ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নির্বাচন কমিশন নয়- সরকারই টার্গেট

প্রকাশিত: ২১:২৭, ২৩ ডিসেম্বর ২০২০

নির্বাচন কমিশন নয়- সরকারই টার্গেট

বিএনপি অবশেষে ব্যাকডোর রাজনীতির আশ্রয় নিয়েছে। সম্মুখ সমরে না পেরে এখন তাদের বুদ্ধিজীবীদের একজোট করে মাঠে নামিয়েছেন সরকারের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য। এ জন্য তারা মুষ্টিমেয় কয়েকজন ভাল মানুষকেও সঙ্গে নিয়েছেন। যেমন শাক দিয়ে মাছ ঢাকা হয়, তেমনি বিএনপির বুদ্ধিজীবীদের নামের সঙ্গে এই নামগুলো মিশিয়ে তারা জনসাধারণকে বোঝাতে চেয়েছে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম ও নির্বাচনে অসদাচরণের অভিযোগ জানিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে যারা চিঠি পাঠিয়েছেন তারা দল-নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী। নির্বাচন কমিশন গুরুতর আর্থিক অনিয়ম করেছে কিনা আমি জানি না। রাষ্ট্রপতি যদি ৪২ জন বুদ্ধিজীবীর এই আবেদন গ্রহণ করে এ সম্পর্কে কোন তদন্তের আদেশ দেন তাতেও কারও অখুশি হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু এমন এক সময়ে এই বুদ্ধিজীবীরা একজোট হয়ে হঠাৎ ‘দেশপ্রেমে’ উদ্বুদ্ধ হয়ে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে নেমেছেন, যখন সরকার একদিকে করোনাভাইরাস এবং অন্যদিকে ভাস্কর্যকে কেন্দ্র করে মৌলবাদীদের উত্থান দমনে ব্যস্ত। ভাস্কর্য তৈরিকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করে যখন হেফাজতীরা দেশে একটি মৌলবাদী উত্থান ঘটাতে চায়, ঠিক তার পাশাপাশি বিএনপির বুদ্ধিজীবীদের একজোট হয়ে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে মাঠে নামার মধ্যে একটা রাজনৈতিক কার্যকারণ আছে বলে কেউ সন্দেহ করলে তাকে উড়িয়ে দেয়া যাবে কি? সরকারকে এখন এক ফ্রন্টে নয়, দুই ফ্রন্টে প্রতিরোধ যুদ্ধে নামতে হবে। এক ফ্রন্টে হিংসাশ্রয়ী মৌলবাদ, অন্যফ্রন্টে বিএনপির বুদ্ধিজীবীদের জোটবদ্ধ অভিযান। হেফাজতীদের পেছনেও রয়েছে বিএনপি ও জামায়াত। সরকারকে এখন তাদের রাজনৈতিক স্ট্রাটেজি ঠিক করতে হবে। দুই ফ্রন্টেই তারা কি আপোসের পথ ধরবেন? না, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এই দুই ফ্রন্টের চক্রান্তই ব্যর্থ করার জন্য শক্ত অবস্থান গ্রহণ করবে। সরকার যদি আপোসের নীতি গ্রহণ করে তাহলে বিএনপি-জামায়াতের ব্যাকডোর রাজনীতি সফল হবে। সম্মুখ সমরে হেরে গিয়ে এখন যে তারা পেছনের রিজার্ভ ফোর্স দিয়ে আঘাত করতে চাইছে, প্রাথমিকভাবে তা সফল হয়েছে ভাববে এবং প্রকাশ্য আঘাত হানার জন্য প্রস্তুতি নেবে। ৪২ জন বুদ্ধিজীবী রাষ্ট্রপতির কাছে যে অভিযোগ করেছেন সে সম্পর্কে আমার কিছু বলার নেই। আমার বলার কথা, এই অভিযোগকারীদের রাজনৈতিক চরিত্র এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে। অভিযোগপত্রে স্বাক্ষরদানকারী ব্যক্তিদের চৌদ্দ আনার নামের দিকে সহৃদয় পাঠক নজর বুলিয়ে দেখুন। মাত্র গুটিকয়েক নাম ছাড়া আর সকলেই বর্তমান সরকারের ট্রাডিশনাল সমালোচক। সুজন, ট্রান্সপারেন্সি ইত্যাদি নানা নামে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এরা সরকারের সমালোচক। নিরপেক্ষতার নামাবলি গায়ে এরা এতদিন বিএনপি-জামায়াতের ঢোলটিই বাজিয়ে এসেছেন। প্রিন্ট মিডিয়ায়, টেলিভিশনের টক শোতে এরা বিএনপি সমর্থক বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত। আমি এদের নামগুলো এখানে উল্লেখ করতে চাই না। গন্ধ দিয়ে যেমন বোঝা যায় কোন্টি গোলাপ এবং কোন্টি গান্ধা ফুল, এদের বেলাতেও তাই। এই শিবিরের নেতা ড. কামাল হোসেন নিজের নামটি এদের সঙ্গে যুক্ত করেননি, তার প্রতিনিধি হিসেবে তার স্ত্রী আছেন। এতদিন এরা সুজন, ট্রান্সপারেন্সি ইত্যাদি নামে সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অপশাসন ইত্যাদির অভিযোগ জানিয়ে এসেছে। বিএনপির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে জাতীয় সংসদ থেকে ইউনিয়ন পরিষদ সকল নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ভিন্ন