ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

বাংলাদেশ-ভুটান অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি

প্রকাশিত: ২০:৫৪, ১৫ ডিসেম্বর ২০২০

বাংলাদেশ-ভুটান অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি

১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সদস্য দেশসমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম ভুটান মুক্তিযুদ্ধরত বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়ে একই মাসের ১৬ ডিসেম্বরে চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে সুস্পষ্টভাবে ও সকল সন্দেহের উর্ধে আমাদের এগিয়ে দিয়েছিল। আর ২০২০ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত হয়ে এই দুই ভ্রাতৃপ্রতিম দেশের বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার অগ্রযাত্রা সর্বাত্মক দৃঢ়তার সঙ্গে সকল দেশের সামনে তুলে ধরেছে। ১৯৯৫ সালের ১ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (WTO) ১৯৪৮ সালের শুল্ক ও বাণিজ্যবিষয়ক সাধারণ চুক্তি (এঅঞঞ) অনুযায়ী অস্ত্রশস্ত্র ব্যতীত বাণিজ্যের সকল ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর ও শুল্কাদি হ্রাসকরণের লক্ষ্য সামনে রেখে কাজ করে আসছে। বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যকার অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি আঞ্চলিক পর্যায়ে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার অনুসরণীয় নীতি কাঠামো অনুযায়ী বাণিজ্যিক শুল্ক দূরীকরণ ও মুক্ত বাণিজ্যের মাধ্যমে সকল দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিতকরণের কার্যক্রম হিসেবে এই দুই দেশ কর্তৃক গৃহীত হয়েছে। প্রথাগতভাবে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তথাকথিত সবচেয়ে বেশি পছন্দের সূত্র- যাতে বলা হয়েছে যে, বাণিজ্যরত একটি দেশকে যদি আরেকটি দেশ শুল্ক সুবিধা দেয়, তাহলে সে সুবিধা শুল্ক সুবিধা প্রদানকারী সেই দেশের সঙ্গে বাণিজ্যরত সকল দেশের প্রতি প্রযোজ্য হবে- নীতিঅনুসরণ করতে চায়। বাণিজ্য প্রসারণের এই সূত্র কোন দেশই এখনও পূর্ণাঙ্গভাবে গ্রহণ ও বলবৎ করতে পারেনি। এর বিকল্পে এই সূত্র অনুযায়ী দ্বিপাক্ষিক বা আঞ্চলিকভাবে বাণিজ্য ব্লক বা অগ্রাধিকার বাণিজ্যের সমষ্টি হিসেবে গড়ে উঠেছে। এই ধরনের ব্লক বা এলাকার সবচেয়ে দৃষ্ট উদাহরণ- উত্তর আমেরিকান মুক্ত বাণিজ্য এলাকা (নাফটা), যার আওতায় উত্তর আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকো কতিপয় নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে পণ্য ও সেবা সামগ্রী রফাতানি-আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক তুলে দিয়েছে। তেমনি ক্রম বিকাশমান দক্ষিণ এশিয়ান মুক্ত বাণিজ্য এলাকা (সাফটা) সেই ধরনের একটি বাণিজ্য ও সহযোগিতার জোট। বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী প্রায় ৭৫০টি অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিকভাবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অনুসরণীয় লক্ষ্য বিশ্বব্যাপী মুক্ত বাণিজ্য প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে আঞ্চলিক প্রচেষ্টা বা জোট হিসেবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। গত ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও ভুটানের এই অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী ও ভুটানের অর্থ ও বাণিজ্যবিষয়কমন্ত্রী লোকনাথ শর্মা সই করেন। সইকরণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং কার্যত বা ভার্চুয়ালি উপস্থিত ছিলেন। এই অনুষ্ঠানে ভুটান বাংলাদেশের জনগণের হৃদয়ে স্থায়ী আসন জুড়ে রয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভুটানের ভূমিকার কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন। ভুটান ১৪৮০০ বর্গমাইল আয়তনসহ উত্তরে তিব্বত এবং দক্ষিণে ভারত দিয়ে বেষ্টিত স্থলাবদ্ধ দেশ। এর সমকালীন লোক সংখ্যা আনুমানিক ৭ লাখ ৩০ হাজার, জাতীয় আয় ২ লাখ ৫০ বিলিয়ন ডলার এবং মাথাপিছু আয় ৩১০০ ডলার। ২০০৭ সালে সইকৃত এক দি¦পাক্ষিক চুক্তির আওতায় ভারত ও ভুটান দ্বিপাক্ষিকভাবে সকল ক্ষেত্রে একে অন্যকে সহযোগিতা করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সমকালে ভুটানের সরকারী বাজেটের ২৫% ব্যয় ভারত বহন করে থাকে। ভারতীয় রূপী ভুটানে সকল আদান-প্রদানে ভুটানের সরকারী মুদ্রা নগলট্রুম এর মতো ব্যবহৃত হয়। ভুটানে কোন রেলপথ নেই। রাজধানীর থিমপুর ৪০ মাইল দূরে পারোতে অবস্থিত বিমান বন্দর ছাড়া বিমান পথে অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের কোন সুবিধা নেই। পারোর পরে অঙ্গুফুল্লা, বুমথাং ও গেলেপুতে ৩টি আংশিক ব্যবহৃত স্থানীয় বিমান ক্ষেত্র বিদ্যমান- যেসবে সপ্তাহে ১ বা ২ বার পারো থেকে বিমান চলাচল করে। ভুটানের বার্ষিক রফতানির পরিমাণ ১৫০ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে প্রধান হলো জলবিদ্যুত, জিপসাম, কাঠ, সিমেন্ট, ফল ফলাদি ও হস্তশিল্পজাত পণ্যাদি। প্রধান আমদানীয় হলো তরল জ্বালানি, খাদ্যশস্য, যন্ত্রপাতি, মোটর গাড়ি ও বস্ত্র। ভুটানের আমদানির প্রায় ৭৫% ভারত, ৮% জাপান এবং ৩% সুইডেন থেকে আসে। ভুটানের রফতানির প্রায় ৬০% ভারত, ৩০% হংকং এবং ৭% বাংলাদেশে যায়। ২০১৮-১৯ সালে বাংলাদেশে ও ভুটানের মধ্যকার আমদানি ও রফতানির পরিমাণ হয়েছে প্রায় ৫৮ মিলিয়ন ডলার। চীন বা তিব্বতের সঙ্গে ভুটানের সমকালীন বাণিজ্য সম্পর্ক নেই বললেই চলে। ভুটানের সঙ্গে ৫২টি দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনৈতিক সম্পর্ক বিদ্যমান। কেবলমাত্র ভারত, বাংলাদেশ ও কুয়েতের আবাসিক দূতাবাস ভুটানের রাজধানী থিমপুতে কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য তাদের দিল্লীর দূতাবাসের মাধ্যমে ভুটানের সঙ্গে কূটনৈতিক আদান-প্রদান সমাপণ করে। ভুটানের সামরিক বাহিনী একমাত্র পদাতিক সৈন্য নিয়ে গঠিত। এদেশের কোন নৌ বা বিমান বাহিনী নেই। গত ৬ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত দ্বিপাক্ষিক অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ ভুটানে ১০০টি পণ্য এবং ভুটান বাংলাদেশে ৩৪টি পণ্য শুল্কমুক্তভাবে রফতানি করতে পারবে। এভাবে বাংলাদেশ থেকে ভুটানে রফতানিয় পণ্যের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে তৈরি পোশাক, খাদ্য সামগ্রী যথা- ফলের রস, ঘনায়িত দুধ, বিস্কুট, প্রক্রিয়াজাত পানি, পাউরুটি, কৃষিজাত পণ্য যথা- শুঁটকি ও গোল আলু, প্রসাধনী সামগ্রী যথা- সাবান, শ্যাম্পু, সিমেন্ট, চা, প্লাইউড, হালকা প্রকৌশলীয় যন্ত্রাদি, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, প্লাস্টিক