ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্ম ও রাজনীতি

প্রকাশিত: ২০:৫৪, ৯ ডিসেম্বর ২০২০

দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্ম ও রাজনীতি

বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনীর উদ্যোগে দু’হাজার তেরোয় এক গণবক্তৃতা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বিষয় ছিল- ‘ধর্ম ও রাজনীতি : দক্ষিণ এশিয়া’ সময়োপযোগী ও দরকারি সে সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ধর্ম, ইতিহাস ও রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা ধর্মকে রাজনীতির বাইরে রাখার অপরিহার্য শর্তে একমত হয়ে গণবক্তৃতা করেছিলেন, যা আজকের বাস্তবতায়ও প্রাসঙ্গিক। সবার বক্তব্যের মূল সুর ছিল অভিন্ন- ধর্মনিরপেক্ষতা গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত। এ শর্ত পূরণ ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার কখনও ভাল কিছু বয়ে আনেনি। তাই ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা রাখতেই হবে। নইলে কোনটিই সুস্থ থাকবে না। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ক্ষতিকর প্রভাব রাষ্ট্রকে কতভাবে আক্রান্ত করতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো তার প্রমাণ। ধর্মনিরপেক্ষ দক্ষিণ এশিয়া গড়তে তাই এ অঞ্চলের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। উপমহাদেশে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের উৎস সন্ধান করতে গেলে পলাশী প্রসঙ্গ অনিবার্যভাবে আসে। সতেরো শ’ সাতান্ন সালের তেইশ জুন সেখানে প্রহসনের যুদ্ধে জয়ী হয়ে ইংরেজ রাজত্বের যে ইতিহাস শুরু হয়েছিল তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে উপমহাদেশে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের ইতিহাস। সিরাজ-উদ-দৌলা সম্পর্কে বিদ্বেষ ছড়াতে গিয়ে যেসব কল্পকাহিনী সে সময় চালু করা হয়েছিল তাতে হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষের বীজ ছড়ানো হয়েছিল উদ্দেশ্যমূলকভাবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে বীজ অঙ্কুরিত হয়ে ডালপালা ছড়িয়ে মহীরুহ হয়েছে। এই মারণাস্ত্রকে অন্যতম হাতিয়ার করে দু’শ’ বছর শাসন করে গেছে ইংরেজ। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার যে বীজ তারা সযত্নে রোপণ করেছিল আজকের ভারত তা থেকে এখনও মুক্ত হতে পারেনি। ইতিহাস সম্মিলনীর গণবক্তৃতায় যোগ দিতে আসা ভারতের জামিয়া মিল্লাহ্্ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মুশিরুল হাসানও বলেছিলেন, ভারতবর্ষ স্বাধীনের পর রাজনীতিবিদরা অসাম্প্রদায়িক দেশ গঠনের লক্ষ্যে তেমন কোন কাজ করেননি। যদি তারা সেভাবে করতেন, তাহলে অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠন সম্ভব হতো। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় অসাম্প্রদায়িকতার কোন বিকল্প নেই। বিভক্ত সমাজে যারা ঘৃণা ছড়াতে চান তারাই ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করেন। বর্ণ প্রথা, সমাজ, ভাষা- এগুলো নির্বাচনের জন্য দরকার হয়। আসলে এগুলো একটি পরিচয় তৈরি করে, আর রাষ্ট্র এসবের সঙ্গে সমঝোতা করে। বহু ধর্ম আর বহু সংস্কৃতি থাকবেই, তাই বলে তা রাষ্ট্রযন্ত্রে টেনে আনা ঠিক না। ইতিহাসে এর সুফল কখনও দেখা যায়নি। অধ্যাপক হাসান বলেছেন, ভারতবর্ষ স্বাধীনের পর রাজনীতিবিদরা অসাম্প্রদায়িক দেশ গঠনে তেমন উদ্যোগ নেননি। না নিতে পারার অন্যতম কারণ সম্ভবত স্বাধীনতার নামে ভারতবর্ষ আসলে পেয়েছিল ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন বা ডমিনিয়ন স্টেটাস। ইংরেজের