ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সব্যসাচী দাশ

অরুণ আলোয়...

প্রকাশিত: ২৩:৩৩, ২৪ ডিসেম্বর ২০২০

অরুণ আলোয়...

গত কয়েক দিন ধরে রাজধানীতে চলছে পৌষের শাসন, সঙ্গে করোনার চোখ রাঙানি। এমন সময় পরিচিত কিংবা প্রিয়জন সবাই যখন দূরে, তখন অরুণ আলোর আভা নিয়ে আনন্দকণ্ঠের মুখোমুখি হলেন- নন্দিত অভিনয় শিল্পী অরুণা বিশ^াস। সরাসরি করোনাভাইরাসের ভীতিকে উপেক্ষা করে, নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালেন বহুমুখী প্রতিভাবান এই মানুষটি। সময় বেলা ১১টা, বাড়িতে ডোর বেলের আওয়াজ। দরজা খুললেন, সুমিত দা। ভেতরে তখন তার প্রস্তুতি চলছে, অবশ্য ছবি তোলার। অবশেষে সামনে এসে অভ্যর্থনা জানালেন অরুণা বিশ^াস। যদিও সময় কম গড়ায়নি তবুও দেখে যেন মনে হলো অরুণার আলো সেই প্রথম প্রভাতেই রয়ে গেছে। সৌন্দর্যের সোনালি আভা একটুও ম্লান হয়নি। হাল্কা ঠোঁট বাঁকিয়ে হৃদয়গ্রাসী সেই হাসি এখনও যৌবনেই রয়ে গেছে। এসব অভিব্যক্তি যদিও ভীষণ রোমান্টিক কিন্তু বাস্তবতার কাছে অরুণা সূর্যের মতোই তেজদীপ্ত একজন সৃজনশীল মানুষ। আলাপের শুরুতেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রথমে যখন তার সঙ্গে চলচ্চিত্র নিয়ে কথা হয়, নিজের অভিজ্ঞতা এবং অভিব্যক্তির মাধ্যমে অকপট সত্য বলে শুরু করেন, তাকে বুঝতে আমাদের অসুবিধে হয় না। আপনি আমাদের চলচ্চিত্রের সোনালি যুগের জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা জীবনের বেশিরভাগ সময় এই শিল্পের সঙ্গে রয়েছেন। বর্তমান সময়ের চলচ্চিত্র, আপনার অভিজ্ঞতা এবং প্রাপ্তি নিয়ে কি বলবেন? প্রথমত আমি বলতে চাই, আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা এমন একটা পরিবারে যেখানে প্রকৃতার্থে শিল্পী হয়ে ওঠার বিষয়টা ছিল প্রাকৃতিক ব্যাপার। আমার বাবা অমলেন্দু বিশ^াস, মা জ্যোৎস্না বিশ্বাস তাদের মতো বিদগ্ধ মানুষের স্নেহ এবং প্রকৃত শিক্ষায় আমি বড় হয়েছি। যে কারণে, ছোটবেলা থেকে আমি ভীষণ আত্মবিশ^াসী। বিশেষ করে আমার অভিনয় দক্ষতা নিয়ে। অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র ‘চাঁপা ডাঙ্গার বৌ’ আমার বিশ^াসটাকে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়। এরপর খান আতাউর রহমানের ‘পরশ পাথর’ শিল্প প্রেমের পরশ দেয়। তারপর কেবল এগিয়ে চলেছি। অভিনয় করেছি দিন-রাত এক করে। প্রতি সপ্তাহে তিন-চারটা করে ছবি রিলিজ হয়েছে, এমনও সপ্তাহ গিয়েছে আমার ১৩টা সিনেমা মুক্তি পেয়েছে! একটা সময় গিয়ে দেখলাম প্রাপ্তির জায়গাটা ছোট হয়ে আসছে। কি যেন একটা সচেতন অবজ্ঞা আমাকে ঘিরে ধরতে চাইছে। আগেই বলেছি, আমার কাজের প্রতি আমি সব সময় আত্মবিশ^াসী। যে কারণে ম্যানেজ করে চলাটা আমার কখনও হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এ ব্যাপারে মানুষের কত যে বেহায়াপনা দেখেছি! কিসের জন্য এই বেহায়াপনা? কিসের আবার! কাজের জন্য, চরিত্রের জন্য, পুরস্কারের জন্য। জীবনে এত এত সিনেমা করলাম অথচ আমাকে একটা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার দেয়া হলো না। মাঝে মাঝে নিজের পরিচয়টাকে দায়ী মনে হয়েছে। অথচ এমনও দেখেছি একজন শিল্পী একই পুরস্কার নয় বার, আঠারো বার করেও পেয়েছেন! পৃথিবীতে এমনটা কোথাও হয় বলে আমার মনে হয় না। এত কথা কেন বলছি জানেন, ওই যে জানতে চেয়েছেন