ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রুমেল খান

সাবিনার রেকর্ডে বসুন্ধরা কিংসের শিরোপা

প্রকাশিত: ০০:০২, ৯ ডিসেম্বর ২০২০

সাবিনার রেকর্ডে বসুন্ধরা কিংসের শিরোপা

জাতীয় দলের প্রায় সব ফুটবলারই এই দলে। রিজার্ভ বেঞ্চও যথেষ্ট শক্তিশালী। কাজেই তারাই যে হেসে-খেলে লীগের শিরোপাটা জিতে নেবে প্রথমবারের মতো, এটাই অনুমেয় ছিল। রবিবার ১৩-১ গোলে জামালপুর কাচারিপাড়া একাদশকে হারিয়ে সেই কাজটিই সেরে ফেলে বসুন্ধরা কিংস নারী ফুটবল দল। মহিলা ফুটবল লিগের তৃতীয় আসরে প্রথমবার অংশ নিয়েই তারা এই সাফল্য কুড়িয়ে নিল। একটা লিগে মাত্র ৭টি দল। ডাবল লেগে খেলা হলে প্রতিটি ক্লাব দল খেলবে ১২টি করে ম্যাচ। আচ্ছা, এই ১২ ম্যাচে একটি দল সর্বোচ্চ কয়টি গোল করতে পারে বলে অনুমান করুন তো। ৩০, ৪০, ৫০ ৬০ বা ৭০টি? উহুঁ, হলো না। যদি বলি ১২ নয়, ১১ ম্যাচ খেলেই একটি দল ১০৫টি গোল করে ফেলেছে, তাহলে নিশ্চয়ই কপালে চোখ উঠে যাবে আপনাদের, তাই না? হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য হলেও এবারের মহিলা ফুটবল লিগে এমনটাই ঘটেছে। আর সেটা ঘটিয়েছে এক ম্যাচ হাতে রেখে অভিষেক লিগেই অংশ নিয়ে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হওয়া বসুন্ধরা কিংস মহিলা ফুটবল দল। ২০১১ সালে প্রথম লীগ শুরু হয়েছিল। দুই গ্রুপে অংশ নেয় আটটি দল। লিগে চ্যাম্পিয়ন হযেছিল শেখ জামাল। রানার্সআপ হয়েছিল মোহামেডান। ২০১৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি মাঠে গড়িয়েছিল ঢাকা মহানগরী মহিলা ফুটবল লিগ’-এর দ্বিতীয় আসর। সেবারও অংশ নিয়েছিল আটটি দল। চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ঢাকা আবাহনী লিমিটেড। রানার্সআপ হয়েছিল মোহামেডান। এবারের লিগে বসুন্ধরা মেয়েরা যেমন সবচেয়ে বেশি গোল করেছে, তেমনি সবচেয়ে কম গোলও হজম করেছে। মাত্র ২ গোল খেয়েছে তারা। গোলরক্ষক রূপনা চাকমা তো বলতে গেলে পুরো লিগেই নিজের গোলসীমানায় অলস সময় কাটিয়েছেন! ২০১১ এবং ২০১৩ সালের লিগে যথাক্রমে শেখ জামাল (২৫ গোল) ও আবাহনীর (২৯ গোল) হয়ে যিনি সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন, সেই সাবিনা খাতুন এবারও লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হতে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত তার গোলসংখ্যা ৩০টি। আরও ১টি ম্যাচ খেলে এই সংখ্যাকে অতিক্রম করার সুযোগও পাবেন তিনি। মহিলা ফুটবল লিগে রবিবার এক ম্যাচ হাতে রেখেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বসুন্ধরা কিংস। কমলাপুর স্টেডিয়ামে খেলতে নেমে কিংসের অধিনায়ক,ফরোয়ার্ড সাবিনা খাতুন একাই করেন ৫ গোল! তিনি অনেক চেষ্টা করেছিলেন আরেকটি গোল করে ডাবল হ্যাটট্রিক করতে। কিন্তু কপাল মন্দ, একবার বল প্রতিপক্ষের পোস্টে লাগিয়েও লক্ষ্যপূরণ করতে পারেননি। ফলে অক্ষত থেকে যায় সাদিয়া আক্তারের কীর্তি। কদিন আগে জামালপুর কাচারিপাড়া একাদশ ৭-১ গোলে বিধ্বস্ত করে এফসি