ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবু আফজাল সালেহ

বাংলা কবিতাসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব

প্রকাশিত: ২১:৩৫, ১৮ ডিসেম্বর ২০২০

বাংলা কবিতাসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভেতরই উত্থিত রয়েছে আমাদের বাঙালীর, বাংলাদেশের ইতিহাসবোধ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অগ্রগতিতে আসে বাধা। সিকান্দার আবু জাফর ‘বাংলা ছাড়ো’ কবিতায় কী শক্তভাবেই না উচ্চারণ করলেন; শত্রুর প্রতি বিষেদাগার করলেন এভাবেই, ‘রক্তচোখের আগুন মেখে ঝলসে-যাওয়া/আমার বছরগুলো/আজকে যখন হাতের মুঠোয়/কণ্ঠনালীর খুন পিয়াসী ছুরি,/কাজ কি তবে আগলে রেখে বুকের কাছে/কেউটে সাপের ঝাঁপি!/আমার হাতেই নিলাম আমার/নির্ভরতার চাবি;/তুমি আমার আকাশ থেকে/সরাও তোমার ছায়া,/তুমি বাংলা ছাড়ো।/...তুমি আমার বাতাস থেকে/মোছো তোমার ধুলো,/তুমি বাংলা ছাড়ো।/...আজকে যখন খুঁড়তে গিয়ে/নিজের কবরখানা/আপন খুলির কোদাল দেখি/সর্বনাশা বজ্র দিয়ে গড়া,/কাজ কি দ্বিধায় বিষণ্নতায়/বন্দী রেখে ঘৃণার অগ্নিগিরি!/আমার বুকেই ফিরিয়ে নেব/ক্ষিপ্ত বাজের থাবা;/তুমি আমার জলস্থলের/মাদুর থেকে নামো,/তুমিবাংলা ছাড়ো’। চীনা কথাশিল্পী লু শুন যদিও বলেছেন, ‘কবিতা লিখে বিপ্লব করা যায় না, বিপ্লবের জন্য প্রয়োজন বন্দুকের।’ তবে কিছু তো হয়ই। মুক্তিযুদ্ধে কবিতার প্রভাব আছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সবচেয়ে বেশি ¯পন্দিত করেছে কবিতা শিল্পকে। উপন্যাসেও হয়েছে। কবি সিকান্দার আবু জাফরের ‘বাংলা ছাড়ো’ কবিতার অগ্নিবার্তা কী সহজে ভোলা যায়! কবি কত সহজে কঠিন বক্তব্যই না দিলেন! মুক্তিপাগল বাঙালীর কথাই শোনা গেল এভাবে- ‘আজকে যখন হাতের মুঠোয়/ কণ্ঠনালীর খুনপিয়াসী ছুরি/কাজ কি তবে আগলে রেখে বুকের কাছে/ কেউটে সাপের ঝাঁপি/আমার হাতেই নিলাম আমার। নির্ভরতার চাবি/তুমি আমার আকাশ থেকে/সরাও তোমার ছায়া/ তুমি বাংলা ছাড়ো।’ অথবা যদি কবি হেলাল হাফিজের আহ্বান দেখি; কবিতায়-‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়...।’ ‘নিষিদ্ধ স¤পাদকীয়’ শিরোনামের এ কবিতাটি মুক্তিকামী মানুষের ভেতর জাগিয়ে তুলেছিল। এরকম অসংখ্য কবিতা আছে বাঙলা সাহিত্যে। তাই বলা যায়, আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা অর্জনে সুদৃঢ় বন্ধন সৃষ্টিতে শব্দসৈনিক কবিদের ভূমিকাও কম নয়। স্বাধীনতার আগে ও পরে কিছু মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক কবিতা নিয়েই আজ আলোচনা করব। ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পর বাংলা সাহিত্য নতুন বাঁক নেয়। কবিতাসাহিত্যে ভিন্নমাত্রা যোগ হয়। মহান ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন বা আগে পরের বিভিন্ন পরিক্রমার পর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জন করেছি। মুক্তিযুদ্ধকালীন কবিতাগুলো আমরা ভাগ করতে পারি তিন ভাগে। মুক্তিযুদ্ধ, পূর্ববর্তী ও পরের। মুক্তিযুদ্ধের আগের কবিতাগুলো বীরবাঙালীর প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করেছে। বিশ্বের মুক্তিকামীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সহায়তা করেছে। বাঙালীর মনে অত্যাচারের বিরুদ্ধে জাগরিত করে একতাবদ্ধ করেছে। