ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র একটি সেক্টর

প্রকাশিত: ২১:৩৪, ১৮ ডিসেম্বর ২০২০

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র একটি সেক্টর

বাংলার পবিত্র মাটি থেকে পাকিস্তানী জল্লাদ বাহিনী বিতাড়িত করার জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি যে যুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ- উদ্দীপনা ও সাহস যুগিয়েছে, যুগিয়েছে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীকে অনুপ্রেরণা এবং হানাদার জল্লাদ বাহিনীকে সর্বক্ষণ রেখেছে ভীত সন্ত্রস্ত তা হলো মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ। আর এই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাক সরকারের দখলকৃত এলাকার ৬টা বেতার কেন্দ্র থেকে অবিরাম প্রচণ্ডভাবে মুক্তিযোদ্ধা ও বাঙালী জাতির বিরুদ্ধে ভয়াবহভাবে মিথ্যাচার এবং অপপ্রচার চালানো হয়েছে। তার বিরুদ্ধে জবাব দেয়া হয়েছে একমাত্র স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাংলার মানুষের ওপর নারকীয় হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। খুনীদের হাত থেকে রক্ষার জন্য অসংখ্য মানুষ দেশ ত্যাগ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। সেই সঙ্গে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শুভ সূচনা হয়েছিল মুজিবনগরে পঞ্চাশ কিলোওয়াট মাধ্যম তরঙ্গ শক্তিসম্পন্ন ২৫ মে, ১৯৭১। প্রথম থেকেই উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে শুরু হয়েছিল এই বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচার। প্রতিদিন সকাল ৭টা ও সন্ধ্যা ৭টা এ দুই অধিবেশনে শুরু হয়েছিল অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান সূচীতে অন্তর্ভুক্ত ছিল বাংলা এবং ইংরেজী খবর, সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠান ‘অগ্নিশর্মা, ‘চরমপত্র’, ‘বিশেষ কথিকা’, ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ থেকে বাণী’ বজ্রকণ্ঠ এবং দেশাত্মবোধক গানের অনুষ্ঠান ‘জাগরণী’। তবে তারও আগের ইতিহাস হচ্ছে, চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে সংগঠিত হয়েছিল চট্টগ্রাম বেতারের দশজন নিবেদিত কর্মী স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, জনগণ এর সহযোগিতায়। তবে বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের দশজন যাদের নাম স্মরণ করতেই হবে এবং যারা সর্বক্ষণিক সংগঠক ছিলেন সর্বজনাব বেলাল রহমান, শারফুজ্জামান এবং কাজী হাবিবুদ্দিন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জনাব শামসুল হুদা চৌধুরীর গ্রন্থে এসবেরই উল্লেখ আছে। বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের উদ্যোক্তা ছিলেন বেলাল মোহাম্মদ। এই বেতার কেন্দ্রের প্রথম অধিবেশন সংগঠনের অন্যান্য উদ্যোক্তা ছিলেন আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, স্থানীয় বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাক্তার মনজুলা আনোয়ার, ডাক্তার সৈয়দ আনোয়ার আলী, ইঞ্জিনিয়ার আশিকুল ইসলাম, দিলীপ চন্দ্র দাশ এবং কাজী হোসেন আরা প্রমুখ। দুই দিন পর এই বেতার কেন্দ্রের নাম থেকে বিপ্লবী কথাটি বাদ দেয়া হয়েছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রচণ্ড বাধা এলো মাত্র চার দিনের মধ্যে। শক্রর বোমারু বিমান থেকে ৩০ মার্চ ’৭১-এ চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে বোমা ফেলা হলো। উপায়ন্তর না দেখে সেই সব বীর শব্দ সৈনিক তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের সহায়তায় একটি ক্ষুদ্র এক কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার বয়ে নিয়ে এলেন মুক্তাঞ্চলে। এই ট্রান্সমমিটারের সাহায্যে বিছিন্নভাবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছিল আরও কিছুদিন। ১৭ এপ্রিল ’৭১ কুষ্টিয়ার বৈদ্যনাথতলায় অস্থায়ী সরকার অনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশের পর মুক্তিযুদ্ধের প্রচার জোরদার করার উদ্দেশ্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে নতুন করে সংগঠনের দায়িত্ব অর্পিত হলো জনাব আব্দুল মান্নান (এমএনএ)-এর ওপর। পরবর্তীতে কালকাতার ৫৭/৮, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কাজ চলত ছোট্ট একটা দ্বিতল বাড়িতে। অনুষ্ঠানে বাণীবদ্ধ করার জন্য ডিও ছিল মাত্র একটি। পরে আরও একটি কক্ষ খালি করে অনুষ্ঠান রেকর্ডিংয়ের ব্যবস্থা হয়েছিল। তবে এগুলোতে পেশাগত স্টুডিওর ন্যায় কোন শব্দ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছিল না, ছিল না প্রয়োজনীয় বাদ্যযন্ত্র ও যন্ত্রী। কিন্তু সৃষ্টি হয়েছিল কালজয়ী কিছু গান যেমন ‘পূর্ব দিগন্ত সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল’, ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি, বাংলাদেশের নাম’, ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’, ‘নোঙ্গর তোল তোল’, ‘সোনায় মোড়ানো বাংলা মোদের’, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ ইত্যাদি আরও অনেক গান। দ্বিতল বাড়ির নীচ তালায় ছিল আমাদের রান্নাঘর, ওখানেই আমরা খেতাম। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত গানের রিহারর্সেল এবং রেকর্ডিংয়ের কাজ শেষ করে এ বাড়ির দোতলায় স্টুডিওর পাশের রুমে খোলা মেঝেতেই চাদর পেতে শুয়ে পড়তাম আমরা। চরমপত্র (বিশেষ ব্যঙ্গ রচনা), অগ্নিশিখা (মুক্তিবাহিনীর জন্য অনুষ্ঠান), জাগরণী (উদ্দীপনামূলক গানের অনুষ্ঠান) এবং ইংরেজী ও বাংলা খবর ইত্যাদি দিয়েই শুরু হয়েছিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান। চরমপত্র লিখতেন এবং পড়তেন জনাব এম আর আখতার। অনুষ্ঠানটি পরিকল্পনা করেছিলেন জনাব আব্দুল মান্নান (ভারপ্রাপ্ত এমএনএ)। অগ্নিশিখা মুক্তিবাহিনীর জন্য বিশেষ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা, প্রযোজনা এবং নামকরণ করেন জনাব টি এইচ শিকদার। তখন আমি মাত্র ১৮ বছর বয়সের তরুণ তাজা যুবক ঢাকা ডেন্টাল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। এই বয়সে নিপীড়ন নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হঠাও স্বাভাবিক। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে আমি মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়ি। ঘরে বসে থাকতে পারিনি। যোগাযোগ করতে থাকি বিভিন্নস্থানে বিভিন্ন জনের সঙ্গে। আমি ঢাকা থেকে জুন মাসেই ঘর থেকে বের হয়ে আরিচা দাউদকান্দি ইত্যাদি স্থান যখন পাক আর্মি, মিলিশিয়া ও রাজাকার, আলবদরদের একটি রণক্ষেত্র সেই মুহূর্তে সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদে সকল বাধা পার হয়ে ভারতের আগরতলা পৌঁছাই। সেখানে গিয়েই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ি এবং আগরতলা পৌঁছে চলে যাই কলেজ টিলাতে। সেখানে থাকতেন আমাদের নেতা-কর্মীরা? তাদের সঙ্গে পূর্ব পরিচয় থাকাতে আমাকে পাঠিয়ে দেন যুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে? সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা দেয়ার জন্য নিয়মিত গান বাজনা হতো। সেই সঙ্গে থাকত মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং। সেখানেই আমার সঙ্গে দেখা হয় মরমী কণ্ঠশিল্পী সর্দার আলাউদ্দিনের। আমি আর আলাউদ্দিন ভাই তখন একসঙ্গেই বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের গান করি। একদিন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে কলকাতায় স্বাধীন বাংলা বেতারে চলে যাব। যেই ভাবা সেই কাজ। দুজনে মিলে একদিন চলে গেলাম আগরতলা ধর্মনগর থেকে ট্রেনে আসাম, দার্জিলিং, শিলং হয়ে কলকাতা এলাম। ইতোমধ্যে সংবাদ পেলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র কলকাতায় ৫৭/৮, বালীগঞ্জ সার্কুলার রোডে কাজ শুরু করেছে। অবশেষে যোগদান করলাম আমার গন্তব্যস্থল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগদান করার পর একজন কণ্ঠ সৈনিক হিসেবে সঙ্গীত পবিবেশনই ছিল আমার মূল কাজ। বহু সঙ্গীত পরিবেশন করেছি দীর্ঘ নয় মাসে। এর মধ্যে সমবেত