ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে

ভাঙ্গার বিরুদ্ধে ভাস্কর্য গড়া হলো, মানুষই দাঁড়াল শিল্পকর্ম হয়ে

প্রকাশিত: ২২:১৮, ২০ ডিসেম্বর ২০২০

ভাঙ্গার বিরুদ্ধে ভাস্কর্য গড়া হলো, মানুষই দাঁড়াল শিল্পকর্ম হয়ে

মোরসালিন মিজান ॥ বাঙালীর সংগ্রামের ইতিহাস ধারণ করে আছে যে শহীদ মিনার, তার ঠিক সামনে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে গড়া হলো প্রতিবাদী ভাস্কর্য। ছবি আঁকা হলো। ছিল পারফর্মেন্স আর্টও। এভাবে ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমে ভাস্কর্য ভাঙ্গার প্রতিবাদ জানানো হলো। শনিবার শিল্পকর্ম সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিবাদ গড়ে তুলে ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ।’ একাত্তর ঘনিষ্ঠ এই ব্যানারে মূলত সমবেত হয়েছিলেন চারুশিল্পীরা। তাদের সঙ্গে যোগ দেন অন্যান্য অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। সকাল ১১টায় তুলি হাতে কর্মসূচীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ। এ সময় সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, মূল আয়োজক শিল্পী মনিরুজ্জামানসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। মাইকে অল্প বিস্তর কথা হয়েছে। ছিল কবিতা এবং গান স্লোগানও। তবে মূল আকর্ষণ ছিল চোখের সামনে সৃষ্টি হতে থাকা শিল্পকর্ম। এদিন শহীদ মিনারের বিপরীত প্রান্তে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ভাস্কর্য গড়েন শিল্পীরা। নরম মাটি সবার চোখের সামনে লাভ করে বিশিষ্টার্থক গঠন নির্মিতি। প্রতীকী ভাস্কর্য, ভাস্কর্য ভাঙ্গার প্রতিবাদ জানায়। সামনে আসে শিল্পের শক্তি নিয়ে। মাটি থেকে বিভিন্ন ফর্ম সৃষ্টি হচ্ছে, হওয়ার সময়টা, নির্মাণের প্রতিটি ধাপ প্রত্যক্ষ করেন সাধারণ মানুষ। দারুণ উপভোগ করেন। সেইসঙ্গে সুন্দরের এই চর্চা অব্যাহত রাখার, বাঁচিয়ে রাখার জোর দাবি তুলেন তারা। কর্মসূচীতে যোগ দেয়া ভাস্কররা আলাদা আলাদা চিন্তা থেকে শিল্পকর্ম গড়ার প্রয়াস নেন। বেশিরভাগই ফিগারেটিভ কাজ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য গড়েছিলেন ভাস্কর রাসা। মাটির একটি বর্গাকার স্তূপ সামনে নিয়ে বসেছিলেন তিনি। দেখতে দেখতে সেখান থেকেই স্পষ্ট হলো ফিগার। দাঁড়িয়ে গেল বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ভাস্কর্য। আগতরা কৌতূহলী চোখে দেখলেন। কাজ করতে করতেই শিল্পী বললেন, ভাস্কর্য অতি প্রাচীন শিল্প। বহু বিস্মৃত ইতিহাসকে এটি ধারণ করে আছে। আমাদের দেশে মাধ্যমটি কাজে লাগিয়ে মূলত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শের প্রচার করি আমরা। এ কারণেই স্বাধীনতা বিরোধী পশ্চাৎপদ উগ্র গোষ্ঠী চর্চাটিকে ভয় পায়। প্রতীকী ভাস্কর্য হলেও, এগুলো তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের এক একটি দেয়াল গড়ে তুলবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। একই বিষয়ের ওপর কাজ করেন দুই শিল্পী রেজাউজ্জামান ও শহীদুজ্জামান। তবে কিছুটা বিমূর্ত। ফ্রি স্ট্যান্ডিং ভাস্কর্যে জাতির জনকের ৭ মার্চের আইকনিক ফর্ম তর্জনি দৃশ্যমান করেন তারা। বাঙালীর মনের চোখ দিয়ে তাকালে এ তর্জনি সব সময়ই দেখতে পায়। সেই দেখার আলোকেই কাজ করছিলেন তারা। ঠিক তখন পাশে এসে দাঁড়ান রণাঙ্গনের বীর যোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ। ভাস্করদ্বয় আরও একটু রিয়ালিস্টিক চিন্তা থেকে তাঁকে কিছু সময়ের জন্য মডেল হওয়ার অনুরোধ জানান। নাসির উদ্দীন ইউসুফ কিছু সময় স্ট্যাচুর মতো হাত শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকেন। তা-ই অনুসরণ করে যান শিল্পীরা। ফলাফল- প্রতিবাদী চেতনার অনবদ্য ভাস্কর্যরূপ। কোন্ অনুভূতি থেকে এমন ভাস্কর্য গড়া? উত্তরে