ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

উৎপাদন ও বিক্রির রেকর্ড

করোনাকালে সচল মধ্যপাড়া পাথর খনি

প্রকাশিত: ২৩:২১, ৯ ডিসেম্বর ২০২০

করোনাকালে সচল মধ্যপাড়া পাথর খনি

স্টাফ রিপোর্টার, দিনাজপুর ॥ মহামারী করোনায় যখন একের পর এক শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বেকার হচ্ছে লাখ লাখ কর্মক্ষম মানুষ। তখন ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে দিনাজপুরের মধ্যপাড়া পাথর খনিতে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন দেশের একমাত্র মধ্যপাড়া পাথর খনিতে রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদনের পাশাপাশি বিক্রিও বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণে। করোনায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে দেশের অর্থনীতির চাকা খনির উন্নয়ন ও উৎপাদন সমান তালে সচল রেখেছে খনির ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান জার্মানিয়া-ট্রেস্ট কনসোর্টিয়াম (জিটিসি)। জিটিসি দায়িত্ব গ্রহণের পর দুইবার লাভের মুখ দেখল। করোনা পরিস্থিতিতেও মাত্র সাড়ে ৩ মাসে পাথর উত্তোলন হয়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার টন পাথর। শুধুমাত্র গত এপ্রিল থেকে নবেম্বর পর্যন্ত ৭ মাসে মহামারী করোনাকালীন সময়ে ৯ লাখ ১ হাজার ৫০০ টন পাথর বিক্রি করে রাজস্ব আয় হয়েছে ২শ’ ২৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা, যা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। মঙ্গলবার পর্যন্ত খনির ইয়ার্ডে বর্তমানে মজুদ আছে ২ লাখ ৫ হাজার মেট্রিক টন পাথর। সোমবার খনি থেকে পাথর বিক্রি হয়েছে ১৫ হাজার মে. টন। প্রতিমাসে পাথর উৎপাদন হচ্ছে ১ লাখ ২৫ হাজার মে. টন। খনি সূত্রে জানা গেছে, করোনায় ৩ মাস বন্ধ থাকার পরও ২০১৯-২০ অর্থবছরে খনি থেকে ৮ লাখ ২৩ হাজার ৯শ’ ৫৯ মে. টন পাথর উৎপাদন করা হয়। বিক্রি হয়েছে ৮ লাখ ৬৪ হাজার ৯শ’ ৬ দশমিক ৫২ মে. টন। এ থেকে প্রায় ২১ কোটি টাকা মুনাফা হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৬শ’ ৪৬ মে. টন। এর মধ্যে ৭ লাখ ৩১ হাজার ৪শ’ ৯৩ টন পাথর বিক্রি করে ৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা মুনাফা হয়েছে। করোনাকালীন সময়ে গত এপ্রিল থেকে নবেম্বর পর্যন্ত ৭ মাসে ৯ লাখ ১ হাজার ৫শ’ টন পাথর বিক্রি করে রাজস্ব আয় হয়েছে ২শ’ ২৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। জিটিসির সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী খনির উন্নয়ন ও উৎপাদন সহায়ক সব ধরনের যন্ত্রাংশ ও যন্ত্রপাতি সরবরাহ করবে খনি কর্তৃপক্ষ। খনি কর্তৃপক্ষ সময়মতো খনির অতি প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ ও খনির উন্নয়ন ডিজাইন সরবরাহ করতে না পারায়, ২০১৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৭ সাল ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২ বছর পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকে। দেশের একমাত্র মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড (এমজিএমসিএল) বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করে ২০০৭ সালের ২৫ মে। প্রথম অবস্থায় খনি থেকে দৈনিক ১ হাজার ৫শ’ থেকে ১ হাজার ৮শ’ টন পাথর উত্তোলন হলেও পরে তা নেমে আসে মাত্র ৫শ’ টনে। এর ফলে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত ৬ বছরে খনিটি লোকসান দেয় প্রায় এক শ’ কোটি টাকা। এতে খনিটি ২০০৭ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রায় ২শ’ কোটি টাকা লোকসান করে। এমন অবস্থায় খনির উৎপাদন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেয়া হয় বেলারুশের জেএসসি ট্রেস্ট সকটোস্ট্রয় ও দেশীয় প্রতিষ্ঠান জার্মানিয়া কর্পোরেশন লিমিটেড নিয়ে গঠিত জার্মানিয়া ট্রেস্ট কনসোর্টিয়ামকে (জিটিসি)। জিটিসির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ২০১৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর। চুক্তি অনুযায়ী তারা ৬ বছরে ১৭১ দশমিক ৮৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে ৯২ লাখ টন পাথর উত্তোলন করবে। চুক্তি কার্যকর হয় ২০১৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি, উৎপাদন শুরু করে ২৪ ফেব্রুয়ারি। এরই মধ্যে জিটিসির সঙ্গে চুক্তি মেয়াদ শেষ হয়ে যায় চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি। এ সময়ের মধ্যে জিটিসি পাথর উত্তোলন করে প্রায় ৩৭ লাখ মেট্রিক টন। এরপর নতুন করে চুক্তি হয়। ২০২১ সালের ১৭ জুলাই জিটিসির নতুন চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। নতুন চুক্তি অনুযায়ী ১ বছরে জিটিসি ১ দশমিক ১ মিলিয়ন টন পাথর উৎপাদনের পাশাপাশি খনি ভূ-গর্ভে দুটি স্টোপ উন্নয়ন করবে। জিটিসির মতে প্রয়োজনীয় মাইনিং ইক্যুইপমেন্ট এবং এক্সপ্লোসিভের (বিস্ফোরক) অভাবে তারা ৩ বছর খনিটি পরিচালনা করতে পারেনি। এ জন্য মধ্যপাড়া খনি কর্তৃপক্ষকে দায়ী করে জিটিসি ৩ বছর সময় এবং যন্ত্রাংশ কেনা বাবদ ৩শ’ ৩ কোটি টাকা দাবি করে। বিষয়টি এক পর্যায়ে আরবিটেশন ট্রাইব্যুনাল পর্যন্ত গড়ায়। আরবিটেশন ট্রাইব্যুনাল স্থিতিয়াবস্থা দিলে, তা জিটিসির পক্ষে যায়। উভয়পক্ষের এই অচলাবস্থার মধ্যে ২০১৯ সালের ৭ নবেম্বর মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে এবিএম কামরুজ্জামান যোগদান করে জিটিসির সঙ্গে বিরোধ নিরসনে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবিএম কামরুজ্জামান বলেন, বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণ বিস্তারের ফলে অন্য কোন উৎস থেকে উন্নতমানের পাথর সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। দেশের বিভিন্ন সরকারী মেগা প্রকল্পের পাথরের চাহিদা পূরণের জন্য এ খনির বিশ্বমানের পাথর নেয়ার জন্য সব প্রতিষ্ঠান আগ্রহী হয়ে ওঠে। এছাড়াও মধ্যপাড়ার পাথর ব্যবহারে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সাড়া দিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, বাংলাদেশ রেলওয়ে, পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু সেতুর রেলসংযোগ নির্মাণ প্রকল্প, রেলপথ ও সড়ক সেতু মন্ত্রণালয়সহ বহু সরকারী প্রতিষ্ঠান তাদের নির্মাণ কাজে মধ্যপাড়ার পাথর ব্যবহার করেছে। এ ঘটনা মধ্যপাড়ার পাথরের চাহিদা ও বিক্রি বৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। যা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।
×