেছে তার লেখনীতে। আমার প্রথম উপন্যাস ‘ডিভোর্স’ উৎসর্গ করেছিলাম কালের কিংবদন্তি সাহিত্যজন সৈয়দ শামসুল হককে। সেই সুবাদে ২০০৪ সাল থেকেই পরিচয় হয়। হয় স্নেহ পাওয়ার সুযোগও। তাঁর জন্ম ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা কুড়িগ্রামে। আট ভাই-বোনের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিলেন সৈয়দ হক। সাহিত্য ইতিহাস বলে- ১৯৫১ সালে ‘অগত্যা’ নামে একটি ম্যাগাজিনে তার প্রথম প্রকাশিত লেখাটি ছিল একটি গল্প। এরপর তার প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন সাহিত্যের নানা ক্ষেত্রে। ১৯৬৬ সালে পান বাংলা একাডেমি পুরস্কার। সৈয়দ শামসুল হকের রচনায় সমসাময়িক বাংলাদেশকে তুলে ধরা হয়েছে। আগের বড় লেখকেরা সকলেই গ্রামকেন্দ্রিক উপন্যাস বা গল্প লিখেছেন। সৈয়দ শামসুল হক নতুন উদীয়মান মধ্যবিত্তের কথা ভাল করে বললেন এবং মধ্যবিত্ত জীবনের বিকারকেও তিনি ধরলেন। সৈয়দ শামসুল হক স্কুলজীবন শেষ করেন কুড়িগ্রামে। এরপর ১৯৫১ সালে মুম্বাইতে গিয়ে কিছুদিন একটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থায় কাজ করেন। পরবর্তীতে জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিভাগে ভর্তি হন। সেখানে পড়ালেখা শেষ না করেই পুরোদমে লেখালেখি শুরু করেন। প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’। কর্মময় অনবদ্য দীর্ঘজীবনে তিনি অনেক উপন্যাস লিখেছেন। তার অনুজ এবং তরুণ লেখকেরা প্রভাবিত হয়েছেন তার লেখায়। তাদের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘হক ভাই’ নামে। সৈয়দ শামসুল হক। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় মার্জিনে মন্তব্য নামে একটি কলাম লিখতেন। সেখানে তিনি লেখালেখির করণ কৌশল, কিভাবে লিখতে হয় সেই বিষয়ে লিখেছিলেন। বিদেশে এ ধরনের অনেক বই পাওয়া যায়, কিন্তু বাংলাদেশে লেখালেখির করণ কৌশল নিয়ে তেমন কোন বই ছিল না। সৈয়দ শামসুল হকই একমাত্র লেখক যিনি এই বিষয়ে অনেকের ভালবাসা-শ্রদ্ধাদৃষ্টি প্রথম আকর্ষণ করেন। সৈয়দ শামসুল হক কবি হিসেবেও পরবর্তী প্রজন্মের কবিদের জন্য পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থ, বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা। আধুনিক সময়ে কোন কবির এত দীর্ঘ কবিতা বেশ বিরল। তার এই কাব্যগ্রন্থের কারণে তিনি তখন আদমজী পুরস্কার লাভ করেন। তার আরেক বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘পরানের গহীন ভেতর’ দিয়ে তিনি তাঁর কবিতায় আঞ্চলিক ভাষাকে উপস্থাপন করেছেন। কবিতায় তার ধারাবাহিকভাবে যে অবদান তা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। সৈয়দ হককে অনুসরণ করে সেই সময়ের এবং পরবর্তী কবিগণ আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা লেখার চেষ্টা করেছেন। তার ‘খেলারাম খেলে যা’ অনুকরণ করে আমাদের কথাসাহিত্যিকেরা লিখেছেন। বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ হকের অবদানকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। সংবাদপত্রের সঙ্গেও ছিলেন নিরলস সৈয়দ শামসুল হক। তার কর্মজীবনের প্রায় সাত বছর কাটিয়েছেন লন্ডনে বিবিসি বাংলা বিভাগের সয়েমড়। বিবিসি বাংলা থেকে সংবাদ পরিবেশন করেছেন ১৯৭১ সালে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে। তিনি নাটক এবং অভিনয়ে আগ্রহী ছিলেন, নির্দেশনাও দিয়েছেন। বিশেষ করে ক্লাসিকাল নাটকের অনুবাদে তার আগ্রহ ছিল। নাট্যকার হিসেবেও সৈয়দ শামসুল হক ছিলেন দারুণ সফল। বিশেষ করে তাঁর রচিত দুটি কাব্যনাট্য ‘নুরলদিনের সারাজীবন’ এবং ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ বাংলা নাটকে একটি বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে। নাগরিক নাট্যদলের হয়ে নুরলদিনের সারা জীবন নাটকটির অন্যতম একটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন আসাদুজ্জামান নুর। তাঁর নাটক নির্মাণ করেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত নতুন প্রজন্মের প্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাতা শাহনেওয়াজ কাকলী। অনেক কাজের মাঝে জীবনময় আলোকিত হয়ে আছেন সৈয়দ হক। তার যে শব্দের ব্যবহার, রূপকল্প, কাব্যময়তা এবং তার সঙ্গে সঙ্গে নাটকের যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত এই সমস্ত কিছু তিনি যেভাবে ধারণ করেছেন বাংলা নাটকে এই ঘটনা আর কেউ ঘটাতে পেরেছে বলে আমি মনে করি না। শিল্পক্ষেত্রে সৈয়দ শামসুল হকের অবদান শুধু নাটকেই সীমাবদ্ধ নয়, তিনি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছেন, এমনকি চলচ্চিত্রের জন্য গানও রচনা করেছেন। পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। তাঁর রচিত ‘হায়রে মানুষ, রঙ্গিন ফানুস’ গানটি এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। আমাদের সাহিত্যিকদের মধ্যে সৈয়দ শামসুল হক ভাষার ব্যবহার নিয়ে যে লিখেছেন ‘হৃৎকলমের টানে’ বা ‘কথা সামান্যই’ এগুলো কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তিনি একইসঙ্গে একজন সৃষ্টিশীল লেখক এবং ভাষার ব্যবহারে ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। এ কথাও সত্য যে, যদি অন্য সব বাদ দিয়ে দুটো বই লিখতেন তিনি ‘পরানের গহীন ভেতর’ এবং ‘বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা’ তাহলে এ দুটো বই তাকে অমর করে রাখত। ১৯৬৬ সালে মাত্র ২৯ বছর বয়সে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। এ যাবতকালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত সব সাহিত্যিকের মধ্যে তিনিই সর্বকনিষ্ঠ; বাংলা সাহিত্যে যা একটি বিরল অর্জন। পঞ্চাশের দশক থেকে সৈয়দ শামসুল হক বিচিত্র রচনায় সমৃদ্ধ করে গেছেন বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডার। এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা শতাধিক। শত শত বইয়ের মাঝে জীবনের বীজ বুনে গেছেন নিবেদিত মানুষ সৈয়দ শামসুল হক। কালের বিবর্তনে নিরন্তর তাঁর সাহিত্য ও জীবনকর্ম আমাদেরকে কঠিন সকল সময়ের মুখোমুখি করতে তৈরি রাখবে বিনয় ভালবাসার সাহিত্য-সংস্কৃতি; যা রেখে গেছেন নিমগ্নতায়-আন্তরিকতায়...
×