শিল্পী শহীদুজ্জমান বলেন, আমাদের প্রতিবাদের ভাষা বঙ্গবন্ধু। সেই প্রতিবাদকেই বিষয় করেছি আমরা। ভাস্কর্যের মধ্য দিয়ে যার যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়েছি। তা না হলে মৌলবাদীদের রোখা যাবে না। বাঙালীর শক্তি সাহসের চূড়ান্ত উৎস বীর মুক্তিযোদ্ধারা। স্বীকৃত উৎসের কথা মনে করিয়ে দেন কাজী সাইফুদ্দীন আব্বাস। বিজয়ী বীর মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্য গড়েন তিনি। বলেন, স্বাধীনতা বিরোধীরা কুয়োর ব্যাঙ। সুযোগ পেলে মাথা তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু শেষতক জয়ী হব আমরা প্রগতিবাদীরা। বীর মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্যের মধ্য দিয়ে এ সত্যই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন বলে জানান তিনি। ভাস্কর্যের ভাষায় বলা হয়েছে শান্তি ও সৌহার্দ্যের কথাও। সে লক্ষ্যে ফারজানা ইসলাম কোন এক মায়ের ভাস্কর্য গড়েন। মায়ের কোলে তুলে দেন ডানা মেলা পায়রা। এই মা আসলে দেশমাতা। আর পায়রাটি শান্তির প্রতীক। পাশেই গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিলেন আরেক ভাস্কর সিগমা হক অঙ্কন। এক যুগলের ভাস্কর্যরূপ দেন তিনি। নরম মাটি আঙ্গুল দিয়ে টিপে টিপে চমৎকার এ ভাস্কর্য গড়েন। কিন্তু এত যত্নে গড়া ভাস্কর্যই তো ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে। শিল্পী মনে এর প্রতিক্রিয়া কী হয়? কষ্ট হতাশা? নাকি শিল্পের প্রতি আরও বেশি কমিটেড করে তুলে? জানতে চাইলে শিল্পীর উত্তর- মাধ্যমটি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। কাজ করছি নিজের মতো করে। এই প্রেম বলে বোঝানো যাবে না। উগ্র ধর্মান্ধরা সুযোগ পেলেই ভাস্কর্যে হাত দিচ্ছে। কিন্তু এ আঘাত আমাদের শিল্পীদের বুকে এসে লাগছে। আমরা থেমে না গিয়ে দ্বিগুণ উদ্যমে ভাস্কর্য গড়ছি। আয়োজনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল পারফর্মেন্স আর্ট। এতে অংশ নেন রিয়া, সানজীদা মাহমুদ, ইমরান সোহেল, সরকার নাহিদ, রূপম রায়, কবির আহমদ মাসুমসহ অনেকেই। শিল্পীরা জীবন্ত মানুষ ভাস্কর্য হয়ে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে নেয়া শরীর। তবে দেখে তা বোঝার উপায় নেই। ভাস্কর্যের সব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল। উপস্থিত সাধারণ মানুষ কৌতূহল নিয়ে সেদিকে ছুটে যাচ্ছিলেন। প্রয়াসটি ব্যাখ্যা করে শিল্পীদের অন্যতম কবির আহমদ মাসুম বলছিলেন, উগ্রবাদীরা দেশের সব ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দিতে চায়। কিন্তু ওরা জানে না মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সকল মানুষই এক একটি ভাস্কর্য হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারে। আমরা প্রয়োজনে আমাদের বডিকে ভাস্কর্য বানাব। গড়ে তুলব শক্ত প্রতিরোধ। পারফর্মেন্স আর্টের ভাষায় আগাম বার্তাটি দিয়ে রাখছেন বলে জানান তিনি। একই স্থানে ছবি আঁকার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। রং তুলিতে শিল্প সংস্কৃতি বিরোধী দানবের স্বরূপ উন্মোচন করেন শিল্পীরা। রঙে রেখায় ক্যানভাসে যেসব প্রতিকৃতি আঁকা হয় সেসবে মানুষের মতো দেখতে দানব ভেসে ওঠে। এদের চিহ্নিত করে প্রতিরোধের আহ্বান জানান শিল্পীরা। মজার ব্যাপার হলো, শিল্পের আকর্ষণে এদিন ছুটে এসেছিল সাধারণ। মানুষ এমনকি পথশিশুরা। তাদের কেউ রং-তুলি হাতে নিয়ে ছবি আঁকল। কেউ শরীর কাগজে মুড়িয়ে হয়ে গেল ভাস্কর্য। শিল্পের যে শক্তি, সে শক্তির যেন জয়গান করল অবোধ শিশুরাও। সফল কর্মসূচী শেষে মনিরুজ্জামান বলেন, আজ আমরা শিল্পের ভাষায় প্রতিবাদ জানালাম। তবে এ ভাষা আরও কঠিন কঠোর হতে পারে। সে লক্ষ্যে সব শিল্পী সমাজকে সব প্রস্তুতি নিয়ে রাখার আহ্বান জানান তিনি।
×