ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রাজন ভট্টাচার্য

অভিমত ॥ হেফাজতের দাবি ও আওয়ামী লীগের বক্তব্য

প্রকাশিত: ২০:৫৫, ৯ ডিসেম্বর ২০২০

অভিমত ॥ হেফাজতের দাবি ও আওয়ামী লীগের বক্তব্য

উগ্র সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী চিন্তা চেতনায় বিশ^াসী হেফাজতে ইসলাম। যাদের জন্ম যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত রাজনৈতিক দল জামায়াতের আঁতুর ঘর থেকে। রাজনৈতিক কারণে হঠাৎ করেই সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে দেশের সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্য ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এই সংগঠনটি। এর নেপথ্যে রয়েছে সরকারের প্রচ্ছন্ন ছায়া। মূলত রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই হেফাজতকে তোষণ করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। তবে ১৪ দল এ ব্যাপারে অনেক ক্ষেত্রেই বিরোধী। শরিক নেতাদের হেফাজতবিরোধী বক্তব্য থেকেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে অনেক আগে থেকেই। প্রশ্ন হলো, এত আপোসকামিতার পরও হেফাজত কেন শেষ পর্যন্ত জাতির জনকের জন্মশতবর্ষের কর্মসূচীর মধ্যে বেপরোয়া আচড়ন করছে? রাষ্ট্র ও সংবিধানের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবস্থান নিয়েছে। দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিচ্ছে। অন্য ধর্মের ওপর চড়াও হচ্ছে। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে এ নিয়ে কঠোর মনোভাব স্পষ্ট নয়। অর্থাৎ, একেবারেই কৌশলী অবস্থান। ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরসহ গোটা মতিঝিল এলাকা এমনকি ঢাকা মহানগরী ঘেরাও করেছিল হেফাজত। তিনভর তাদের তাণ্ডবলীলা দেখেছিল বাংলাদেশ তথা গোটা বিশে^র মানুষ। হঠাৎ করেই সংগঠনটি এত মানুষ কোথায় পেল? ৫০ হাজারের বেশি কওমী মাদ্রাসা ও গ্রামের সহজ সরল ধর্মপ্রাণ মানুষ তাদের জনবলের উৎস। এ থেকেই প্রমাণ হয় কওমী মাদ্রাসায় সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। তাদের একটি বড় অংশ জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। সব মিলিয়ে তারা এক বড় শক্তির জানান দিয়েছিল। অথচ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কিছুই টের পায়নি? এখানেই থেমে ছিল না সবকিছু। হেফাজতের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তকে সংস্কার এনেছিল সরকার। এই সাম্প্রদায়িক সংগঠনের দাবির মুখে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনের সড়কে ‘লালনের ভাস্কর্য’ সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল। বিমান বাহিনীর অফিসের সামনে ‘ডলফিন’ ভাস্কর্যে হামলা, মতিঝিলে বলাকা ভবনের সামনে ‘বলাকা’ ভাস্কর্যে হামলার কথা কারও ভুলে যাওয়ার কথা নয়। আরেকটি ঘটনাও ছিল সবচেয়ে আলোচিত। সেটি হলো- সুপ্রিম কোর্টের ভাস্কর্য হেফাজতের দাবির মুখে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল সরকার। দেশের বিভিন্ন স্থানে শহীদ মিনারসহ মুক্তিযুদ্ধের স্থাপনার ওপর হামলার ঘটনাও কারও ভুলে যাওয়ার কথা নয়। একের পর এক রাষ্ট্র, সংবিধান ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান নেয়ার পরও সরকার তাদের মোটিভ ধরতে পারেনি। এটা অবিশ^াস্য। পেরেছিল ঠিকই। কিন্তু সময়ের কারণে তারা এত বড় মরণ কামড় বসাবে, এটা হয়ত স্বাভাবিক চিন্তায় আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে আসেনি। এটা তো সত্য যে, যতোই হেফাজতকে এক ছাতার নিচে রাখার চেষ্টা হোক; তারা কি কখনও আওয়ামী লীগ তথা ১৪ দলকে ভোট দেবে? মোটেও না। এটা তাদের নীতি ও আদর্শের বাইরে। কিন্তু দুধ আর কলা দিয়ে পোষা সাপ তো এখন বড় হয়েছে। একদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশোধ, অন্যদিকে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির ইন্ধন। সেই সঙ্গে জামায়াতের সার্বিক সহযোগিতা, রাষ্ট্র ও প্রশাসন যন্ত্রের প্রচ্ছন্ন ইতিবাচক ইশারা তো আছেই। সব মিলিয়ে হেফাজত বসে থাকার নয়। ইস্যুভিত্তিক শক্তির জানান দেয়ার প্রস্তুতি তাদের আছে। তাই তো একটু সময় নিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে ফের মাঠে নামে। আবারও পিছু হটে। তবে সামনের দিনগুলোতে তারা আর পিছু হটবে কিনা, এ নিয়ে প্রশ্ন বা শঙ্কা থেকেই যায়। দেশ বা বিদেশে হেফাজতের অবস্থান বা তারা কি চায় এ বিষয়টি একেবারেই স্পষ্ট। মীমাংসিত। আওয়ামী লীগের একটি অংশ ক্ষমতার প্রয়োজনে হেফাজতকে কোলে তুলে নিলেও, দেশের প্রগতিশীল, মুক্তবুদ্ধিচর্চার মানুষ কিন্তু তাদের মোটেও গ্রহণ করেনি। অনেকে একেবারেই ঘৃণার চোখে দেখেন তাদের। শেষ কথা হলো যার কাছে যাকে ভাল লাগে। তবে