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ-সংগ্রাম আবর্তিত। বঙ্গবন্ধু নিজেই কবিতা হয়ে গেলেন। বাঙালী ও বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের নেতা হয়ে গেলেন। আমাদের শক্তিমান কবি নির্মলেন্দু গুণ ‘স্বাধীনতা এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো’ শিরোনামেযে কবিতাও লিখে ফেলনেন এভাবে- ‘একটি কবিতা পড়া হবে তার জন্য কী ব্যাকুল প্রতীক্ষা মানুষের।/কখন আসবে কবি?/শত বছরের শতসংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।/তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,/হৃদয়ে লাগিল দোলা/জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা-/কে রোধে তাঁহার বজ্র কণ্ঠবাণী?/গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তার অমর কবিতা খানি:/এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ শামসুর রাহমানের ‘সন্ত্রাসবন্দী বুলেটবিদ্ধ দিনরাত্রি’ কবিতায় হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের কথা বর্ণিত হয়েছে অসাধারণ কাব্য কারিশমায়-‘কখনো নিঝুম পথে হঠাৎ লুটিয়ে পড়ে কেউ গুলির আঘাতে,/মনে হয় ওরা গুলিবিদ্ধ করে স্বাধীনতাকেই।/দিন-দুপুরেই জীপে একজন তরুণকে কানামাছি করে নিয়ে যায় ওরা, মনে হয় চোখ-বাঁধা স্বাধীনতা যাচ্ছে বধ্যভূমিতে’। জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রখ্যাত গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার লিখেছিলেনÑ ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে/লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠ/স্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি/আকাশে বাতাসে ওঠে রণি।’ ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি গুলিস্তানে একটি মিছিলের সামনে একটি লাঠিতে শহীদ আসাদের রক্তাক্ত শার্ট দিয়ে বানানো পতাকা দেখে মানসিকভাবে মারাত্মক আলোড়িত হন শামসুর রাহমান এবং তিনি লিখেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি। ‘গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের/জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট/উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।/বোন তার ভায়ের অম্লান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে/নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো/হৃদয়ের সোনালী তন্তুর ...কতদিন স্নেহের বিন্যাসে।/ডালিম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর-শেভিত/মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট/শহরের প্রধান সড়কে/কারখানার চিমনি-চূড়োয়/গমগমে এভেন্যুর আনাচে কানাচে/উড়ছে, উড়ছে অবিরাম/আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে, চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়।/ আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা/সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;/আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা’। শহীদ কাদরী ভিন্নধারার কবি। তিনিও কবিতা লিখলেন উত্তপ্ত পরিস্থিতি নিয়ে, অন্যায় আর অবিচারের প্রতি তার কবিতায় যোগ হলো দৃপ্ত উচ্চারণ। যেমন ধরি- ‘‘মধ্য-দুপুরে, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে, একটা তন্ময় বালক/কাচ, লোহা, টুকরা ইট, বিদীর্ণ কড়ি-কাঠ,/একফালি টিন,/ছেঁড়া চট, জং ধরা পেরেক জড়ো করলো এক নিপুণ/ঐন্দ্রজালিকের মতো যতো/এবং অসতর্ক হাতে কারফিউ শুরু হওয়ার আগেই/প্রায় অন্যমনষ্কভাবে তৈরি করলো কয়েকটা অক্ষর/’স্বা-ধী-ন-তা’।’’ (নিষিদ্ধ জার্নাল থেকে, শহীদ কাদরীর কবিতা)। কবি রফিক আজাদ। মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার কোনো বিকল্প নেই বলে উচ্চারণ করেছেন। তাঁর ‘একজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মসমপণর্’ কবিতায় বীরোচিত মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে- ‘তোমার মুখে হাসি ফোটাতে দামী অলঙ্কারে সাজাতে/ভীরু কাপুরুষ তোমার প্রেমিক এই আমাকে/ধরতে হল শ হাতে মর্টার, মেশিনগান-/শত্রুর বাংকারে, ছাউনিতে ছুড়তে হলো গ্রেনেড/আমার লোভ আমাকে কাপুরুষ হতে দেয়নি।’ সিকান্দার আবু জাফর এর অমর কবিতা-‘জনতার সংগ্রাম চলবেই/আমাদের সংগ্রাম চলবেই/...প্রয়োজন হলে দেবএক নদী রক্ত/হোক না পথের বাধা প্রস্তর শক্ত/অবিরাম যাত্রার চির সংঘর্ষে/একদিন সে পাহাড় টলবেই/চলবেই চলবেই/জনতার সংগ্রাম চলবেই...।’-(সংক্ষেপিত)। মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে কী লাগে আর! কবি আল মাহমুদও অনেক কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। দৃপ্ত উচ্চারণ করেছেন পাকিস্তানী অনিয়ম ও অবিচারের বিপক্ষে। কবিতা আর ছড়াসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়কে আল মাহমুদের ‘ক্যামোফ্লাজ’ কবিতাটি এখানে স্মরণযোগ্য- ‘জেনো, শত্রুরাও পরে আছে সবুজ কামিজ/শিরস্ত্রাণে লতাপাতা, কামানের ওপরে পল্লব/ঢেকে রাখে/নখ/দাঁত/লিঙ্গ/হিংসা/বন্দুকের নল/হয়ে গেছে নিরাসক্ত বিষকাঁটালির ছোট ঝোঁপ।’ কবি রফিক আজাদের একজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মসমর্পণ কবিতাটি ঠিক এমন- ‘হাতিয়ার হাতে দুশমনের মোকাবেলা করলাম/বারুদের গন্ধ মাখলাম শরীরে/ক্রলিং করে শত্রুর বাংকারে গ্রেনেড ছুঁড়ে/টুকরো টুকরো করে দিলাম শত্রুর সোনালি স্বপ্নকে।’ ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যা¤প’ কবিতায় যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের অবস্থা তুলে ধরেছেন রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এভাবে- ‘তাঁর চোখ বাঁধা হলো।/বুটের প্রথম লাথি রক্তাক্ত/করলো তার মুখ।/থ্যাঁতলানো ঠোঁটজোড়া লালা/রক্তে একাকার হলো,/জিভ নাড়তেই দুটো ভাঙা দাঁত/ঝরে পড়লো কংক্রিটে।