প্রত্যক্ষ শাসনের অবসান হলেও পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণের বাইরে বেরনো রাজনীতিবিদদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। সুতরাং তাদের শাসনে ঔপনিবেশিক শাসকদের ছায়া থাকবে। তাই স্বাভাবিক, সময়ের বিবর্তন ও বিশ্ব রাজনীতির বাঁক বদলের সঙ্গে প্রভু বদল হলেও শুধু ভারত নয়, গোটা উপমহাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার এখনও সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। প্রত্যেক দেশের নিজস্ব বাস্তবতা অনুযায়ী এ অস্ত্র প্রয়োগ হয়। ধর্ম থেকে রাজনীতি বা রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা করার জন্য দক্ষিণ এশীয় বিশেষজ্ঞদের এ মতবিনিময়ের আয়োজন প্রশংসনীয় নয় শুধু, ভীষণ জরুরীও। সম্মেলনে অংশ নিতে পাকিস্তান থেকে এসেছিলেন জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মওদুদীর ছেলে পাকিস্তানের জনপ্রিয় কলামিস্ট সাইয়েদ হায়দার ফারুক মওদুদী। তিনি এদেশের রাজনীতির ঘোরতর অসঙ্গতি চিহ্নিত করে যে প্রশ্ন রেখেছেন তা এদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষদের আরও একবার আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি করেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশই সম্ভবত বিরলতম সেই দেশ যে দেশের জন্মের সরাসরি বিরোধিতাকারী দল স্বাধীনতার পর শাসন ক্ষমতার অংশীদার হয়ে দেশ পরিচালনা করেছে। হায়দার ফারুক মওদুদী বিস্মিত। তাঁর প্রশ্ন, যে দল এদেশের জন্মে বিশ্বাস করে না, এদেশের স্বাধীনতা স্বীকার করে না, সে দল এদেশে রাজনীতি করে কি করে? শুধু প্রশ্নই করেননি অভিমতও দিয়েছেন- ঊনিশ শ’ একাত্তর সালে বাংলাদেশ সৃষ্টির বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীর বাংলাদেশে রাজনীতি করার কোন নৈতিক অধিকার নেই। জামায়াত বাংলাদেশের শুধু বিরোধিতা করেনি, এখানে গণহত্যায় অংশ নিয়েছে। জন্ম-পরিচয়হীন সন্তানের যেমন সম্পত্তিতে কোন অধিকার থাকে না, জামায়াতের তেমনি এদেশে রাজনীতি করার কোন অধিকার নেই। তিনি হয়ত জানেন অথবা সবটুকু জানেন না যে, ভোটের রাজনীতির সুবিধাবাদী চরিত্রের সুযোগ নিয়ে জামায়াত এদেশের শাসক দলগুলোর ঘাড়ে চেপে শুধু রাজনীতিই নয়, স্বাধীন দেশের পতাকা উড়িয়ে জাতীয় সংসদে আইন প্রণেতার আসনেও বসেছে। এদেশের মানুষের হৃদয়ে জামায়াতে ইসলামীর কোন জায়গা নেই। কিন্তু নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলের কাছে তারা জামাই আদর পায়। রাজনীতি থেকে ধর্ম আলাদা করতে হলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার এ জায়গাটি চিহ্নিত করা সবচেয়ে জরুরী। স্বাধীন বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত মুক্তিযোদ্ধাদের লাথি মারার ধৃষ্টতা ও ‘ভি’ চিহ্ন দেখানোর দুঃসাহস পেয়েছে রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত হওয়ার এবং সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদদের চারিত্রিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে। বাংলাদেশে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার ভারতের চেয়ে মাত্রা এবং চরিত্রগতভাবে সম্পূর্ণ আলাদা। ঊনিশ শ’ চুয়ান্ন সালে পূর্ব বাংলা থেকে মুসলিম লীগ উচ্ছেদের পর এখানে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হালে আর পানি পায়নি। ষাট দশকের শেষ দিক থেকে জামায়াত সংগঠিত হতে থাকে। কিন্তু চারিত্র্য বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে তারা সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল নয়, ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনৈতিক