ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রযুক্তি ব্যবহারে বদলে যাচ্ছে কৃষি

প্রকাশিত: ২২:১২, ১৪ ডিসেম্বর ২০২০

প্রযুক্তি ব্যবহারে বদলে যাচ্ছে কৃষি

রাজীব হাসান কচি, চুয়াডাঙ্গা ॥ গতানুগতিক চাষাবাদ দিয়ে লাভজনক বাণিজ্যিক ফসল আবাদের নতুন নতুন শস্যবিন্যাসে চাষ করেন চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার ডিঙ্গেদহের হাটখোলা গ্রামের কৃষক দলিল উদ্দিন মোল্লা। আগাছা দমন ও আদ্রতা ধরে রাখতে ব্যবহার করেন মালচিং ফিল্ম, ব্যাগিং প্রযুক্তি, পোকা দমনে ফেরোমন ফাঁদ। প্রশিক্ষিত আধুনিক কৃষক হিসেবে তিনি এলাকায় পরিচিতি লাভ করেছেন। এবার একই জমিতে একসঙ্গে তিনটি লাভজনক ফসল আবাদ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। সরেজমিনে তার ফসলের মাঠ ঘুরে দেখা যায় একই জমিতে তিনটি ফসল। কয়েকজন কৃষি শ্রমিক মরিচ তুলছেন আর দলিল উদ্দিন মোল্লা কলার মোচায় ব্যাগিং করছেন। প্রতি সারি কলা গাছের মাঝ বরাবর সবুজ কার্পেটের মতো একাঙ্গী। দলিল উদ্দিন মোল্লা বলেন, জমিতে একই ফসল আবাদ না করে বিভিন্ন রকমের ফসল আবাদ করছি। একটা জমিতে যেমন আছে লাউ, আবার অন্য জমিতে মাষকলাই, আলু, বেগুন। আর ২৫ শতক জমিতে আবাদ করেছি একসঙ্গে তিন ফসল। মোবাইল ফোনে ইউটিউবে কৃষি বায়োস্কোপের ভিডিওতে দুই বছর আগে পেয়ারা বাগানে দুই সারির মাঝখানে একাঙ্গীর আবাদ করা দেখি। এই বছর কৃষি অফিসের পরামর্শে ও নিজে ঝুঁকি নিয়ে কলা, মরিচ ও একাঙ্গী আবাদ শুরু করি। প্রথমে মনে হচ্ছিল তিনটি ফসল একসঙ্গে হবে না, এখন দেখছি সব ভাল হয়েছে। এর মধ্যে ৭০ হাজার টাকার মরিচ বিক্রি করা হয়ে গেছে আরও বিক্রি হবে। ৫০-৬০ মণ একাঙ্গী পাওয়া গেলে ২ হাজার টাকা মণ হিসেবে সেখান থেকে এক লাখ টাকার বেশি হবে। কলা বিক্রি করে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকার বেশি পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। কলা গাছের চারা বিক্রি করেও পাওয়া যাবে ১৫-২০ হাজার টাকা। পার্শ্ববর্তী জমির কলা চাষী স্বপন আলী বলেন, একই কলা চাষ আমিও করেছি কিন্তু দলিল উদ্দিন মোল্লা আমার থেকে লাখ দেড়েক টাকা বেশি পাবে মরিচ ও একাঙ্গী থেকে। উপজেলা কৃষি অফিসার তালহা জুবাইর মাসরুর জানান, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের নির্দেশনা অনুযায়ী চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে বাণিজ্যিক কৃষির সম্প্রসারণে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কৃষকদের প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও উদ্ভাবনী বিভিন্ন উদ্যোগ মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নের কাজ চলছে। দলিল উদ্দিন মোল্লা একই জমিতে তিন ফসলের চাষ এক ধরনের মাল্টি লেয়ার মিক্সড ক্রপিং টেকনিক। যেখানে একাধিক ফসল একই জমিতে, একই সময়ে চাষ করা হয়। এর ফলে জমির সর্বোত্তম ব্যবহার যেমন নিশ্চিত হয় তেমনি কম খরচে একাধিক ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট একটা জমি থেকে অধিক আয় করা সম্ভব হয়। আবাদি কৃষি জমি দিন দিন কমছে কিন্তু খাদ্য চাহিদা বাড়ছে। এই প্রেক্ষিতে একই জমি থেকে অধিক ফসল উৎপাদন করার কৌশল উদ্ভাবন করাটা সময়ের দাবি। এক্ষেত্রে কলা চাষ করা যায় এমন জমিকে নতুন এই ফসল বিন্যাসের মাধ্যমে একসঙ্গে তিনটি লাভজনক ফসল আবাদের আওতায় নিয়ে এসে ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিসহ কৃষকের আয় কয়েকগুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব। একাঙ্গী আদা ও হলুদের মতো মসলা জাতীয় বাণিজ্যিক ফসল যা হালকা ছায়া পছন্দ করে ফলে কলা গাছের দুই সারির মাঝে অনায়াসে লাগানো যায়, কার্পেটের মতো মাটিতে হয় বিধায় আগাছা বাড়তে পারে না, মাটির আর্দ্রতা ও পুষ্টি সমন্বিত থাকে এবং এর গন্ধে পোকার আক্রমণ কম হয়। আর প্রতি দুইটি কলাগাছের মাঝের ফাঁকা সারিতে মরিচ গাছ লাগানো যায়, যা ৪ ফুট উচ্চতায় থাকে বলে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পায়। এই তিনটি ফসলের রুট জোন ও মাইক্রো ক্লাইমেটিক চাহিদা ভিন্ন হওয়ায় একে অপরের সঙ্গে পানি ও পুষ্টি গ্রহণে কোন প্রতিযোগিতা করে না। ফলে সব ফসল থেকেই ভাল ফলন পাওয়া যায়। কলার ক্ষেত্রেও উন্নত মানের সবরি কলার জাত ব্যবহার করা হয়েছে এবং কলা বিটল পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে ও দাগহীন করতে বিশেষ ব্যাগ দিয়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে যা কলার বাজারমূল্য বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক ও কৃষি বায়োস্কোপের উপদেষ্টা হামিদুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে, এক ইঞ্চি আবাদি জমিও যেন পতিত না থাকে। সেই নির্দেশনার সফল বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে এই মিশ্র ফসল চাষের মডেলে। বিগত কয়েক বছর ধরে আমরা কৃষক পর্যায়ে লাভজনক ফসল আবাদের কৌশলগত বিষয় নিয়ে কাজ করছি। মরিচ,সবরি কলা ও একাঙ্গী তিনটাই লাভজনক ফসল এবং এই তিন ফসলকে একত্রে চাষ করে জমির সর্বোত্তম ব্যবহার যেমন নিশ্চিত করা যায় তেমনি কম খরচে অধিক ফসল ফলানোর কাজটাও লাভজনক উপায়ে করা সম্ভব। কৃষক দলিল উদ্দিন মোল্লা একজন প্রগতিশীল প্রতিভাবান কৃষক। কৃষি বায়োস্কোপের পক্ষ থেকে তাকে পরামর্শ ও সহযোগিতা করা হলে তিনি অত্যন্ত সফলভাবে নতুন এই লাভজনক ফসল বিন্যাস মাঠে বাস্তবায়ন করেছেন। তার এই সফলতা দেখে আশপাশে অনেক কৃষক এই ধরনের চাষাবাদে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন। এই ধরনের লাভজনক আধুনিক চাষ পদ্ধতি সারাদেশে সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন।
×