/মা...মাগো...চেঁচিয়ে উঠলো সে।/পাঁচশো পঞ্চান্ন মার্কা আধ-/খাওয়া একটা সিগারেট/প্রথমে ¯পর্শ করলো তার বুক।/পোড়া মাংসের উৎকট গন্ধ/ছড়িয়ে পড়লো ঘরের বাতাসে।/তার শরীর ঘিরে/থোকা থোকা কৃষ্ণচূড়ার মতো/ছড়িয়ে রয়েছে রক্ত,/তাজা লাল রক্ত।/তার থ্যাঁতলানো একখানা হাত/পড়ে আছে এ দেশের মানচিত্রের ওপর,/আর সে হাত থেকে ঝরে পড়ছে রক্তের/দুর্বিনীত লাভা’। হুমায়ূন আজাদের অমর পঙক্তিমালা-‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়?/তেমন যোগ্য সমাধি কই?/মৃত্তিকাবলো, পর্বতবলো/অথবা সুনীল-সাগর-জল-/সবকিছু ছেঁদো, তুচ্ছ শুধুই!/তাইতো রাখি না এ লাশ আজ/মাটিতে পাহাড়ে কিম্বা সাগরে,/হৃদয়ে হৃদয়ে দিয়েছি ঠাঁই।’-(এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়?)। কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের আরেক সাহসী উচ্চারণ। ‘আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই,/আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি,/ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে/এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময়?...’-(বাতাসে লাশের গন্ধ)। পঁচিশে মার্চের কালো রাত সত্ত্বেও ছাব্বিশে মার্চ থেকেই শুরু হয়েছিল প্রতিরোধ আন্দোলন। রাজনৈতিক কর্মী ও ছাত্র-যুবা, সাধারণ নারী-পুরুষ থেকে মানুষ যুক্ত হয়েছিল সেই প্রতিরোধ সংগ্রামে। শহীদ কাদরীর কবিতায় তা পেয়েছে প্রতীকী ব্যঞ্জনা-‘মধ্য-দুপুরে, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে, একটা তন্ময় বালক/কাচ, লোহা, টুকরা ইট, বিদীর্ণ কড়ি-কাঠ,/একফালি টিন,/ছেঁড়া চট, জংধরা পেরেক জড়ো করলো এক নিপুণ/ঐন্দ্রজালিকের মতো যতো/এবং অসতর্ক হাতে কারফিউ শুরু হওয়ার আগেই...।’ (নিষিদ্ধ জার্নাল)। হুমাযুন আজাদের কবিতায়-‘...সারা বাংলা রক্তে গেছে ভিজে।/ যে-নদীতে ভাসতো রাজহাঁস সেখানে ভাসছে শুধু নিরীহ বাঙালীর লাশ।/সূর্য আর নক্ষত্রের সারাবেলা মানুষের,/সেখানে প্রাগৈতিহাসিক পশুরা সে-মানুষ নিয়ে করে বর্বরতা খেলা/তারপর এলো নতুন বন্যা... সূর্যসংকাশ/ভেসে গেল জন্তুরা, জন্তুদের সকল আভাস।’- (খোকনের সানগ্লাস, অলৌকিক ইস্টিমার)। ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায় শামসুর রাহমানের স্বাধীনতার স্বরূপ তুলে ধরলেন-‘...স্বাধীনতা তুমি/গৃহিণীর ঘন খোলা কালো চুল, /হাওয়ায় হাওয়ায় বুনো উদ্দাম।/স্বাধীনতা তুমি/খোকার গায়ের রঙিন কোর্তা,/খুকীর অমন তুলতুলে গালে/রৌদ্রের খেলা।/স্বাধীনতা তুমি/বাগানের ঘর, কোকিলের গান,/বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা, /যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা...’। নির্মলেন্দু গুণ স্বাধীনতাকে পর্যবেক্ষণ করলেন এভাবে-‘জননীর নাভিমূল ছিঁড়ে উলঙ্গ শিশুর মতো/বেরিয়ে এসেছো পথে, স্বাধীনতা, তুমি দীর্ঘজীবী হও।...হে আমার দুঃখ, স্বাধীনতা, তুমিও পোশাক পরো;/ক্ষান্ত করো উলঙ্গভ্রমণ, নয়তো আমারো শরীরী থেকে/ছিঁড়ে ফেলো স্বাধীনতা নামের পতাকা।