ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কবীর চৌধুরী তন্ময়

সংস্কৃতির ঔদার্যে জঙ্গীবাদের হুঙ্কার

প্রকাশিত: ২০:৫৮, ১১ ডিসেম্বর ২০২০

সংস্কৃতির ঔদার্যে জঙ্গীবাদের হুঙ্কার

কাক হচ্ছে একমাত্র পাখি যে ঈগলের ঘাড়ের ওপর বসে ঈগলকেই ঠোকর মেরে বিরক্ত করতে পারে। কাকের মতো এই ধরনের দুঃসাহস সহসা অন্য কোন পাখির মধ্যে দেখা যায় না। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, ঈগল রাগান্বিত হয়ে কাকের সঙ্গে লড়াই করে না বা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে না কিংবা কাককে মেরে ফেলার চেষ্টাও করে না। অযথা কাকের পিছনে ছুটে নিজের সময় ও শক্তির অপচয় করার মতো ঈগল বোকামী করে না। কিন্তু ঈগল যেটা করে, কাক সেটা পারে না। কাকের পক্ষেও সম্ভব হয় না। ঈগল দ্রুত গতিতে উপরের দিকে উঠতে থাকে। আর ঈগল দ্রুতগতি নিয়ে এতটাই উপরে উঠে যায় কাক ‘দ্রুত গতি’ আর ‘অতি উচ্চতায়’ অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে রীতিমতো দুর্বল হয়ে পড়ে এবং টিকে থাকতে না পেরে একটা সময় ঈগলের ঘাড় থেকে নিজেই বাধ্য হয়ে দ্রুততম সময়ে পরাজয় বরণ করে। নিজেই আত্মসমর্পণ করে খসে পড়ে, ঈগলকে ছেড়ে পালিয়ে যায়-এই গল্পটা বাবার মুখে শুনেছি বহুবার। আবার স্কুল জীবনে শিক্ষকের কাছেও শুনেছি। আর সাম্প্রতিক সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষ করে ফেসবুকে বেশ ভাইরাল হয়েছে এই গল্পটি। গল্পটির যথার্থতা হচ্ছে, আজ বাংলাদেশের বয়সের ঘর পঞ্চাশে দাঁড়িয়েও কাক তাড়াতে ঈগল তৈরি করতে পারিনি। কাক সবচেয়ে কুৎসিত পাখি। আর মৌলবাদ, ধর্ম ব্যবসায়িক গোষ্ঠী, জঙ্গী মন-মগজের সম্প্রদায়ের ব্যক্তি ও মহল-শুধু একক কোন দেশ ও জাতি গোষ্ঠীর জন্য হুমকি নয়। বরং বিশ্ব মানবতার জন্য হুমকি যা কাকের চেয়েও কুৎসিত ও ভয়ঙ্কর। আর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আলবদর, আলসামস, কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধীদের রাজনীতি করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষক বা আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়াসহ সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পদায়নের বিপরীতে আমরা কী করেছি, কী করার প্রয়োজন ছিল, কী কী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া জরুরী ছিল-এগুলো গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণের দাবি রাখে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে প্রায়ই নানান কথা শুনি, দেখি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এই ফোরাম, ওই সংগঠন। এমনকি, অনেকে এটিও বলেন যে, ‘আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষ’, ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী’। কিন্তু আলাপ-আলোচনায় হতাশা ছাড়া তেমন কোনো ফলাফল পাওয়া যায় না। আবার কতিপয় ব্যক্তি ও মহলের কর্মকাণ্ড নিয়ে পর্যালোচনা করলে হতাশার সঙ্গে আরও লজ্জাও যুক্ত হয়, লজ্জিত হতে হয়। আর একশ্রেণীর কর্মকাণ্ড নিয়ে গণমাধ্যম অহরহ সংবাদ প্রচার-প্রকাশ করেছে। পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু তাঁর চিন্তা-দর্শন থেকেই ‘আমাদের জাতীয়তাবাদ বাঙালী’র পরে আমাদের সবার ব্যক্তি পরিচয় ‘আমরা মানুষ’ হিসেবে তুলে ধরেছেন। তৃতীয় স্থানে ব্যক্তিগত বিশ্বাস ‘ধর্ম’কে গুরুত্ব দিলেও স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে আমরা যেন তৃতীয় ধর্মবিশ্বাসকে প্রথমে তুলে আনার চেষ্টা করছি। ব্যক্তিগত থেকে দলীয় বা রাজনৈতিকভাবে, সমাজ বা রাষ্ট্রীয়ভাবেও সুকৌশলে ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি বা ‘সচেতন মুসলমান’ হওয়ার চেষ্টা করছি। এমনকি কতিপয কর্পোরেট হাউস থেকে গণমাধ্যম হাউসগুলোও তার ব্যতিক্রম নয়। বিজ্ঞাপন, পোস্টার-ব্যানার থেকে সেøাগানেও ধর্মকে যুক্ত করে খাঁটি ধার্মিক হওয়ার চেষ্টা করছি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘বাঙালী’ ‘মানুষ’ এবং ‘মুসলমান’, আজ আমরা কতটুকু ধারণ ও পালন করছি। সেইসঙ্গে রাষ্ট্র কিভাবে এই ‘দর্শন’কে গুরুত্ব দিচ্ছে কিংবা বাস্তবায়ন করছে, এটি গভীরভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির হিসেব-নিকেশ, জনপ্রিয়তা ধরে রাখার কৌশলের পাশাপাশি রাজনীতির মাঠে বিশেষ শ্রেণীর সমর্থন অর্জন যা ভোটের রাজনীতি, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার রাজনীতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার ভবিষ্যত কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে বা দাঁড়াবে, তা বেলা থাকতেই বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। কারণ, ধর্মীয় বিশ্বাসের নামে সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোর রন্ধ্রে-রন্ধ্রে সাম্প্রদায়িকীরণনীতি সুকৌশলে বিস্তারের সুযোগ নেয়ার চেষ্টা হচ্ছে, যেমন-নারীর হিজাব, পুরুষের টাকনুর ওপর পোশাক পরার বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট। এখানে সরকারী বিধি অনুযায়ী নয়, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. মুহাম্মদ আবদুর রহিম তার অফিস চালাতে চেয়েছেন নিজের ব্যক্তিগত মনমর্জি বা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। রাষ্ট্র টের পেয়েছে বা অনুধাবন করতে পেরেছে যখন তার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ড্রেস কোড নির্ধারণ করে (২৮ অক্টোবর, ২০২০) এক বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে, তখন। আবার এই সাম্প্রদায়িক মৌলবাদগোষ্ঠী একদিন ধর্মীয় অপপ্রচার-মিথ্যাচার আর নিজেদের মনগড়া ফতোয়া জারি করে তথাকথিত অভিযোগ (আজ ভাস্কর্য কাল কী) তুলে দেশের শিল্প-সাহিত্য আর সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করবে- এটি রাষ্ট্র বুঝেছে কুষ্টিয়া পৌরসভার পাঁচ রাস্তার মোড়ে নির্মাণাধীন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যের সম্মানহানীর মাধ্যমে, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলার পরে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, একটি দেশের ভবিষ্যত নির্ভর করে তার জনগণের ওপর। যে দেশের জনগণ যত শিক্ষিত-সভ্য, যত দেশপ্রেমিক-ওই দেশ ততই শক্তিশালী। আর এই শক্তিশালী জনগণ সৃষ্টি হয় একটি দেশের সঠিক ইতিহাস-ঐতিহ্য জানাশোনার মধ্য দিয়ে। যা ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে রীতিমতো পরিকল্পনা গ্রহণ করে সেই ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে, মুছে ফেলেছে এবং অলিখিতভাবে নিষিদ্ধও করা হয়েছে। কিন্তু আমরা কী করেছি- এই প্রশ্ন স্বাধীনতাকামী বাঙালী ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে প্রশ্ন করতেই পারেন। আবার স্বাধীনতার পক্ষের সরকার-মহাজোট কী করেছে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটি জাতি গঠনে কী কী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়েছে-এটিও দেখা দরকার। তবে তথ্য-প্রমাণ বলে, আমরা জেনে কিংবা অজানায় স্বাধীনতাবিরোধীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছি। দল কিংবা গ্রুপ ভারি করতে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীদের নিজের করে নিয়েছি। ধর্মের কথা বলে ‘ছাড়’ দেয়ার প্রবণতায় আজ আমাকেই (বাংলাদেশ) জঙ্গী পাকিস্তান-আফগানিস্তান করতে ষড়যন্ত্র করছে। দেশের অগ্রযাত্রাকে বহির্বিশ্বে প্রশ্নবিদ্ধ করার নীলনকশা প্রণয়ন করছে তাও আমারটা (বাংলাদেশ) খেয়ে, আমারটাই (বাংলাদেশ) পড়ে। কারণ, আমার ব্যর্থতার সুযোগই নিতে চেষ্টা করছে। আমি কেন ঈগল সৃষ্টি করতে পারিনি। তাই কুৎসিক কাকও আজ আমাকে ঠোকর দিতে চেষ্টা করছে। ভাস্কর্যের অজুহাতে দেশের শিল্প-সাহিত্য আর সাংস্কৃতিকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করছে, হুমকি ধমকি দিচ্ছে। আমাদের গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে, একটি দেশের শিল্প-সাহিত্য কিংবা সাংস্কৃতির গতিপথ যখন দুর্বল হয়ে পড়ে, পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে যখন দেশের ইতিহাস-দর্শন চর্চা ঝিমিয়ে পড়ে, তখনই জঙ্গী-মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। হুমকির মুখে পড়ে দেশ ও মানবতা, নষ্ট হয় দেশের ভাবমূর্তি। আর এখানেই আমাদের গবেষণা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ, সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদ-জঙ্গী গোষ্ঠীর ‘ভাইরাস’ রাষ্ট্রযন্ত্র প্রশাসন দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এ্যান্টিভাইরাস-সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক বিপ্লব এবং ধর্মীয় রাজনীতির মূল উৎপাটনের দিকে মনোযোগী হওয়া সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। লেখক : সভাপতি-বাংলাদেশ অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)
×