ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

স্বীকৃত জেলে নন, মাছ ধরাই জীবিকা

বড়শির সুতোয় বাঁধা শতাধিক পরিবারের জীবন

প্রকাশিত: ২২:০১, ১৪ ডিসেম্বর ২০২০

বড়শির সুতোয় বাঁধা শতাধিক পরিবারের জীবন

কামরুজ্জামান বাচ্চু ॥ ডিঙ্গি নৌকায় ভেসে তেঁতুলিয়া নদীতে বড়শি দিয়ে মাছ শিকার করেন পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার কালাইয়া গ্রামের শাহজাহান হাওলাদার। এখানে তার মতো আরও অনেকেই আছেন, যাদের সংসার চলে শুধু মাছ শিকার করে। বলা যায় মাছ শিকারই তাদের জীবন-জীবিকা। অন্য কোন কাজ তারা করেন না। প্রায় সারা বছর মাছ ধরেই তারা জীবিকা নির্বাহ করেন। একই অবস্থা এই অঞ্চলের বহু মানুষের। এখানে নৌকায় চেপে নিয়মিত মাছ শিকার করেন শাহজাহান হাওলাদার। তার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, বড়শিতে মাছ শিকার করেই চলছে তার এবং তারই মতো আরও বহু পরিবারের জীবন-সংসার। তিনি আরও বলেন, জীবিকার প্রয়োজনে দিন নেই, রাত নেই সমস্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ দুর্বিপাক উপেক্ষা করে বছরের পর বছর শুধু মাছ শিকার করেই চলেছি। এখন এটাই পেশা, এটাই নেশা। এর রোজগার দিয়েই স্ত্রী, ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখাসহ সংসার চলে তার। এমন কাজে জীবন পার করে দিলেও এরা কিন্তু স্বীকৃত জেলে বা মৎস্যজীবী নন। এদের বিশেষ আর কোন পরিচয়ও নেই। অথচ মাছ ধরে বা বেচেই কেটে যাচ্ছে জীবন যৌবন। আরেকজন মৎস্য শিকারি এসে আগ বাড়িয়ে বললেন, বছরের এই সময়টাই আসলেই মাছ শিকারের জন্য। এই সময়ে অন্য পেশার লোকজনও এসে শামিল হয় মাছ ধরায়। কেউ কেউ আবার নিজে খাওয়ার জন্যও শখের বশে মাছ ধরে থাকে। পরে আবার ফিরে যায় নিজ নিজ কর্মস্থলে। বান্তবে উপার্জনের অন্য কোন উপায় না থাকায় বাউফলে বড়শির সুতোয় বাঁধা পড়ে আছে শাহজাহানের মতো শতাধিক পরিবারের জীবন ও জীবিকা। কারণ বড়শি বেয়েই চলছে তাদের জীবিকা। তিনি বলেন, ‘কয়েক বছর আগেও নদীতে পোয়া, আইড়, ফাহা, শিলল, গাঁগড়া, রিটা, কাউন, ভোল, পাবদা, সরপুঁটি ও কোরালের মতো বিভিন্ন মাছ দেদার পাইতাম। এ্যাহন ওইসব মাছের আর দ্যাহা মেলে না।’ শাহজাহান হাওলাদারের মতো কালাইয়া লঞ্চঘাট এলাকার শাহজাহান ফরাজি, রহিম খলিফা, লোকমান, কোডন রাঢ়ি, চরকালাইয়া গ্রামের লক্ষণ সাধু, রিপন, জামাল আকন, আলতাফ হোসেন, সলেমন, চরওয়াডেলের হাবিব, ধুলিয়ার আঃ খালেক, আদু ফরাজি, মমিনপুরের বাদামতলী এলাকার চান্দু মিয়া, চর মিয়াজানের রফিক, শাহআলমসহ উপজেলার মদনপুরা, নূরাইনপুর, বগীর খাল, শৌলা, বাদামতলী, মঠবাড়িয়া, ধুলিয়া, তালতলী মমিনপুর এলাকার প্রায় শতাধিক ব্যক্তি সংসার। এছাড়াও কালাইয়া, বগী, তালতলি, চন্দ্রদ্বীপের বাতিরখাল, ধূলিয়াসহ নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে বড়শিতে মাছ শিকারে সংসার চলে কয়েক শ’ ভাসান পরিবারের জীবন । তিথির পরিবর্তনে নদীর জোয়ার-ভাটার ধরনে বড়শিতে মাছ শিকারের কৌশলেরও পরিবর্তন করেন এরা। বর্ষায় বোয়াল, আইড়, কোরাল মাছ ধরা পড়ে। বড়শির আকার ও সুতার ধরনও থাকে ভিন্ন। আবার কার্তিক থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত পোয়া, রিটা, গাঁগড়া, গলদা চিংড়ি ধরা পড়ায় এ সময় অনেকেই ডিঙ্গি নৌকায় ভেসে ছিপ বড়শি ফেলেন নদীতে। লালশো বা গেছে