ভিন্ন ফ্রন্ট থেকে কথা বলে জনসাধারণের মধ্যে সাড়া জাগানো যায় না। তাই জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মতো তাদের এই বুদ্ধিজীবী জোট। কথাগুলো বলছেন তারা বিএনপি-জামায়াতের। কিন্তু জোটের সাইনবোর্ডটা রেখেছেন নিরপেক্ষতার। আগে একক কণ্ঠে কথা বলেছেন, এখন কণ্ঠগুলো এক করেছেন। পাঠক, অতীতের খবরের কাগজের পৃষ্ঠা উল্টে দেখবেন, ৪২ বুদ্ধিজীবীর যুক্ত বিবৃতিতে যা বলা হয়েছে, অতীতেও তারা এই কথাগুলোই বলে আসছেন। বর্তমান সরকার এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশন দুই-ই ছিল তাদের আক্রমণের টার্গেট। এবার সম্ভবত কৌশলগত কারণে সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ না তুলে কেবল নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। কারণ তারা জানেন কান টানলে মাথা আসে। যেসব অভিযোগ তুলে তারা নির্বাচন কমিশনকে ঘায়েল করতে চেয়েছেন, তাতে নির্বাচন কমিশন ঘায়েল হলে সরকারও ঘায়েল হবে। যেসব নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার ক্ষমতায় আছে, তার সবগুলোই অবৈধ বলে মেনে নিতে হবে। কী চমৎকার কৌশল! সরকারের পদত্যাগ দাবি না করে কৌশলে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার দাবি। বিএনপি-জামায়াতের এই ব্যাকডোর রাজনীতিকে বাহবা দিতে হয়। ৪২ বুদ্ধিজীবীর অভিযোগ যদি নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির হতো, তা অবশ্যই বিবেচনার যোগ্য হতো। কিন্তু আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটানোর যে সূক্ষ্ম কারসাজি যোগ করে দেয়া হয়েছে, তাতে এই ৪২ বুদ্ধিজীবীর মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে। তাদের সঙ্গে যে দু’চারজন ভাল মানুষ আছেন, যেমন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সুলতানা কামাল প্রমুখ তারাও সঙ্গদোষে কালিমালিপ্ত হলেন। আসলে তারা ভাল মানুষ। বাংলাদেশের রাজনীতি এখন দ্রুত আবার চক্রান্তের রাজনীতিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। এটাই শঙ্কার বিষয়। একা শেখ হাসিনা কত ফ্রন্টে লড়বেন? বিএনপি-জামায়াত এবার নিজেরা সামনে না এসে পেছনের শক্তিকে কাজে লাগিয়েছে। অন্যদিকে মৌলবাদীদের উস্কে দিয়েছে। এই দুই চক্রান্তকেই প্রতিহত ও পরাজিত করার জন্য দেশের অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রমনা বুদ্ধিজীবীদের একজোট হয়ে মাঠে নামা দরকার। এই ৪২ বুদ্ধিজীবীর মুখোশ খুলে দিয়ে তাদের অভিযোগপত্রের পেছনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটি জনসাধারণকে জানিয়ে দিয়ে এই চক্রান্ত ব্যর্থ করা প্রয়োজন। নির্বাচন কমিশনে যদি কোন আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়ে থাকে তার তদন্ত হোক। তদন্তে দোষ প্রমাণ হলে দোষীদের শাস্তি হোক। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে যারা রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য জোটবদ্ধ হয়ে মাঠে নেমেছেন, তাদেরও ছদ্মবেশটা খুলে দেয়া হোক। ৪২ বুদ্ধিজীবীর মধ্যে এমন বেশ কিছু নাম আছে, যাদের নামই তাদের পরিচয়ের গন্ধ ছড়ায়। তাদের অনেকের চরিত্রও ধোয়া তুলসীপাতার মতো। জনগণকে এদের সম্পর্কে সচেতন করার জন্য গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের উচিত ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নামা। আমার দুঃখ হয়, ফজলে লোহানী ও মাহবুবুল আলমের মতো বুদ্ধিজীবী আমাদের মধ্যে বেঁচে নেই। তাদের সম্পাদিত ‘অগত্যা’ ও ‘সীমান্ত’ কাগজটিও আজ নেই। তৎকালীন মুসলিম লীগ ঘেঁষা প্রবীন বুদ্ধিজীবীদের (যেমন মওলানা আকরম খাঁ, কবি গোলাম মোস্তফা, কবি মোফাখখারুল ইসলাম প্রমুখ) ব্যঙ্গাত্মক লেখার কশাঘাতে তারা কোণঠাসা করে ফেলেছিলেন। আমাদের তরুণ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অনেকে আছেন, যাদের হাতে তীক্ষèধার কলম আছে। তাদের উচিত আজ জোটবদ্ধ হওয়া এবং এই পেঁচক শ্রেণীর কুবুদ্ধিজীবীদের কবল থেকে সমাজ ও দেশকে মুক্ত করার জন্য এগিয়ে আসা। [লন্ডন, ২২ ডিসেম্বর মঙ্গলবার, ২০২০]
×