ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আর দেরি নয় ওড়াও নিশান...

প্রকাশিত: ২৩:১৯, ৯ ডিসেম্বর ২০২০

আর দেরি নয় ওড়াও নিশান...

মোরসালিন মিজান ॥ ভাইরাস সংক্রমণ ও মৃত্যু অব্যাহত রয়েছে। অনেক কিছুই এখন বন্ধ। থমকে আছে। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী অপশক্তি বসে নেই। বৈশ্বিক দুর্যোগের কালেও ষড়যন্ত্রের জাল বুনে চলেছে। বাঙালীর সব অর্জন ওরা গিলে খেতে চায়। এ অবস্থায় কেমন হবে এবারের বিজয় দিবস? কী বার্তা নিয়ে আসবে? উদ্যাপন করা কতটা সম্ভব? অনেকগুলো প্রশ্ন। উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা যাাচ্ছে, কোভিড পরিস্থিতি নিয়ে আরও অনেকের মতো উদ্বেগ আছে আয়োজকদের মধ্যেও। তবে পশ্চাৎপদ ধর্মান্ধ জঙ্গী গোষ্ঠীকে আর বাড়তে দেয়া যাবে না। কোন ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। আগামী ১৬ ডিসেম্বর সীমিত পরিসর আয়োজন থেকে রণাঙ্গনে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানানো হবে। জীবিতদের জানানো হবে অভিনন্দন। কৃতজ্ঞতা। একই সময় স্বাধীনতা বিরোধী উগ্রবাদীদের প্রতিহত করার দৃঢ় শপথ নেবে জাতি। সেভাবেই চলছে প্রস্তুতি। আজকের মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য বহুকাল ধরে লড়তে হয়েছিল বাঙালীকে। আন্দোলন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় আসে ১৯৭১। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এর পর শসস্ত্র সংগ্রাম। মুক্তিযুদ্ধ। বাংলা মায়ের বীর সন্তান মাত্রই হাতে অস্ত্র তুলে নেন। শক্তিশালী প্রশিক্ষিত পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এভাবে দীর্ঘ নয় মাস প্রাণপণ লড়ে শত্রুমুক্ত করেন জন্মভূমিকে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। মাসটি তাই ভীষণ আবেগের। ৩০ লাখ মানুষ হত্যা করেছিল বর্বর পাকিস্তান বাহিনী। মায়েদের মেয়েদের ওপর চালিয়েছিল নির্মম নির্যাতন। গ্রামের পর গ্রাম আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছিল। সারাবাংলা শ্মশানে পরিণত করেছিল তারা। বাঙালীকে তবু দাবিয়ে রাখা যায়নি। বিজয়ী হয়ে তবেই ফিরেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। বাকিরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়ে বাংলা মায়ের বুকে লুটিয়ে পড়েছেন। বিজয় দিবসের প্রাক্কালে আনন্দ-বেদনার সেই মহা ইতিহাস নানা ভাব ও ভাষায় প্রকাশিত হচ্ছে। আর মাত্র ক’দিন পর মহা বিজয়ের মাহেন্দ্রক্ষণ। তার আগে লাল-সবুজ রঙে সেজে উঠছে রাজধানী শহর। এখানে ওখানে জাতীয় পতাকা উড়ছে। আর দেরি নয় ওড়াও নিশান...। অলি-গলিতে নিশান উড়িয়ে দিয়েছে বাঙালী। বিরুদ্ধ সময়ে পতাকার প্রতিটি ঢেউ যেন নতুন করে জেগে ওঠার আহ্বান। বাচ্চা থেকে বুড়োরা পতাকার জন্য হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। মৌসুমি বিক্রেতারা কাঁধে বহন করছেন নানা মাপের পতাকা। ওড়াতে ওড়াতেই যাচ্ছেন তারা। দেখে মন আপনি গেয়ে ওঠে: বিজয় নিশান উড়ছে ঐ/খুশির হাওয়ায় ঐ উড়ছে/ বাংলার ঘরে ঘরে/ মুক্তির আলো ঐ ঝরছে...। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম সংলগ্ন এলাকায় কথা হচ্ছিল দেলওয়ার নামের এক পতাকা বিক্রেতার সঙ্গে। কাঁধে অনেকগুলো পাতাকা নিয়ে বিক্রি করতে বের হয়েছিলেন তিনি। বললেন, ‘আমি একেক সময় একেক কাজ কাম কইরা খাই। এহন তো ধরেন ডিসেম্বর মাস। এই সময় পতাকা নিয়া বাইর হইতেই বেশি ভাল লাগে। অনেকেই কিনে। ছোটরা তো দেখলেই নিতে চায়। আমার ভালই লাগে এইগুলা।’ সরল উচ্চারণে এই বিক্রেতা আরও বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ দেখি নাই। কিন্তু যুদ্ধে আমরা পাঞ্জাবীরে হারাইছি। এইটা ভাবলে শান্তি পাই।’ পতাকা সেলাইয়ের কাজও এখন চলছে গুলিস্তানে। একসঙ্গে একাধিক সেলাই মেশিনে পতাকা সেলাই করা হচ্ছে। দর্জিরা ব্যস্ত। কিবরিয়া নামের এক দর্জি বললেন, ‘১৬ ডিসেম্বরের আগে অনেক পতাকা বানাই। বানাইয়া আসতেছি। কিন্তু এইবার অর্ডার কম। তবুও কাজটা কইরা আনন্দ পাই।’ একই আনন্দের জায়গা থেকে আগামী কয়েকদিন প্রচুর পতাকা সংগ্রহ করা হবে বলে আশা করেন এই বিক্রেতা। বিজয় দিবস সামনে রেখে প্রতিবছর এই সময়ে প্রাক উৎসব অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যায়। এবার সে তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে। তবে বন্ধ থাকছে না কিছুই। প্রস্তুতি এগিয়ে চলেছে। রাজধানীতে সবচেয়ে বড় পরিসরে বিজয় দিবস উদ্যাপন করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। বেশ কয়েকটি মঞ্চ থেকে একযোগে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এবার প্রাথমিকভাবে তিন দিনের কর্মসূচী চূড়ান্ত করা হয়েছে। জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ জানান, কোভিড পরিস্থিতির কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে উৎসব আয়োজন করা হবে। তিন দিনের অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করা হয়েছে। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে একাত্তরে নিহতদের স্মরণে প্রদীপ প্রজ্বালন করা হবে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে সন্ধ্যায় প্রদীপ প্রজ্বালনে অংশ নেবেন বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। পরদিন ১৫ ডিসেম্বর একই স্থানে সংক্ষিপ্ত পরিসরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসেও থাকবে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান। জোট সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, আমরা গান কবিতা নৃত্যের ভাষায় একাত্তরে রণাঙ্গনে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাব। কৃতজ্ঞতা জানাবেন জীবিত বীরদের প্রতি। তাদের শক্তি সাহস অনুপ্রেরণা নিয়েই আজকের স্বাধীনতা বিরোধী মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করব। উৎসবের চেয়ে এবার প্রতিবাদ প্রতিরোধের আহ্বানই বেশি থাকবে বলে জানান তিনি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উদ্যোগেও টানা কয়েকদিন ধরে বিজয় দিবস উদ্যাপন করা হয়। এবারও তা-ই হবে। তবে ভার্চুয়াল মঞ্চ থেকে। জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক জানান, ৮ দিনের কর্মসূচী চূড়ান্ত করেছেন তারা। শুরু হবে আজ ৯ ডিসেম্বর থেকে। দিনটিকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধের আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। একাত্তরে এ দেশে বর্বর গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তান আর্মি। সে আলোকে আজকের অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু ঠিক করা হয়েছে। রাত ৮টায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ফেসবুক পাতা (যঃঃঢ়ং://িি.িভধপবনড়ড়শ.পড়স/ষরনবৎধঃরড়হধিৎসঁংবঁস.ড়ভভরপরধষ) থেকে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হবে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সেন্টার ফর দ্য স্টাডিজ অব জেনোসাইড এ্যান্ড জাস্টিসের উদ্যোগে সূচনা বক্তব্য রাখবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি ও সেন্টারের পরিচালক মফিদুল হক। থাকবে জাতিসংঘ প্রেরিত ‘দ্য জেনোসাইড কনভেন্সন: এ কল ফর এ্যাকশন’ শীর্ষক ভিডিও বার্তা। ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব মেমোরিয়াল মিউজিয়ামস ইন রিমেমবারন্স অব দ্য ভিকটিমস অব পাবলিক ক্রাইমস (আইসিএমইএমও)-এর চেয়ার পার্সন ওফেলিয়া লিওন-এর বিবৃতি প্রচার করা হবে। যুদ্ধাপরাধ বিশেষজ্ঞ থিওডোর মিরনের সাক্ষাতকার ও গণহত্যার শিকার বাংলাদেশ, কম্বডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, পোল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও তিমুরের প্রতিনিধিদের বক্তব্য উপস্থাপিত হবে। পরবর্তী দিনের আয়োজনে আলোচনা ছাড়াও থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শিল্পকলা একাডেমি বাংলা একাডেমি জাতীয় জাদুঘরসহ গুরুত্বপূর্ণ সরকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও বিজয় দিবস উদ্যাপনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। অন্যান্য সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও চলছে নানা প্রস্তুতি। শহর ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ ভবনে যথারীতি আলোকসজ্জা করা হবে। টেলিভিশনগুলো বিজয় দিবস উপলক্ষে প্রচার করবে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। থিয়েটার মঞ্চে থাকবে মুক্তিযুদ্ধ ঘনিষ্ঠ প্রযোজনা। সব আয়োজন থেকে একাত্তরের বিরোধী শক্তি মৌলবাদী উগ্রবাদীদের প্রতিহত করার ডাক দেয়া হবে। বিশেষত প্রতিবাদ প্রতিরোধের হয়ে উঠবে এবারের বিজয় দিবস।
×