পণ্যাদি, পাট ও পাটজাত পণ্য, এ্যালমুনিয়ামের তৈরি আসবাবপত্র, কাঠের তৈরি পণ্য, ইলেট্রনিক্স দ্রব্যাদি, জুতা ও ক্যাবলস, ঘড়ি, বেল্ট, প্লাস্টিক আসবাবপত্র ইত্যাদি। আর তেমনি শুল্কমুক্তভাবে ভুটান বাংলাদেশে রফতানি করতে পারবে বিদ্যুত, পাথর, জিপসাম, ডোলামাইট, ফলের রস, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য যথা- জ্যাম-জেলী, মসলা, আসবাবপত্র ইত্যাদি। বাংলাদেশ দিয়ে ভিন্নতর দেশ হতে ভুটানের আনীত আমদানি ও সেসব দেশে প্রেরিত রফতানি শুল্কবিহীন। চুক্তি অনুযায়ী পরবর্তীকালে চুক্তিবদ্ধ দুই দেশই একে অন্যের জন্য শুল্কমুক্ত রফতানীয় পণ্যদ্রব্যের সংখ্যা পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে বাড়াতে পারবে বলে চুক্তিতে বিধান রাখা হয়েছে। চুক্তি সইয়ের পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভুটানের সঙ্গে সহযোগিতা অধিকতর বিস্তৃত করার সম্ভাবনা ও উপযোগের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন যে, এদেশের চিলমারী ও পানগাঁও নদীবন্দর উন্নয়ন করে তৃতীয় দেশ থেকে ভুটানের সার্বিক আমদানি এবং সে দেশে রফতানি বাড়ানো সহজ হয়েছে। তিনি আরও বলেন যে, ভুটান বাংলাদেশের ৩ সমুদ্রবন্দর- চট্টগ্রাম, পায়রা ও মংলা-ব্যবহার করতে পারবে। তিনি বাংলাদেশের সৈয়দপুর বিমানবন্দরের ব্যবহার ভুটানের জন্য উন্মুক্ত বলে উল্লেখ করেন। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ডা. লোটে শেরিং বলেন যে, বাংলাদেশ তার জন্য দ্বিতীয় স্বদেশ। তিনি বাংলাদেশের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে চিকিৎসা শাস্ত্রে ৭ বছর শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের এই পর্যায় থেকে উন্নততর পর্যায়ে দ্রুত উঠে যাবে। এর আগে ২০১৪ এ বাংলাদেশ ও ভুটানের প্রধানমন্ত্রী জলবিদ্যুত উৎপাদন ও সঞ্চালন, নদী ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করনের লক্ষ্যে একে অন্যের সঙ্গে সহযোগিতা করবে বলে ঘোষণা করেছিলেন। ভুটানের উত্তরে (চীন নিয়ন্ত্রণাধীন) তিব্বত, পশ্চিমে ও দক্ষিণে ভারতের সিকিম, পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম এবং পূর্বে (ভারতের) অরুণাচল, মিজোরাম ও নাগাল্যান্ড। ভুটানের কেন্দ্রীয় অঞ্চল দিয়ে এর ৪টি প্রধান নদী- তোরশা, রাইডাক, সঙ্কোষ ও মানস প্রবাহিত। দক্ষিণাঞ্চলের বরফ গলা ও বৃষ্টি ঝড়া পানি বেশ কয়েকটি উপনদী দিয়ে ভারতে ব্রহ্মপুত্র নদীতে নিষ্কাষিত হয়। অধিকাংশ জনগণের বাস নিয়ে এই এলাকাই ভুটানের জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের উৎস ও সমকালীন উন্নয়নের পাদপীঠ। ভারত সংলগ্ন ডুয়ার্স উপত্যকার ভুটানের অংশ সাম্প্রতিককালে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড আকর্ষিত করেছে। সমকালে ভুটানের ৩ ভৌগোলিক অঞ্চলকে কাছে টেনে আনা ও সুসংহত করার লক্ষ্যে সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। দক্ষিণ পশ্চিমের ফুনেতসলিং থেকে পূর্ব প্রান্তের তারাসিংগার পর্যন্ত বিস্তৃত দেশটির প্রধান ও প্রসারণাধীন সড়ক। সাম্প্রতিককালে ভুটান জাতীয় সংহতি দৃঢ়করণের লক্ষ্যে এর ভৌগোলিক এলাকায় নেপালী বংশ উদ্ভূত জনগোষ্ঠীকে সরিয়ে দেয়ার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। ভুটানে প্রতি বর্গমাইলে ৫০ জন লোক বাস করে। এ কথা বিজ্ঞ মহলে