/বলো উলঙ্গতা স্বাধীনতা নয়, /বলো দুঃখ কোনো স্বাধীনতা নয়,/বলো ক্ষুধা কোন স্বাধীনতা নয়, /বলো ঘৃণা কোন স্বাধীনতা নয়।/জননীর নাভিমূল ছিন্ন-করা রক্তজ কিশোর তুমি/স্বাধীনতা, তুমি দীর্ঘজীবী হও। তুমি বেঁচে থাকো/আমার অস্তিত্বে, স্বপ্নে, প্রেমে, বল পেন্সিলের/যথেচ্ছ অক্ষরে,/ শব্দে,/ যৌবনে, /কবিতায়...’।-(স্বাধীনতা,উলঙ্গ কিশোর)। সৈয়দ শামসুল হক ‘একদা এক দেশ ছিল’ কবিতায়, ‘একদা একটি দেশ ছিল বাংলাদেশ নামে, সেই দেশে শ্রমিক ও শিল্পীরা/ভালোবাসার কেবল একটি উন্নত ভালোবাসার প্রশিক্ষণ/পেয়েই উড়িয়ে/দিতে পারত স্বাধীনতার পতাকা এবং প্রাণ দিতে পারত মায়ের/স্তন্যপানের/মতো স্বাভাবিকতায়।/একদা একটি দেশ ছিল বাংলাদেশ নামে, সেই দেশে মালা/রূপান্তরিত হয়/শেকলে এবং পিতা পরিণত হয় ক্রীতদাসে ইতিহাসের/প্রতিটি পাতায়/রাজাকার তার নাম লেখে এবং সেলাই করে দেয়া হয় দেশপ্রেমিকের চোখের পলব’। পাকিস্তানী সেনাদের বর্বরোচিত অত্যাচার, নিপীড়ন, হত্যাযজ্ঞে ঢাকা শহর অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। নিরাপত্তাহীন ঢাকায় বাঙালীর অস্তিত্ব চরম সংকটে পতিত হয়। সৈয়দ শামসুল হক অবরুদ্ধ শহরের চিত্র তুলে ধরেছেন ‘অবরুদ্ধ শহরে চতুর্থ মাস’ কবিতায়- ‘ক্রমাগত সৈনিকের পদশব্দ আমাকে জটিল কোনো যন্ত্রের বিপুলতার সঙ্গে/গেঁথে চলে যায়/কথা কেউ বলে না/শব্দ কেউ করে না/বস্তুত ঠোঁটের কোনো কাজ নেই আতংকের তাপে ফেটে যাওয়া/ছাড়া/বস্তুত হাত কিংবা পায়ের কোনো কাজ নেই/হিমবাহ এই শহরের চাঙড় কোনক্রমে আঁকড়ে থাকা ছাড়া/—-আমি যেখানেই যাই এ শহরে অবেলায় ক্রমাগত বেলা পড়ে/যায়’। ২৫ মার্চ রক্তাক্ত অধ্যায় সূচিত হবার পর সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম ও প্রতিরোধ আন্দোলনের কথা শহর ছাড়িয়ে গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে যায়। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয় এদেশের মুক্তিকামী ছাত্র জনতা-কৃষক-শ্রমিক, শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী-শিল্পী-সাহিত্যিক। গড়ে ওঠে গেরিলা বাহিনী। গেরিলাদের নিয়ে সৈয়দ হক লেখেন ‘গেরিলা’ শিরোনামের কবিতা। সৈয়দ শামসুল হক গেরিলা কবিতায় মুক্তিযুদ্ধে গেরিলাদের কার্যক্রম ও তৎপরতাকে উপস্থাপন করেছেন। ‘দক্ষিণ ভিয়েৎনাম/কম্বোডিয়া/বাংলাদেশ/অ্যাংগোলায়/মোজাম্বিকে তুমি/নিসর্গের ভেতর দিয়ে/সতর্ক নিঃশব্দ পায়ে হেঁটে যাও সারাদিন সারারাত যখন গ্রামগুলো/জনশূন্য চাতাল চিড় খাওয়া আর উপাসনার চত্বরগুলো ঝরাপাতায়/অনবরত ঢেকে যায় নিঃশ্বাসের শব্দের ভেতরে/তোমাদের চলাচল’। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ‘শহীদ স্মরণে’ কবিতায় বলেন, ‘কবিতায় আর কি লিখব?/যখন বুকের রক্তে লিখেছি/একটি নাম/বাংলাদেশ।/গানে আর ভিন্ন কি সুরের ব্যঞ্জনা?/যখন হানাদারবধ সংগীতে/ঘৃণার প্রবল মন্ত্রে জাগ্রত/স্বদেশের তরুণ হাতে/নিত্য বেজেছে অবিরাম/মেশিনগান, মর্টার, গ্রেনেড’। আসাদ চৌধুরীর ‘রিপোর্ট ১৯৭১’ কবিতার অত্যাচার ও তখনকার মানসিক পরিস্থিতির ফিরিস্তি এমনভাবেই বললেন- ‘প্রাচ্যের গানের মতো শোকাহত, ক¤িপত, চঞ্চল/বেগবতী তটিনীর মতো সিøগ্ধ, মনোরম/আমাদের নারীদের কথা বলি, শোনো।