কি ভাল মন্দের বিচার বিশ্লেষণ কিছুই থাকবে না। ডিসেম্বর। বিজয়ের মাস। এ মাসকে সামনে রেখেই হেফাজত প্রকাশ্যে রাজধানীর ধোলাইপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতায় নেমেছে। পুলিশের অনুমতি ছাড়াই করোনার উর্ধগতির মধ্যে সমাবেশ করে হুঙ্কার ছেড়েছে। ‘ভাস্কর্য নির্মাণ করা হলে তা টেনে হিঁচড়ে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেয়া হবে’। এখানেই শেষ নয়। মুমিনুল ও বাবুনগরীরা একসুরে বলেছে, মসজিদের নগরীতে ভাস্কর্য এবং মূর্তি থাকতে পারবে না। এমন কি দেশেও নয়! মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সংগঠন হেফাজতের বক্তব্যের পর কি বলছে ক্ষমতাসীন দল- এ নিয়ে দৃষ্টি ছিল সবার। যা বলছে তা আরও বিতর্কিত এমনকি বিপজ্জনকও বটে! আরেকটু বাড়িয়ে বলা যায় আত্মঘাতী বক্তব্য দিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা স্পষ্টভাবেই বার বার বলছেন, ‘ভাস্কর্য ও মূর্তি এক নয়’! তার মানে কি। ভাস্কর্য ভাঙা যাবে না, আর মূর্তি ভাঙা যাবে! না বুঝে আওয়ামী লীগ কতবড় সর্বনাশের পথে পা দিয়েছে! এ নিয়ে কেউ ভাবছেন কিনা জানি না। যদি তাই হয় সামনের দিনগুলোতে হেফাজতের দাবি হবে একটিই। তা হলো দেশে কোন মূর্তি থাকবে না। বা রাখা যাবে না। অন্য ধর্মের মানুষ কোনভাবেই ধর্মচর্চা করতে পারবেন না। তখন কি হবে? অথচ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যুক্তি দিয়ে অনেক কিছুই বলার ছিল। প্রথমেই বলা যায়- ভাস্কর্য হলো একটি দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির স্মারক। তুরস্ক, আরব, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, ইন্দোনেশিয়া, লেবানন, আলজেরিয়ার মতো মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতেও ভাস্কর্য রয়েছে। তাছাড়া বিশে^র অধিকাংশ দেশ তাদের জাতির পিতার ভাস্কর্য নির্মাণ করে-এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। তাই আমাদের দেশে ভাস্কর্য নির্মাণ অবৈধ কিছু নয়। তাছাড়া মূর্তি বা প্রতিমা হলো অন্য ধর্মের বিষয়। দেশের সংবিধান অন্য ধর্মচর্চার বৈধতা দিয়েছে। তারা রাষ্ট্রের নাগরিক। সকল ধর্মের মানুষের ধর্মচর্চা এদেশে বৈধ। সবার সমান সুবিধা ও স্বাধীনভাবে চলার সুযোগ রয়েছে। কোন মানুষের ধর্মচর্চা ও ধর্মীয় স্বাধীনতায় বাধা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া একেবারেই সংবিধান ও রাষ্ট্রবিরোধী কাজ। প্রতিমা/মূর্তির সঙ্গে রয়েছে আধ্যাধিকতার সম্পর্ক। ভাস্কর্যের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে ইহজাগতিকতার। তার মানে এই নয় যে, প্রতিমা নাজায়েজ আর ভাস্কর্য জায়েজ- এখানে কোন ধরনের তুলনা গ্রহণযোগ্য নয়। তাছাড়া, কেউ যদি প্রতিমা ভাঙচুর করে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয় তাহলে তার বিরুদ্ধে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হয়। এসব বিষয় তুলে ধরে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বক্তব্য দিতে দেখা যায় না। তারা কেন তা দেন না এ প্রশ্ন আমার মতো অনেকের। কিন্তু আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মিত্র জাসদ (ইনু), ওয়ার্কার্স পার্টি (মেনন) থেকে শুরু করে অন্যরা হেফাজতের কর্মকাণ্ডের তীব্র বিরোধিতার পাশাপাশি তাদের দাবির বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন। হেফাজতীদের গ্রেফতারেও দাবি জানানো হচ্ছে। সিপিবি, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চ থেকে শুরু করে প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অসাম্প্রদায়িক ৬০টি সংগঠন একযোগে হেফাজতরিরোধী আন্দোলনে নেমেছে। এখন দেশের ৬৪ জেলায় হেফাজতের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন হচ্ছে। সোচ্চার দেশের মানুষ। মিছিল আর স্লোগানে উত্তাল দেশ। যেমন, ২০০১ সালে রাজনৈতিক সরকারের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সব মহল রাস্তায় নেমেছিল। অথচ ক্ষমতাসীন দলের দোদুল্যমান অবস্থানের কারণে নিজেদের রাজনৈতিক শক্তি দেখাতে পারছে না। যা গোটা জাতির জন্য দুঃখজনক। যারা নামছেন তারা দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের গ্রীন সিগন্যাল নিয়ে নয়, নিজেদের মনে জমা হওয়া যন্ত্রণা থেকে হেফাজতের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছেন। সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে আওয়ামী লীগের এমন অবস্থান কি মিত্র দলগুলোর মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করতে পারে না। হয়ত পারে! তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ^াসী অসাম্প্রদায়িক চিন্তার মানুষের মনে কষ্টের রেখাপাত করা খুবই স্বাভাবিক। লেখক : সাংবাদিক
×