ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সবার জন্য করোনা ভ্যাকসিন

প্রকাশিত: ২১:৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২০

সবার জন্য করোনা ভ্যাকসিন

কোভিড-১৯ কে বধ করার জন্য গোটা বিশ্বজুড়ে ভ্যাকসিন প্রার্থীদের প্রতিযোগিতা অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। তবে কে কার আগে এই প্রতিযোগিতায় জয় লাভ করতে পারে সেই দৌড় কিন্তু এখনও শেষ হয়নি বললেই চলে। অন্যদিকে মডার্নার তরফ থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, মার্কিন ফুড এ্যান্ড ড্রাগ এ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কাছে শর্ত সাপেক্ষে এই ভ্যাকসিনকে ছাড়পত্র দেয়ার আবেদন করা হবে। তাদের তৈরি করোনা ভ্যাকসিন ৯৪.১ শতাংশ কার্যকর। এমনটাই দাবি মার্কিন ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা মডার্নার। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে ওই টিকার ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করা হবে। এমনটাই জানিয়েছে ওই মার্কিন সংস্থা। মডার্নার দাবি, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সর্বশেষ যে পরিসংখ্যান তাদের হাতে এসেছে তাতে দেখা যাচ্ছে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া ছাড়াই তাদের করোনা ভ্যাকসিন ৯৪.১ শতাংশ ক্ষেত্রে সফল। শুধু তাই নয় সঙ্কটাপন্ন রোগীদের ক্ষেত্রে তা ১০০ শতাংশ কার্যকরী। এ নিয়ে মডার্নার চীফ মেডিক্যাল অফিসার ডাঃ টাল জ্যাকস সংবাদসংস্থাকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে জানিয়েছেন, আমাদের হাতে যে ভ্যাকসিনটি রয়েছে তা অত্যন্ত কার্যকরী, এমনটাই আমরা মনে করি। এই অতিমারী দূর করার ক্ষেত্রে আমরা একটা বড় ভূমিকা নিতে পারব বলে আশা করি। জরুরী ক্ষেত্রে ব্যবহারের অনুমতি পেলেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব জায়গায় তা পাঠিয়ে দেয়া হবে। এই ভ্যাকসিন মজুদ করা অন্যান্য ভ্যাকসিনের থেকে সহজ। কারণ এটি মজুদ করার জন্য অতি-ঠাণ্ডা পরিবেশের প্রয়োজন হয় না। সাধারণত যে টিকা আবিষ্কারে এক দশকের বেশি সময় লেগে যায়, সেটা মাত্র ১০ মাসেই আবিষ্কার করেছেন অক্সফোর্ডের গবেষকরা। ব্রিটেনের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি করোনাভাইরাসের যে ভ্যাকসিনটি নিয়ে কাজ করছে, সেটির একটি ব্যাপক ট্রায়ালের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, ভ্যাকসিনটি শতকরা ৭০ ভাগ মানুষের মধ্যে কোভিড বাসা বাঁধতে দেয় না। ফাইজার ও মডার্না যখন দাবি করছে তাদের তৈরি ভ্যাকসিনের সাফল্য এক্ষেত্রে ৯৫%, তখন এই খবরকে একই সঙ্গে হতাশাব্যঞ্জক এবং বিজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। বলা হচ্ছে অন্য টিকা দুটির তুলনায় অক্সফোর্ডের টিকা হবে অনেক সস্তা, সংরক্ষণ এবং দুনিয়ার প্রতিটি কোনায় কোনায় ছড়িয়ে দেয়া হবে অপেক্ষাকৃত সহজ। সুতরাং নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ যদি এই টিকা অনুমোদন করে, সেটি মহামারী মোকাবেলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। গবেষকরা বলছেন, মানব পর্যায়ের পরীক্ষায় তারা ৭০ শতাংশ সফলতা দেখতে পেয়েছেন। তবে কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হলো, স্বেচ্ছাসেবীদের একটি অংশের মধ্যে এই টিকার ৯০ শতাংশ সফলতা পাওয়া গেছে। যাদের প্রথমে টিকার অর্ধেক ডোজ দেয়া হয়, পরে বাকিটা দেয়া হয়েছিল। যুক্তরাজ্যের জন্য এর মধ্যেই ৪০ লাখ টিকা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। আরও নয় কোটি ৬০ লাখ টিকার সরবরাহ বাকি রয়েছে। তবে যে কর্তৃপক্ষ টিকার নিরাপত্তার দিকগুলো, কার্যকারিতা এবং মানের বিষয় তদারকি করে, সেই কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দেয়ার পরেই এই টিকার ব্যবহার শুরু করা যাবে। তবে যুক্তরাজ্য একটি ব্যতিক্রমী ধরনের গণটিকা কর্মসূচী শুরু করার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। সেজন্য সর্দিকাশি বা শিশুদের টিকা দেয়ার যে বার্ষিক কর্মসূচী পালন করা হয়ে থাকে, সেখানে কিছু কাটছাঁট করা হতে পারে। বয়স্ক সেবা কেন্দ্রের বাসিন্দা আর কর্মীরা সবার আগে টিকা পাবেন। এরপরই পাবেন স্বাস্থ্যকর্মী এবং ৮৫ বছর বয়সের ওপরের ব্যক্তিরা। এরপরে বয়সের ধাপ অনুযায়ী বাকি সবাই টিকা পাবেন। অপরদিকে রাশিয়ায় কোভিড-১৯ এর টিকার যে ট্রায়াল বা পরীক্ষামূলক প্রয়োগের কাজ চলছিল তা ৯২% সফল বলে প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে। বিবিসির স্বাস্থ্যবিষয়ক সংবাদদাতা ফিলিপ্পা রক্সবি জানাচ্ছেন যে ১৬ হাজার মানুষ স্বেচ্ছায় এই ট্রায়ালে অংশ নিয়েছিলেন তাদের এক অংশকে স্পুটনিক ফাইভ নামের এই টিকা দেয়া হয়েছিল এবং বাকিদের যে ইঞ্জেকশন দেয়া হয়েছিল তাতে কোন ভ্যাকসিনের ওষুধ ছিল না। এদের মধ্যে ২০ জনের শরীরে এই টিকা ৯২% সফলতা দেখিয়েছে। কোন কোন বিজ্ঞানী এই খবরকে স্বাগত জানিয়েছেন। আবার কেউ কেউ মত দিয়েছেন খুব দ্রুত এই পরীক্ষার তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। কয়েকদিন আগেই ফাইজার এবং বায়োএনটেক কোম্পানি জানায় তাদের উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন কোভিড-১৯ প্রতিরোধে ৯০% সাফল্য দেখিয়েছে। তারা ৪৩,৫০০ মানুষের ওপর তাদের টিকা পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করেছিল। তবে স্পুটনিক ভ্যাকসিন তুলনামূলকভাবে কম মানুষের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে। ফলে এর তথ্য-উপাত্তও কমসংখ্যক পরীক্ষার ওপর নির্ভর করে দেয়া এবং পরীক্ষার আওতায় কম মানুষকে রাখার কারণে ট্রায়ালের সময় কোভিড সংক্রমণের কেসও তুলনামূলকভাবে কম ছিল। কিন্তু তারপরও প্রাথমিক এই গবেষণার ফলাফল নিশ্চিতভাবে ইতিবাচক স্পুটনিক ফাইভ টিকা তৈরি করা হয়েছে মস্কোর এপিডেমিওলজি ও মাইক্রোবায়োলজি বিষয়ক জাতীয় গবেষণা কেন্দ্রে। এই মুহূর্তে বেলারুস, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভারত এবং ভেনিজুয়েলায় তাদের উদ্ভাবিত টিকার তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিকাল ট্রায়াল চলছে। এখন পর্যন্ত এই টিকা নিরাপদ বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ এর কোনরকম অনিরাপদ প্রতিক্রিয়া এখনও দেখা যায়নি। রুশ গবেষকরা বলছেন এই টিকা দুটি ডোজে প্রয়োগ করার প্রয়োজন হবে এবং যারা স্বেচ্ছায় এই ট্রায়ালে অংশ নিচ্ছে তাদের মধ্যে প্রথম ডোজটি দেয়ার ২১দিন পরও অপ্রত্যাশিত কোন নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। এখনও অনেক দূর যেতে হবে। এটা অন্তর্বর্তীকালীন তথ্য-উপাত্ত। ফাইজার এবং বায়োএনটেকের ভ্যাকসিন ট্রায়ালের মতো স্পুটনিক ভাইভ ট্রায়ালও এখন আরও তথ্য সংগ্রহ করছে। পূর্ণাঙ্গ এবং চূড়ান্ত রিপোর্ট এখনও প্রকাশ করা বা বিশ্লেষণ করা হয়নি। ফাইজার এবং স্পুটনিক দুটো ভ্যাকসিনেরই পরীক্ষা থেকে এখনও কিছু প্রশ্নের উত্তর জানা যায়নি। যেমন-কোভিড-১৯ সংক্রমণ যার সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে রয়েছে বয়স্ক জনগোষ্ঠী। এই দুটি সংস্থার উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন তাদের জন্য কতটা কার্যকর এবং সাফল্যের দাবিদার, কতদিনের জন্য মানুষকে সুরক্ষা দিতে পারবে অর্থাৎ টিকা দেবার ফলে যে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হবে তার মেয়াদ কতদিন হবে? বয়স্ক লোকদের টিকা দেয়া খুব কঠিন। চীনের কোভিড ভ্যাকসিনের পরীক্ষা স্থগিত করেছে ব্রাজিল। বিশ্বজুড়ে কোভিড প্রতিরোধে কয়েক’শ টিকা উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা চলছে এবং এগুলোর মধ্যে যে তিনটি এখন পরীক্ষার চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে সেগুলো হলো- স্পুটনিক, ফাইজার এবং অক্সেফার্ডের ভ্যাকসিন। ফাইজারের ভ্যাকসিনে করোনাভাইরাস জিনের সঙ্কেতবাহী অংশ মানুষের শরীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রবেশ করানো হবে যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে এই ভাইরাস ঠেকানোর জন্য তৈরি করবে। অন্য দুটি ভ্যাকসিন কাজ করবে ভিন্ন উপায়ে। স্পুটনিক ফাইভ আর অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের মাধ্যমে শরীরে যে ভাইরাস প্রবেশ করানো হবে সেটি তৈরি করা হচ্ছে ঠিক করোনাভাইরাসের গঠন ও আচরণ নকল করে হুবহু একই জিন অনুকরণ করে ক্ষতিকর নয় এমনভাবে সৃষ্ট ভাইরাস। অন্যদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফে সুসংহতভাবে ভ্যাকসিন বিতরণের জন্য যাবতীয় পরিকল্পনা সেরে ফেলার পরামর্শ দেয়া হলো। অনেকেই মনে করছেন হু’র এই নির্দেশিকার অর্থ, দ্রুত করোনার ভ্যাকসিন তৈরি হওয়ার ব্যাপারে সত্যিই আশাবাদী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। হু’র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রিজিওনাল ডিরেক্টর ডাঃ পুণম ক্ষেত্রপাল সিং বলছেন, বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের মতো এই এলাকাতেও ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। তবে এই ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া রুখতে আমাদের শক্তিশালী নেতৃত্ব এবং সুসংহত জনস্বাস্থ্য পরিষেবায় নজর দিতে হবে। শীঘ্রই করোনা টিকার প্রস্তুতি নিয়ে আশাবাদী হু। সুতরাং, সব দেশকেই এখন উপযোগী এবং সহযোগিতাপূর্ণ একটা পরিকল্পনা করতে হবে, যাতে সবার কাছে সহজেই ভ্যাকসিন পৌঁছে দেয়া যায়। ডাঃ পুণম ক্ষেত্রপাল সিং বলছেন, বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিন আবিষ্কারের প্রক্রিয়া গতি পেয়েছে। তবে, শুরুর দিকে সম্ভবত আমাদের হাতে কম পরিমাণ ভ্যাকসিন থাকবে। তাই ভ্যাকসিন বিতরণের স্পষ্ট পরিকল্পনা থাকাটা ভীষণ জরুরী। হু’র ওই আধিকারিক বলছেন, আমাদের লক্ষ্য হবে শুরুর দিকে এমন মানুষের কাছে এই ভ্যাকসিন পৌঁছে দেয়া যাদের প্রাণহানির ঝুঁকি বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সব দেশকে প্রস্তাব দিচ্ছে, শুরুতে ঝুঁকিপূর্ণ নাগরিকদের ভ্যাকসিন দেয়ার জন্য পরিকল্পনা প্রস্তুত রাখুন। অপরদিকে এক সতর্ক বার্তায় ইন্টারপোলের মহাপরিচালক জারগেন স্টোক বলেন, বিশ্ববাজারে করোনার নকল ভ্যাকসিন বিক্রি করতে পারে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র। এ জন্য বিশ্বের সব দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে সাবধান থাকার পরামর্শ দিয়ে বৈশ্বিক সতর্কতা জারি করেছে ইন্টারপোল। লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট [email protected]
×