আমাদের বর্তমান সময়ের চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে। আমি গত দুই বছর ধরে সেন্সর বোর্ডের সদস্য। যে কারণে প্রায় সব সিনেমাই আমাকে দেখতে হয়। কি বলব বিশ^াস করবেন না। কি সব সিনেমা যে মুক্তির জন্য আবেদন করা হয়! এক্ষেত্রে আমি বলব-প্রচুর খারাপ ছবি আসে, এর মধ্যে দু-একটা ভালো ছবি থাকে। যেমন-গত দু’দিন আগে একটা স্বল্প দৈর্ঘ্যরে চলচ্চিত্র দেখলাম, নাম ‘আড়ং’। দেখে ভীষণ ভাল লেগেছে। ‘কাঠবিড়ালী’ চলচ্চিত্র দেখেও খুব ভাল লেগেছে, ‘আবার বসন্ত’ ভাল সিনেমা ছিল। এ ছাড়া বেশিরভাগ যেসব সিনেমা ছাড়পত্রের জন্য আসে তা আসলে ঠিক সিনেমা কিনা আমি বুঝে উঠতে পারি না! এই কাজের মধ্যে থেকে একটা বিষয় আমার কাছে পরিস্কার হয়েছে, কেন শিল্পের এই অবস্থা। বলতে দ্বিধা নেই, শিল্পের নাম করে যেসব মানুষ নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি করেছে এবং জায়গা পেয়েছে। দিন শেষে আরও চাই আরও চাই বলে আওয়াজ তুলেছে, তাদের পেট ভরাতে গিয়ে আমাদের আজ এই অবস্থা। বলতে পারেন, ওইসব লোক-ই শিল্পটাকে আজ এখানে নামিয়েছে। এরা কখনও শিল্পের মঙ্গল চায়নি, কোন অবদান রাখেনি। আমি ওভার অল বললাম। আমরা জানি আপনি মঞ্চে কাজ করেছেন, কামাল উদ্দিন নীলুর মতো বড় মানুষের সঙ্গে, সেখানকার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলুন? প্রথম কথা হচ্ছে, আমার এখনও ইচ্ছে করে মঞ্চে কাজ করতে। আর অভিজ্ঞতা; এখানে প্রতিদিন একটা চরিত্রে ঢোকা যায়, আবার চরিত্রটাকে ভাঙ্গা যায়, নতুন নতুন ছায়া ফেলা যায়। মূলত মঞ্চই হলো শিল্পীর কাছে স্রষ্টার জায়গা। এবার আসি আপনার শেকড় যাত্রাশিল্পের কাছে। এত জীবন্তু এই শিল্পটা মারা গেল কিভাবে? এটা মারা যায়নি। বলতে পারেন মেরে ফেলা হয়েছে! আজ সারাদেশে যেখানে যাত্রাপালা হতো, সেখানে আজ ধর্মের নামে হিংসাত্মক বুলি ছাড়ানো হচ্ছে। জাতিগত বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। অথচ যে স্বাধীন দেশেটার জন্ম হয়েছে তার সঙ্গে এই শিল্পের একটা নিবিড় সম্পর্ক আপনি পাবেন। যাত্রাকে বাদ দিয়ে কী শিল্পচর্চা হয়! এটা সরাসরি মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের টান। বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বর্ষ চলছে, কত অনুষ্ঠান! অথচ আমরা কেউ এই শিল্পটাকে নিয়ে ভাবলাম না। এই শিল্পের জন্য আমার বাবা, ঠাকুর মার তিন শ’ ভোরি সোনা বিক্রি করেছেন। আমার মা নিরন্তর সাধনা করেছেন, আমার সৌভাগ্য এমন পিতা-মাতার সন্তান আমি। আপনি তো টিভি নাটক পরিচালনা করেছেন, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ঠিকনা বত্রিশ’ নির্মাণ করেছেন, সে প্রসঙ্গে বলুন? কাজটি ভাল হয়েছে। ছবিটি বাইরে পাঠব। আপনার অভিনীত নতুন চলচ্চিত্র? ‘শান’ নামে একটা চলচ্চিত্রের কাজ শেষ করেছি। ছবির গল্পটা ভাল। তরুণ অভিনেতা সিয়ামের কাজ ভীষণ ভাল লেগেছে। এই সময়ের আর কার কাজ ভাল লাগে? শাকিব হিরো হয়েছে তবে, ওর আশপাশের মানুষদের দূরে সরাতে পারলে অনেক বড় অভিনেতা হতে পারত! ও তো আর সারা জীবন ‘হিরো’ থাকতে পারবে না। আর নায়িকা? নুসরাত ফারিয়াকে ভীষণ পছন্দ হয়। অনেক পরিশ্রমী। চলচ্চিত্রের ভবিষ্যত কী দেখছেন? অনেক নতুন নতুন ছেলেমেয়ে আসবে কাজে লাগাতে পারবে কিনা জানি না। তবে আশা করি অন্ধকার কেটে যাবে। শিল্পের আলো ছড়িয়ে পড়বে আমাদের সবার মাঝে।
×