লাল পিঁপড়ের ডিম, এ্যাকাঙ্গি, মহুয়া ফুল, পুরনো মধু, মিষ্টির বাসি রস, আটাসহ বিভিন্ন ধরনের মসলা ব্যবহার করেন বড়শির টোপে। গলদা চিংড়ি ধরতে কেঁচোই ব্যবহার করেন অনেকে। তবে সময়ের পবিবর্তনে কাজের ধরন কিংবা মাছ ধরার কৌশল পরিবর্তন হলেও যেন পরিবর্তন নেই এদের জীবন-মানের। বড়শিতে বাঁধাই এদের জীবন-সংসার। এ সময়ে নদীতে আইড়, পোয়া, বোয়াল, পাঙ্গাস, কোরালসহ মিঠা পানির বিভিন্ন মাছের পাশাপাশি নদীতে ধরা পড়ছে গলদা চিংড়ি। স্থানীদের সঙ্গে তেঁতুলিয়ার নিমদী, নারাখালী, তালতলী, চর রায়সাহেব, বড়ডালিমা, চরওয়াডেল, কালাইয়া বাদামতলী, ধুলিয়া পয়েন্টে বড়শিতে মাছ শিকারে এসেছেন ভোলা, বাকেরগঞ্জ, পিরোজপুর, ঝালকাঠির অনেক মাছ শিকারি। বাকেরগঞ্জ জেলার গোপালপুরের জলিল মৃধা (৫৫) জানান, ১৫-২০ বছর ধরে বড়শিতে মাছ শিকার করছেন তিনি। বড়শিতে মাছ শিকার করে সংসার চলে তার। এই আয় দিয়ে ছেলে ফিরোজ, শাহিন, নিজাম উদ্দিন, মিজানুর, ও মেয়ে আছিয়াকে নিয়ে সাত সদস্যের সংসার । জমি-জমা না থাকায় ছোট থেকেই এই পেশায় জড়িয়ে আছেন তিনি। মকিমাবাদ কলেজের এইসএসসির ছাত্র ছেলে মিজানুরের লেখাপড়ার খরচ চলে বড়শিতে মাছ শিকারের টাকায়। লেখাপড়া না জানলেও কোন রকমে মোবাইল ফোন রিসিভ করতে শিখেছেন তিনি। নদীতে বিপদ-আপদে মোবাইল ফোনে খোঁজ-খবর নেন পবিবারে সদস্যরা। ৩শ’ থেকে ৫শ’ টাকা আবার কোন দিন ৫শ’ থেকে এক হাজার টাকা আয় করেন তিনি বড়শিতে মাছ শিকারে। জলিল মৃধার মতো ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে বড়শিতে মাছ শিকারে এসেছেন একই এলাকার হোসেন সিকদার (৫৫), রুহুল খলিফা (৫০), মাসুদ হাওলাদারসহ (৪০) অর্ধশতাধিক মাছ শিকারি। বড়শিতে মাছ শিকার করেই চলে এদের প্রত্যেকের সংসার। জলিল মৃধা বলেন, ‘দিনে দিনে সবকিছু পাল্টাই যাচ্ছে। চর জাইগ্যা নদী ভরাট অইতে আছে। আগের মতো অনেক মাছও আর নাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘জায়গা-জমি নাই। দিন-রাইত নদীতে ভাইস্যা মাছ শিকার করোন কস্টের কাম। ঘর-সংসার আর ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার পানে চাইয়া বড়শি বাই।’ বগী খালে নৌকা নোঙ্গর করা ভাসান সম্প্রদায়ের ষাটোর্ধ চানবানু জানায়, নদীর পানির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয় তাদের। তবে বড়শিতে মাছ শিকারই তাদের বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন। ‘আগের সব মাছ আর গাঙে দেহা যায় না। আড়াইয়া গ্যাছে মিডা পানির কতেক মাছ।’-এমন অভিন্ন কথা বলেন, ওই বহরের আনছার সরদার, লাল মিয়া, শমসের, শাহানাজ, রোজিনা ও বাচ্চু সরদারসহ আরও অনেকে। চর মিয়াজান বৌবাজার এলাকার সেলিম খান জানান, চরের অনেক কাঁকড়া শিকারিও এ সময় বড়শিতে মাছ শিকার করছেন। মাঘ ও ফাল্গুনে এদের অনেকে আবার বাগদার রেণু ধরার কাজ করেন। তেঁতুলিয়া নদী পাশের বগী, কালাইয়া, চরওয়াডেল জেলেপল্লী, মমিনপুর জেলেপল্লী, বাদামতলী, ধুলিয়া, তাঁলতলী, তাঁতেরকাঠিসহ বিভিন্ন এলাকার কয়েক শ’ লোক এখন বড়শিতে মাছ শিকার করে জীবন চালায়। আবহাওয়ার পরিবর্তন, রেণু পোনা নিধন, মা ইলিশ শিকার, নদী ভরাট, নিষিদ্ধজাল ব্যবহারসহ বিভিন্ন কারণে নদীতে মাছ এখন দুষ্প্রাপ্য হয়েছে। শিকারির বড়শিতেও আর আগের মতো মিলছে না মাছ। অনেক জেলে পরিবারের ছেলেমেয়ে নিয়ে কাটছে দুর্বিষহ জীবন।’
×