ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পদ্মা সেতু ঘিরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নির্মাণযজ্ঞ

প্রকাশিত: ২১:১০, ১৩ ডিসেম্বর ২০২০

পদ্মা সেতু ঘিরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নির্মাণযজ্ঞ

সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর ॥ পদ্মা সেতু ঘিরে দেশের অনুন্নত জনপদ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে উঁকি দিচ্ছে সমৃদ্ধির হাতছানি। সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির সোনালি ফসল নয়। পদ্মা সেতু গোটা দেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন। জাতির ঐতিহাসিক বিজয়ের মাস এবং মুজিববর্ষে বাঙালীর আরও একটি জয় দেখল পৃথিবী। পদ্মার দুই পাড়ে হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে বৃহস্পতিবার নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর সর্বশেষ (৪১তম) স্প্যান বসানোর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন। এ সময় তিনি অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘এটা অনুভূতি প্রকাশ করার মতো নয়; সমগ্র দেশবাসী পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ।’ এদিকে পুরো পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হওয়ায় শনিবার মাদারীপুরে আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করেছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। সকালে জেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় থেকে জেলা ছাত্রলীগের ব্যানারে একটি আনন্দ মিছিল বের হয়। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জাহিদ হাসান অনিক ও সাধারণ সম্পাদক বায়েজিদ হাওলাদারের নেতৃত্বে মিছিলটি শহরের বেশ কয়েকটি সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে বঙ্গবন্ধু ম্যুরালে গিয়ে শেষ হয়। পরে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তারা বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে দেশ ও বিদেশে অনেক চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র হয়েছিল। সব বাধা পেরিয়ে ৬.১৫ কিলোমিটারের পুরো পদ্মা সেতু দৃশ্যমান। অপর দিকে দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক ও মহাসড়কে চলাচলরত পরিবহন শ্রমিকদের মুখে শোনা গেছে আনন্দের কথা। সকলের মুখে ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জয়গান। পদ্মা সেতু এখন পুরোটা দৃশ্যমান। বাকি কাজ শেষ হলেই কে কার আগে কত দ্রুত পদ্মা সেতু পার হয়ে গন্তব্যে যাবে এটাই এখন পরিবহন শ্রমিক ও যাত্রীদের প্রত্যাশা এবং মূল আলোচনার বিষয়। অচিরেই কেটে যাবে ফেরিঘাটে দীর্ঘ অপেক্ষা, দুর্ভোগ আর বিড়ম্বনার দুঃখ-দুর্দশা। ফেরিঘাট, লঞ্চঘাট ও স্পিডবোট ঘাটের জুলুম-নির্যাতন শেষ হওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার। ঝড়-বন্যা, নাব্য সঙ্কট পদ্মায় তীব্র স্রোত, ভাঙ্গনে ঘাট ভেঙ্গে নৌযান পারাপার বন্ধসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইতিহাস হয়ে যাবে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে। এমনটাই প্রত্যাশা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পরিবহন শ্রমিক ও যাত্রী সাধারণের। মুছে যাবে ৩৫ বছর ধরে চলা মাওয়া-চরজানাজাত (বর্তমান শিমুলিয়া-বাংলাবাজার) নৌপথের কালো অধ্যায়। এক সময়ের অবহেলিত ও অনুন্নত জনপদ পদ্মার পাড়ে এখনই আলো ঝলমল করছে। তিন জেলায় দেশের প্রথম ৮ লেনের এক্সপ্রেস হাইওয়ে উদ্বোধন হয়েছে আরও আগেই। এ পথেই রেল লাইন বিস্তৃত হচ্ছে পুরো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল। শিবচরে দুটি স্টেশন, জাজিরায় একটি স্টেশনসহ জংশন রয়েছে ফরিদপুরের ভাঙ্গায়। অলিম্পিক ভিলেজ নির্মাণে জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে এক্সপ্রেস হাইওয়ে সংলগ্ন শিবচর, ভাঙ্গা ও সদরপুরে আড়িয়াল খাঁ তীরবর্তী এলাকায়। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের আইসিটি ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম অস্থায়ীভাবে শুরু হয়েছে শিবচরের দত্তপড়ায় ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী কলেজে। নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন নিজস্ব ক্যাম্পাস। প্রধানমন্ত্রী ১০৮ একর জায়গায় ১৯শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে শেখ হাসিনা তাঁতপল্লী, ১৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে। দাদাভাই হাউজিং প্রকল্প নির্মাণ শেষে ১ হাজার ৬৪ প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। গড়ে উঠছে বহুতল ভবন। শিবচরের দ্বিতীয়খণ্ডে উদ্বোধন করা হয়েছে বীরমুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম তালুকদার টেকনিক্যাল স্কুল এ্যান্ড কলেজ। একই উপজেলার বহেরাতলায় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় জায়গা নির্ধারণ করেছে টিটিসি নির্মাণের। ৭১ নম্বর কেরানীবাটের ৮ একর জায়গায় শেখ হাসিনা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, বড়দোয়ালীর ৩ একর জায়গায় নির্মিত হচ্ছে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব নার্সিং ইনস্টিটিউট এ্যান্ড কলেজ, বড় বাহাদুরপুরের ৫.২১ একর জায়গায় নির্মিত হচ্ছে ইনস্টিটিউট অব হেলথ এ্যান্ড টেকনোলজি। পদ্মার পাড়ের ৭৫ একর জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট ফর ফন্ট্রিয়ার টেকনোলজি, ৪শ’ একর জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে শিবচর ইউনিয়নে বিসিক শিল্পনগরী স্থাপনের জন্য। ন্যাশনাল জুডিসিয়াল একাডেমি ও সংস্কৃতি কেন্দ্র নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে পৌরসভা এলাকায়। শেখ রাসেল শিশু পার্ক, উপজেলা মডেল মসজিদ কমপ্লেক্স, মহাসড়কে ট্রমা সেন্টার নির্মাণ শুরু হয়েছে। কর্মজীবী মায়েদের জন্য জায়গা নির্ধারণ হয়েছে বেগম রোকেয়া কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলসহ ট্রেনিং সেন্টার ও ডে-কেয়ার সেন্টার। আধুনিক কাঁচাবাজারসহ শপিং কমপ্লেক্স নির্মাণ শুরুর পথে। নির্মাণ করা হয়েছে অত্যাধুনিক চৌধুরী ফাতেমা বেগম, ইলিয়াছ আহমেদ চৌধুরী ও লিটন চৌধুরী অডিটরিয়াম, চৌধুরী ফিরোজা বেগম শিল্পকলা একাডেমি ও মুক্তমঞ্চ, ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী সুপার মার্কেট, পৌর বাসস্ট্যান্ড, হাইওয়ে থানা, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সিটি, দেশের আরও এক মেগা প্রকল্প বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হওয়ায় সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর ফ্লাইওভারের সংযোগস্থল থেকে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া পর্যন্ত এবং সেতুর দক্ষিণ পাড়ে শিবচর থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে, মাদারীপুর হয়ে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা পর্যন্ত চারলেন সড়ক নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। এই পদ্মা সেতুকে ঘিরেই দক্ষিণাঞ্চলে গড়ে উঠবে শিল্প-কলকারখানা ও পর্যটন কেন্দ্র। যেখানে হাজার হাজার মানুষ কর্মসংস্থান খুঁজে পাবে। গড়ে ওঠবে স্কুল-কলেজসহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অভিজাত অবকাঠামো, আধুনিক আবাসিক অঞ্চল। সেই সঙ্গে মানুষের জীবন-যাত্রায় আসবে আধুনিকতার ছোঁয়া। পাশাপাশি আরও বৃহৎ অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলার দাবি ওঠেছে মুন্সীগঞ্জ ও পদ্মা সেতুর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল মাদারীপুর-শরীয়তপুরে। যাতে দেশের অর্থনৈতিক ভিত আরও শক্তিশালী হয়। মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলার মানুষ নতুন নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যেই সরকার ১০ জেলাকে অর্থনৈতিক জোন হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।
×