প্রশ্নাতীতভাবে স্বীকৃত যে, দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের উৎপাদন এবং ব্যবহার্য পণ্যসামগ্রীর লভ্যতা বাড়িয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কুশলগামী হয়। এই প্রেক্ষিতে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা সার্বিকভাবে সর্বত্র মুক্ত বাণিজ্য এলাকা বিস্তৃত করার লক্ষ্যে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে সদস্য দেশসমূহের মধ্যে অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তিকরণের পক্ষপাতী। বাংলাদেশের জন্য গত ৬ ডিসেম্বর সইকৃত ভুটানের সঙ্গে অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি ১ম এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রগতিশীল চিন্তার প্রতিফলক। ভুটানের জন্য এই চুক্তি দ্বিতীয়। ২০০৮ থেকে ভারতের সঙ্গে ভুটানের দ্বিপাক্ষিক মুক্ত বা অগ্রাধিকার বিশিষ্ট বাণিজ্য চুক্তি বিদ্যমান। এই চুক্তি অনুযায়ী ভারত হয়ে ভুটানের বহির্বিশ্বের আমদানি ও রফতানি শুল্কমুক্ত। ভারতীয় রূপী ভুটানের সরকারীভাবে প্রচলিত মুদ্রা- নগলট্রুম- এর সঙ্গে সেদেশে গ্রহণ ও বিনিয়োগযোগ্য। ভুটানের বৃহত্তম উন্নয়ন প্রকল্প টাটা জল বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র (১০২০ মেঃওঃ) ভারত কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত। এই কেন্দ্রের উদ্ধৃত্ত বিদ্যুত ভারতে রফতানি হয়। সমকালে ভুটান ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিদ্যুত সরবরাহ করছে। বাংলাদেশও ভুটান থেকে বিদ্যুত আমদানির প্রাথমিক পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করছে। ভুটানের বিদ্যুত উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে ভারত, অষ্ট্রিয়া ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক সহযোগী দেশ ও প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। ভুটানে ৩০০০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুত উৎপাদনের সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে সম্পাদিত অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তিকে ভিত্তি করে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আগামীতে কতিপয় অনুগমনীয় পদক্ষেপ নেয়া বিবেচনীয় : (১) বাংলাদেশের তরফ থেকে চট্টগ্রাম, পায়রা ও মংলা সমুদ্র বন্দর এবং চিলমারী ও পানগাঁও নদীবন্দরে ভুটানকে তার রফতানি ও আমদানিয় পণ্যদ্রব্য গুদামজাত ও ব্যবস্থাপনাকরণের জন্য পৃথক সংরক্ষণাগার নির্মাণ করতে দেয়া কর্মানুগ হবে। এটা হলে এখন কলকাতা বন্দর হয়ে ভুটানের আমদানি ও রফতানির পরিমাণের একটি বড় অংশ বাংলাদেশের এসব বন্দর হয়ে আনা ও নেয়ার সুযোগ-সুবিধা ও পরিমাণ বাড়বে; (২) ১৯৮৭ সালে প্রবর্তিত ভুটানের ‘অভিন্ন জাতি ও জনগণ’ বিষয়ক বিধান বলে ভুটানের জনগণ ‘দুরুকপা’ পোশাক পরিধান করতে সরকার কর্তৃক অনুশাসিত। এই অনুশাসন অনুযায়ী পুরুষরা হাঁটু পর্যন্ত নামানো ‘ঘো’ এবং মহিলারা পায়ের গোছ পর্যন্ত ঢাকা ‘কিতা’ পোশাক পরছেন। