ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ বিজয় দিবস থেকে দুর্গ গড়ে তুলুন

প্রকাশিত: ২০:৫৬, ১৫ ডিসেম্বর ২০২০

সিডনির মেলব্যাগ ॥ বিজয় দিবস থেকে দুর্গ গড়ে তুলুন

বিজয় দিবস কি আসলে সেভাবে উদযাপন করা হয় যেভাবে হওয়া দরকার ছিল? এই প্রশ্ন আজ প্রত্যেকের নিজেকে অন্তত একবার হলেও করা উচিত। আজকের ডিসেম্বর আর একাত্তরের ডিসেম্বর যে এক না তা বলার কোন কারণ দেখি না। এমনকি দেশ স্বাধীনের পর এত এত সরকার এলো গেল, তখনও আমাদের বিজয় এমন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়ায়নি। আপনি সুখনিদ্রা যাচ্ছেন যান, বুদ্ধিবৃত্তি কুম্ভকর্ণের নিদ্রায় সময় কাটাচ্ছে, কাটাক। কিন্তু যখন নয়ন মেলবে তখন কি দেখবে তা বলা কি খুব মুশকিল? আর যাই দেখুক না কেন যে দেশ স্বাধীন করার জন্য তিরিশ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছিলেন, লাখ লাখ মা-বোন সম্মান হারিয়েছিলেন, সে দেশ আর দেখবেন না। মনে করি আজকের বিজয় দিবস এক কঠিন দানব ও দানবীয় সত্যের মুখোমুখি করেছে জাতিকে। দীর্ঘ সময় ধরে পাশ কাটিয়ে, এড়িয়ে বা চোখ বুজে আত্মতৃপ্তি অনুভব করার দিন আর নেই। আজকের বিজয় দিবস ধর্মের নামে উগ্রবাদ আর বাঙালী জাতীয়তাবাদকে মুখোমুখি করেছে উগ্রবাদীরা। সংঘাত সৃষ্টি করে সমাজে কি চাচ্ছে এরা? এর জবাব সরকার জানলেও দিতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাদ দিলে সরকারে আওয়ামী লীগে দ্বিতীয় কেউ আছেন যার কথা মানুষ কোন সন্দেহ বা দ্বিধা ছাড়া মেনে নেবে? কতদিন কত মাস কত বছর হয়েছে আওয়ামী লীগের মতো দল কোন বিরোধীর মোকাবেলা করেনি? মোকাবেলা কি সবসময় যুদ্ধ না মারামারি? বিজয় দিবসে যে গণতন্ত্র আর আধুনিক দেশ থাকার কথা, তার কি কিছু আছে আসলে? এই যে একতরফা, একমুখী সবকিছু তাতেই ধ্বংস হয়ে গেছে প্রতিরোধ। সব দেশে সব সমাজেই বাধা থাকে। কাজ করে প্রতিক্রিয়াশীলতা। এই প্রতিক্রিয়াশীলতাকে রুখতে চাই বিজয়ী জাতির অঙ্গীকার। যার নাম রাজনীতি। তা ছিল বলেই তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুলদের মতো নেতা পেয়েছিলাম আমরা। আমাদের ইতিহাসকে রাঙিয়ে দিয়ে গেছে বাঙালী অসাম্প্রদায়িকতা। আজকের বিজয় দিবস সেগুলো হারিয়ে কেবল যেন এক আনুষ্ঠানিকতা। মূল কারণগুলো আমরা জানলেও মানতে চাই না। বিভ্রান্ত এই প্রজন্ম তো বটেই, আমাদের সমবয়সী বা অনুজদের অনেকেই পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণকে মনে করেন ভারতীয় সেনাদের কাছে পরাজয়। যে কথা শুরুতে বলছিলাম, স্বাধীনতা দিবস আর বিজয় দিবস দুটোই ততটা আন্তরিকভাবে পালন করা হয় না। যতটা প্রথাগত। গোড়ার কিছু বছর বাদ দিলে সবসময় হয় কূট তর্ক বা ভুল ইতিহাসে- এই অবস্থা। সময় প্রায় শেষ। অর্ধশত বছরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ানো বিজয় দিবস যা চায়, যা তার প্রাপ্য তা দিতে হলে আধুনিক সমাজ অসাম্প্রদায়িক স্বদেশ আর সরকারের কঠোর অবস্থানের বিকল্প নেই। মনে রাখা প্রয়োজন, এমন অনেক স্বাধীন দেশ আছে যাদের স্বাধীনতা পুরনো না হতেই বাঁক পরিবর্তন এমন কি নামও বদলে গেছে। আমরা বিজয় অর্জন করেছি রক্তসাগর পাড়ি দিয়ে। যৌথ বাহিনীর কাছে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের ইতিহাস বাঙালীর প্রথম গৌরবের নাম। এই ইতিহাস একবার হাতছাড়া হলে বাংলাদেশের মাটি আমাদের ক্ষমা করবে না। ক্ষমা করবে না আকাশ নদী ফুল পাখি কিংবা ভোরের বাতাস। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পাকিস্তানী বাহিনী এই দিনে যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। সেদিন ঢাকার কেন্দ্রস্থলে রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানের পক্ষে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি। তিনি যৌথ বাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর উপ-সর্বাধিনায়ক ও ডেপুটি চীফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবদুল করিম খোন্দকার উপস্থিত ছিলেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী উপস্থিত ছিলেন না। আত্মসমর্পণ দলিলের ভাষ্য ছিল নিম্নরূপ- [৩] পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চীফ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের সকল সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণে সম্মত হলো। পাকিস্তানের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীসহ সব আধা-সামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষেত্রে এই আত্মসমর্পণ প্রযোজ্য হবে। এই বাহিনীগুলো যে যেখানে আছে, সেখান থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কর্তৃত্বাধীন নিয়মিত সবচেয়ে নিকটস্থ সেনাদের কাছে অস্ত্রসমর্পণ ও আত্মসমর্পণ করবে। এই দলিল স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার নির্দেশের অধীন হবে। নির্দেশ না মানলে তা আত্মসমর্পণের শর্তের লঙ্ঘন বলে গণ্য হবে এবং তার প্রেক্ষিতে যুদ্ধের স্বীকৃত আইন ও রীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। আত্মসমর্পণের শর্তাবলীর অর্থ অথবা ব্যাখ্যা নিয়ে কোন সংশয় দেখা দিলে, লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত। এতকিছুর পরও আজ যারা দেশে সম্পদে অর্থে প্রভাবে বলীয়ান, তারা কিভাবে বেঈমানী করে? কিভাবে ভুলে যায় এই দেশ স্বাধীন না হলে কি করতেন তারা? আজকের এই ধর্ম ব্যবসায়ীদের এই বাণিজ্য চলত? পাকিস্তানীদের কাছে সবকিছু বন্ধক দিয়ে নাকে খত দিয়ে চলতে হতো। এই বিজয় দিবসে তাদের আস্ফালন দেখে একটা কথা জানতে ইচ্ছে করে, এরা কোনদিন কোনভাবে কি দেশের জন্য কিছু করেছে? লেখাপড়া খেলাধুলা সংস্কৃতি শিল্প এমনকি ধর্মেও তাদের কি অবদান? যে মাইক্রোফোনে কথা বলেন, যে নেট দুনিয়ায় টাকা কামান, জনপ্রিয়তা নিয়ে ব্যবসা করেন, তারাই করেন এর বিরোধিতা। এদের কথা শুনলে এদেশ স্বাধীন তো হতোই না, আজও আমরা থাকতাম চানতারা পতাকার গোলাম। শুদ্ধ ইতিহাস আর রক্তধারার এই দেশ ৫০ বছরে পা দিতে চলেছে। এখন এসব কোলাহল বন্ধ করা প্রয়োজন। আমাদের সমানে নতুন দিনের হাতছানি। বিশ্বাস করি, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ দেশের সব মানুষ চায় বাংলাদেশের কল্যাণ। আর সেটাই জাতির শক্তি। জাতির আশার জায়গা। ঘরে ঘরে প্রগতিশীলতার দুর্গ গড়ে তুলুক বাঙালী। এটা ছিল বঙ্গবন্ধুর ডাক। তাঁকে হেয় করা বা তাঁর ভাস্কর্য ভাঙ্গার জন্য এদেশ বিজয় অর্জন করেনি। [email protected]
×