এবং দ্বৈতভাবে সঙ্গীত পরিবেশন করি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত আমার প্রথম গাওয়া দ্বৈত সঙ্গীত : কথা : শহীদুল ইসলাম সুর : হরলাল রায় * আমার সহশিল্পী ছিলেন তখনকার ইংরেজী সংবাদ পাঠক বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস-চেঙ্গেলার প্রফেসর ড. নাসরিন আহমেদ। গানের কথা : জ্বলছে জ্বলছে প্রাণ, আমার দেশ আমার...। গানটি প্রচারের দিন আমার নাম প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হয়। সেই দিন থেকেই বাংলাদেশে থাকা আমার মা, বাবা ও ভাই-বোন জানতে পারে যে আমি বেঁচে আছি। কারণ যুদ্ধে যাওয়ার কথাটি আমি কাউকে বলিনি এমনকি আমার মা, বাবা ও ভাই-বোনকেও না। তবে, যুদ্ধে গিয়ে তাদের জন্য আমার অনেক কষ্ট হতো, সেই সঙ্গে দেশে আমার পরিবারের সবাই ছিলেন অনেক দুশ্চিন্তায় এবং উৎকণ্ঠায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ। বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত যুদ্ধ সংবাদ, সঙ্গীত ও কবিতা, নাটক কথিকা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও প্রেরণা যুগিয়েছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সরব উপস্থিতি সেই সঙ্কটকালে সবার জন্য ছিল নব উদ্দামে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার এবং মনোবল না হারানোর অনুপ্রেরণক। মানুষের আগ্রহ আর ভরসার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই বেতার কেন্দ্র। সেই সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে গানগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে শুধু অনুপ্রাণিত আর উৎসাহিত করে নাই, সেই সঙ্গে যারা বাংলাদেশে ছিল তাদেরও উৎসাহিত করেছে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে। গানগুলো এখন নতুন প্রজন্মের কণ্ঠেও ধ্বনিত হয় তাদেরও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। এ কথা আজ অনস্বীকার্য যে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রটি সৃষ্টি হওয়াতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ অনেক সংগঠিত ও গতিশীল হয়েছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রটি এ দেশের মানুষের জন্য যেমন ছিল একটি আশা-ভরসার স্থান তেমনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ছিল উৎসাহ আর প্রেরণার স্থান। মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য সেক্টরের মতো এই বেতার কেন্দ্রটিও ছিল আর একটি সেক্টর, যেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবরই শুধু প্রচারিতই হতো না অনেক ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধকেও পরিচালিত করত এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। আর এই বেতার কেন্দ্রের একজন কণ্ঠ সৈনিক ছিলাম আমি, যার জন্য নিজেকে গর্বিত মনে করি। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। এই বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিকেরা সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী বাঙালীর মনোবলকে অক্ষুণ্ন রাখার জন্য দিবারাত্র কাজ করেছেন। তাদের ক্ষুরধার প্রচার মুক্তিযুদ্ধের গতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে সর্বাত্মকভাবে। এই বেতার কেন্দ্রের এক একটি শব্দ ইথার ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে এক একটি বুলেট হয়ে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রটির সফলতা ছিল একটি সুন্দর টিম ওয়ার্কের জন্য। অনেক কণ্ঠশিল্পী, নাট্যকর্মী, সংবাদ-পাঠক, কলা-কৌশলী এবং সংগঠক তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে সচল রেখেছেন। যাদের অনেকেই আজ নেই, তাদের সকলের নাম আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। তবে যারা বেঁচে আছেন তাদের মধ্যে অনেকে আজ অসুস্থ, বিছানায় শয্যাশায়ী কেউবা নিদারুণ অর্থকষ্টে দিন যাপন করছেন। আমাদের এখন প্রয়োজন তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো তাদের জন্য কিছুটা হলেও সাহায্য করা।
×