দল হিসেবে বিকশিত হয়। সাম্প্রদায়িক দল হিসেবে মুসলিম লীগের আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল হিন্দু সম্প্রদায় আর জামায়াতে ইসলামীর লক্ষ্য হচ্ছে বামপন্থী প্রগতিশীলসহ সব ধরনের সেক্যুলার গোষ্ঠী। কিন্তু সাতচল্লিশ সালের পর থেকে পূর্ব বাংলায় যে সেক্যুলার গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হয়েছিল, যার দৃষ্টান্ত এ উপমহাদেশে বিরল। জনগণ যেভাবে সাম্প্রদায়িকতাসহ ধর্মের সব ধরনের রাজনৈতিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে একটানা সংগ্রাম করেছেন, তাতে স্বাধীন দেশে সেক্যুলার এবং প্রগতিশীল ধারার স্বাভাবিক বিকাশ ঘটবে এমনটাই ছিল স্বাভাবিক প্রত্যাশা, কিন্তু বাস্তবচিত্র প্রায় উল্টো। রাজনীতি ও সমাজ জীবনে ধর্মের বাড়াবাড়ি যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তা রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এমনকি পাকিস্তান আমলেও দেখা যায়নি। কেন এমন হলো? এর উত্তর এক কথায় কেউ দিতে চাইলে তা কেবল এ জটিল বিষয়ের সরলীকরণ করা হবে। শুধু এটুকু বলা যায়, দেশীয় রাজনীতির রঙ্গ মঞ্চে যা মঞ্চায়িত হয় তার মূল প্রম্পটার আন্তর্জাতিক। দু’হাজার এক সালের এগারো সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে বোমা বিস্ফোরণের পর বিশ্ব রাজনীতিতে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের নতুন নতুন কম্পোনেন্ট দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের চরম অবনতি এ সময়ের মৌলবাদী রাজনীতির উল্লেখযোগ্য দিক। গত কয়েক দশকে দেশে মাদ্রাসাকেন্দ্রিক যেসব সংগঠন গড়ে উঠেছে তারা তাদের অর্থের যোগানদারদের পরিকল্পিত ছক অনুযায়ী কাজ করছে। ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার নামে এসব সংগঠন কর্মীদের সংগঠিত করলেও তাদের মূল উদ্দেশ্য নির্দোষ ধর্ম প্রচার নয়, ধর্মযুদ্ধ বা জেহাদের নামে প্রগতিশীল ও সেক্যুলার শক্তি ও সংগঠনের ওপর আক্রমণ চালানো। এ জন্য তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সুস্থ প্রগতিশীল ধারার চর্চাকে অস্থিতিশীল করা এদের মূল কাজ। বাংলাদেশে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের এত বিস্তৃতির আরেক কারণ স্বাধীনতার পর থেকে দেশে বামপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলনের সঠিক বিকাশ না ঘটা। বামপন্থী আন্দোলনের ক্রমশ মেধা ও নেতৃত্বহীন হয়ে পড়া যে শূন্যতা সৃষ্টি করেছে সেখানে ধর্মের নামে নানা আবর্জনা সহজে ঢুকতে পারছে। বামপন্থী আন্দোলনের সঠিক চর্চা ও বিকাশ ঘটলে এদেশে বিপ্লব না হোক অন্তত সেক্যুলার ও প্রগতিশীল হিসেবে রাষ্ট্রের ভারসাম্য বজায় থাকত। ধর্মের নামে যেসব অপশক্তি জেঁকে বসে রাষ্ট্রকে মধ্যযুগের দিকে ঠেলে দিতে চাচ্ছে, সে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো না। ভাবতে অবাক লাগে সাতচল্লিশের পর থেকে শক্তিশালী কৃষক-শ্রমিক আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতা বা রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, বাঙালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশে ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামের সংগঠন মধ্যযুগীয় জীবন ধারার তেরো দফা দাবি নিয়ে রাস্তায় নামে। আর গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত শাসকশ্রেণীর একপক্ষের প্রত্যক্ষ সমর্থন পায়। ভোটের বৈতরণী পার হতে অন্য পক্ষও এর প্রতি ঝুঁকতে দ্বিধা করে না। বাংলাদেশের রাজনীতির দুর্বলতম এ উপসর্গ দূর করতে না পারলে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার দূর করা কোনভাবে সম্ভব নয়।
×