উত্তরবঙ্গকে। ওই ম্যাচে একাই ডাবল হ্যাটট্রিক করেছিলেন বিজয়ী দলের অধিনায়ক-ফরোয়ার্ড সাদিয়া আক্তার। এই লীগে এটাই প্রথম ডাবল হ্যাটট্রিকের নজির। রবিবার আরেকটি ব্যক্তিগত গোল করলে সাবিনাও সাদিয়ার কীর্তির সমক্ষতা অর্জন করতে পারতেন। তবে সাদিয়ার কীর্তিকে স্পর্শ করতে না পারলেও রবিবার সাবিনা ঠিকই আরেকটি কীর্তি গড়েছেন। সেটি হলো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারী-পুরুষ মিলিয়ে প্রিমিয়ার লিগে টানা দু’বার ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড গড়া। এক্ষেত্রে সাবিনা ভেঙ্গেছেন আব্দুস সালাম মুর্শেদীর রেকর্ড (যিনি এখন বাফুফের সিনিয়র সহ-সভাপতি)। ১৯৮২ সালের লিগে মোহামেডানের জার্সিতে সালাম করেছিলেন সর্বোচ্চ ২৭ গোল। ভেঙ্গে দিয়েছিলেন বাফুফের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের ২৪ গোলের রেকর্ড। চলতি লিগে এ পর্যন্ত সাবিনার গোলসংখ্যা ৩০টি। দলের আরও একটি ম্যাচ বাকি থাকলেও তিনিই যে লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হতে যাচ্ছেন, তা প্রায় নিশ্চিতই। এই লিগে সবচেয়ে বেশি হ্যাটট্রিকের (৭টি) মালকিন তিনিই। এর আগে ২০১১ সালের লিগে শেখ জামালের জার্সিতে ২৫ ও ২০১৩ লিগে আবাহনীর জার্সিতে ২৮ গোল করে লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন সাবিনা। সবকিছু ঠিক থাকলে টানা তিন লিগেই টপ গোলস্কোরার হবেন তিনি। এছাড়া ২০১৩ সালে কেএফসি জাতীয় মহিলা ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপেও সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন সাবিনা। শুধু তাই নয়, জাতীয় দলের জার্সিতে সবচেয়ে বেশি গোল তারই (৩৭ ম্যাচে ১৯ গোল)। কদিন আগেই সাবিনা আরেকটি ‘মহাকীর্তি’ গড়েছিলেন। নারী-পুরুষ মিলিয়ে বাংলাদেশের প্রথম ফুটবলার হিসেবে ক্লাব দলের জার্সিতে ২৫০ গোলের প্রথম মাইলফলক স্থাপন করেন (৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট গোলসংখ্যা ২৫৭)। প্রথম নারী বাংলাদেশী হিসেবে বিদেশের লিগে খেলার ইতিহাস পড়েন সাবিনা, ২০১৫ সালে। ওই বছরই তিনি দু’বার দেশটিতে গিয়ে দুটি ভিন্ন ক্লাবে ভিন্ন দুটি আসর খেলেন। প্রথমে খেলেন মালদ্বীপস উইমেন্স ফুটসাল ফিয়েস্তা টুর্নামেন্টে, মালদ্বীপ পুলিশ ক্লাবে। ফাইনালে সাবিনার দল রানার্সআপ হয়। দলকে শিরোপা জেতাতে না পারলেও ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে সাবিনা ছিলেন সমুজ্জ্বল। করেন টুর্নামেন্টের ব্যক্তিগত সর্বাধিক ৩৭ গোল (মাত্র ৬ ম্যাচে ৫ হ্যাটট্রিকসহ) ৫ ম্যাচেই হন ম্যাচসেরা। টুর্নামেন্টে জেতেন চারটি ব্যক্তিগত পুরস্কার। এরপরের বছর খেলেন মালদ্বীপের ধিভেহি সিফেইনগে ক্লাবের হয়ে ‘এফএএম ওমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপ’-এ। দলের হয়ে সর্বাধিক ২২ গোল করেন। ২০১৮ সালে ভারতের সেথু এফসির হয়ে ইন্ডিয়ান ওমেন্স লিগে খেলেন। সেমিতে হেরে যায় সেথু। তবে দলের ১১ গোলের ৭টিই করেন সাবিনা! দেশের লিগে খেলে সাবিনা এ পর্যন্ত ৮৩ গোল করেছেন। তার লক্ষ্য দেশের প্রথম মহিলা ফুটবলার হিসেবে লিগে গোলের সেঞ্চুরি পূরণ করা। সেজন্য আর মাত্র ১৭ গোল করতে হবে তাকে। ফর্মে থাকলে গোলমেশিন সাবিনা যে এই লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারবেন না, এমনটা বাজি ধরার নিশ্চয়ই কেউ নেই! নিজেদের দল বেশি শক্তিশালী বলে বা প্রতিপক্ষ দলগুলো দুর্বল বলেই কি প্রতি ম্যাচে এভাবে মুড়িমুড়কির মতো গোল করতে পেরেছেন? আপত্তি জানান সাবিনা, ‘প্রথম লেগের জন্য এটা সঠিক প্রশ্ন, কিন্তু দ্বিতীয় লেগের জন্য নয়। কেননা দ্বিতীয় লেগে জাতীয় দলের অনেক খেলোয়াড় অন্য দলগুলোতে খেলেছে। তাই তারা আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়েছিল। তাছাড়া দুর্বল দলের বিরুদ্ধেও নিয়মিত গোল করতে পারাও কি কৃতিত্বপূর্ণ নয়? তাদের বিরুদ্ধে যদি গোল করতে না পারতাম, তাহলে নিশ্চয়ই আমাকে নিয়ে প্রশ্ন উঠতো না?’ সাবেক ব্যবসায়ী বাবা ও গৃহিণী মায়ের পাঁচ মেয়ের একজন সাবিনা। বিজেএমসিতে চাকরি করেন ২০১১-২০১৯ সাল পর্যন্ত। ২০০৯ সালে যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়েন, তখন শুরু করেন ফুটবল খেলা। সাতক্ষীরা জেলা ফুটবল কোচ আকবর স্যারের মাধ্যমেই ফুটবলের হাতেখড়ি। স্কুল পর্যায়ে আন্তঃস্কুল ও আন্তঃজেলা পর্যায়ে খেলেন। ওই বছরই ভাল খেলার সুবাদে ডাক পান জাতীয় দলে। সাতক্ষীরা থেকে তিনিসহ ডাক পান ছয়জন। চূড়ান্ত বাছাইয়ে কেবল টিকে যান সাবিনাই। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত জাতীয় দলের হয়ে টানা খেলছেন। সাবিনাকে সংবর্ধনা ॥ ক্লাব দলের হয়ে দেশে-বিদেশে মিলিয়ে ২৫০ গোলের মাইলফলক স্পর্শের জন্য বাংলাদেশ ফুটবল সাপোর্টার্স ফোরামের (বিএফএসএফ) আয়োজনে বসুন্ধরা কিংস বিএফএসএফ অনুর্ধ-১৪ একাডেমি কাপে সোমবার প্রথম খেলার মধ্য বিরতিতে সাবিনাকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। সাবিনার হাতে ক্রেস্ট এবং ফোরামের জার্সি তুলে দেন ফুটবল সাপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি কাজী শহীদুল আলম ও সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন জুবায়ের। অনুষ্ঠানে সবিনা জানান, তিনি এখানেই থেমে যেতে চান না। আন্তর্জাতিক আসরে দেশের হয়ে আরও গোল করতে চান। উল্লেখ্য, বসুন্ধরা কিংস বিএফএসএফ অ-১৪ একাডেমি কাপে ওয়ারিয়র স্পোর্টস একাডেমির হেড কোচের দায়িত্ব পালন করছেন সাবিনা। সাবিনার আদ্যোপান্ত ॥ বাবা : সৈয়দ গাজী, মা : মমতাজ বেগম, নিবাস : পলাশপুর, সাতক্ষীরা সদর, জন্ম : ২৫ অক্টোবর, ১৯৯৩, পড়াশোনা : গণবিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকর্ম বিভাগে তৃতীয়বর্ষের ছাত্রী, ভবিষ্যত লক্ষ্য : দেশকে সাফ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জেতানো, আদর্শ ফুটবলার : আমিনুল হক, মার্তা এবং লিওনেল মেসি, ক্লাব : শেখ জামাল ধানমণ্ডি, মোহামেডান স্পোর্টিং, টিম বিজেএমসি ও বসুন্ধরা কিংস, জার্সি নম্বর : জাতীয় ও ক্লাব দলে ১০।
×