/...অথচ যোহরা ছিলো নির্মম শিকার/সকৃতজ্ঞ ল¤পটেরা/সঙ্গীনের সুতীব্র চুম্বন গেঁথে গেছে-/আমি তার সুরকার- তার রক্তে স্বরলিপি লিখি।/মরিয়ম, যীশুর জননী নয় অবুঝ কিশোরী/গরিবের চৌমুহনী বেথেলহেম নয়।/... এদেশে যে ঈশ্বর আছেন তিনি নাকি/অন্ধ আর বোবা/এই ব’লে তিন কোটি মহিলারা বেচারাকে গালাগালি করে।/জনাব ফ্রয়েড,/এমন কি খোয়াবেও প্রেমিকারা আসে না সহজ পায়ে চপল চরণে।/জনাব ফ্রয়েড, মহিলারা/কামুকের, প্রেমিকের, শৃঙ্গারের সংজ্ঞা ভুলে গ্যাছে।/...এক ডজন শকুন মৈত্রী মৈত্রী ক’রে/হয়তো বা উঠেছিলো কেঁদে’। এছাড়া আহসান হাবীবের ‘মুক্তিযোদ্ধারা দেখতে কেমন’, আহমদ রফিকের ‘এ দেশ আমার স্বর্গ’, হাসান হাফিজুর রহমানের ‘স্মৃতি’, ‘তোমার আপন পতাকা’, ‘যখন উদ্যত সঙ্গীন’, আবু হেনা মোস্তফা কামালের ‘ছবি’, ফজল শাহবুদ্দিনের ‘এপ্রিলের একটি দিন ১৯৭১’, ‘বাংলাদেশ একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাকে’, মুহম্মদ নূরুল হুদার ‘আমরা তামাটে জাতি’, সানাউল হক খানের ‘সাতই মার্চ একাত্তর’, অসীম সাহার ‘পৃথিবীর সবচেয়ে মর্মঘাতী রক্তপাত’, হুমাযুন কবিরের ‘বাংলার কারবালা’, মহাদেব সাহার ‘ফারুকের মুখ’, আবিদ আজাদের ‘এখন যে কবিতাটি লিখব আমি’, দাউদ হায়দারের ‘বাংলাদেশ’, আবিদ আনোয়ারের ‘আমার মায়ের নামে তোপধ্বনি চাই’, মিনার মনসুরের ‘কী জবাব দেব’, বেলাল চৌধুরীর ‘স্বদেশভূমি’, ‘মর্মে মর্মে স্বাধীনতা’ ইত্যাদি কবিতায় স্বাধীনতা আর অনিয়মের কথা, বাঙালীর ব্যথা-বেদনার কথা উচ্চারণ করেছেন কবিরা। এসব কবিতায় পাই বাঙালী জাতীয়তাবাদের চেতনা, মানবিক আবেগ, স্বদেশপ্রেম, সাম্যচেতনা, ক্ষোভ ও মুক্তির তীব্র বাসনা। উল্লেখিত কবিরা প্রত্যেকেই মুক্তিযুদ্ধকে বিষয় করে একাধিক কবিতা লিখেছেন। উল্লিখিত ও এ তালিকার বাইরেও মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ নিয়ে অনেক কবিতা রয়েছে। বিশ্বসাহিত্যে অনেক দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সে দেশের কবি-সাহিত্যিকরা সাহিত্য রচনা করেছেন। আমাদের বাংলা সাহিত্য কিন্তু অনেক সমৃদ্ধ। বিশেষ করে কবিতা সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ প্রবলভাবে ওঠে এসেছে। আধুনিক বাংলা কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় রয়েছে বাংলাদেশের সুদীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। বাংলা কবিতার চিরায়ত ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত কবিতাগুলো দলিল হিসেবে থেকে যাবে। কবিরা ছিলেন আন্তরিক। স্বাধীনতা ও পাক শাসনের বিরুদ্ধে উচ্চারণ ছিল রক্তজবার মতো। মুক্তিযুদ্ধ, কবি ও কবিতার কাছে পর¯পপরে ঋণী; পর¯পর হয়ে ওঠে একে অপরের আত্মার আত্মীয়। কবি আবুল হাসানের কবিতায়-‘...কেবল পতাকা দেখি/কেবল উৎসব দেখি,/স্বাধীনতা দেখি,/তবে কি আমার ভাই আজ/ঐ স্বাধীন পতাকা?/তবে কি আমার বীন, তিমিরের বেদিতে উৎসব?’ (উচ্চারণগুলি শোকের)।
×