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প ভুটানের এরূপ অনুশাসিত পোশাকের বাজারে প্রবেশ ও তা সম্প্রসারণ করতে সরকারের সহযোগিতায় যথা ঈপ্সিত পদক্ষেপ নিতে পারে; (৩) ভুটানের লোকসংখ্যা তথা শ্রমিক লভ্যতা কম। নেপাল থেকে জনাগম ভুটানে নিষিদ্ধ। পার্শ্ববর্তী ভারতের অরুণাচল, আসাম, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, মেঘালয় ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে ভুটানে আগমনীয় শ্রমিকদের লভ্যতা কম। এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ লাভজনকভাবে ভুটানে সুনির্দিষ্ট প্রকল্প ও কার্যক্রমে উদাহরণত নতুন বিমানবন্দর ও সড়ক নির্মাণে প্রয়োজনীয় শ্রমিক রফতানি করার সুযোগ নিতে পারে; (৪) ভুটানের কৃষি খাতের ঈপ্সিত প্রসারণের জন্য বাংলাদেশের উদ্যোগীরা সেখানকার কৃষি জমি, বাগান ও খামার ইজারা নিয়ে উভয় দেশের জন্য লাভজনক উৎপাদন বাড়াতে পারে; (৫) ভুটানের শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলাদেশের শিক্ষকগণ লাভজনক কর্মসংস্থান পেতে পারেন। সমকালে ভুটানের শিক্ষাব্যবস্থায় মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষকগণ ভারতের কেরালা থেকে আগত। বাংলাদেশ থেকে সরকারী ব্যবস্থাপনা ও পৃষ্ঠপোষকতায় এই শ্রেণীর শিক্ষক ভুটানে পাঠানো ঈপ্সিত। একই বিবেচনায় বাংলাদেশ ভুটানের ৩ ভৌগোলিক এলাকায় ৩টি পলিটেকনিক বা কারিগরি বিদ্যালয় স্থাপন করতে বাংলাদেশী উদ্যোগীদের উৎসাহিত করতে পারে। বাংলাদেশ ও ভুটানের এরূপ কারিগরি বন্ধন দীর্ঘ মেয়াদী করার লক্ষ্যে ভুটান থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের জন্য বাংলাদেশের সরকারী পলিটেকনিক ও চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে যথাক্রমে ১০ ও ৭টি আসন সংরক্ষণ করা দুই দেশের লক্ষ্যানুগ হবে; (৬) ভুটানে ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের প্রসারণে বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা যৌথভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। স্মর্তব্য, ভুটানের সমকালীন ফল প্রক্রিয়াজাতকরণের শিল্প জাপানী প্রযুক্তি ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভুটানের সঙ্গে জাপানী উদ্যোগের একযোগে এগিয়ে যাওয়া কর্মানুগ হবে; (৭) ভুটানের সঙ্গে পারস্পরিক আমদানি রফতানি বাড়ার ক্রমে বাংলাদেশের টাকা ও ভুটানের নগলট্রুমের ব্যবস্থাপনা ২ দেশের ব্যবহার্য মুদ্রা হিসেবে অনুমোদন পেতে পারে। এই লক্ষ্যে ভারতীয় রূপী ও নগলট্রুমের ব্যবস্থাপনার আলোকে এখন থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংক পরিকল্পনা করতে পারে। (৮) ভুটানের পর্যটন শিল্প ও সুবিধাদি বাংলাদেশের তুলনায় বিস্তৃত ও সম্ভাবনাময়। সে দেশের পর্যটনে যেসব বিদেশীরা আকর্ষিত, তাদেরকে যাওয়া ও আসার পথে বাংলাদেশের পর্যটনীয় স্থান হয়ে যাওয়া-আসার কার্যক্রম ও সুবিধাদি সমন্বয় করে উভয় দেশের যৌথ পরিকল্পনা করা লাভজনক হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভুটানের অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা প্রয়োগ করেছেন, তার যৌক্তিক প্রসারণীয় পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশই পথ দেখাতে পারে। দেশের প্রগতির পরিমাপের সূচক হিসেবে ভুটান মাথাপিছু আয় বর্ধনের সঙ্গে অন্যান্য সামাজিক অগ্রগতি ও সংহতির সূচক সমন্বিত করে ‘মোট জাতীয় সুখ’ এর প্রত্যয় হিসাব ও প্রচার করে আসছে। এই প্রত্যয় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সংশোধনীয় সূচকে ভবিষ্যতে হয়ত রূপান্তরিত কিংবা সংশোধিত করতে পারে। লেখক : এমপি ও সাবেক মন্ত্রী
×