ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ডাঃ শাহজাদা সেলিম

ডায়াবেটিস প্রজনন স্বাস্থ্য

প্রকাশিত: ২৩:৪৭, ৮ ডিসেম্বর ২০২০

ডায়াবেটিস প্রজনন স্বাস্থ্য

ডায়াবেটিস একটি সর্বোগ্রাসী শারীরিক সমস্যা; যা শরীরের প্রায় প্রতিটি অঙ্গ-প্রতঙ্গকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। ডায়াবেটিসের রোগীরা মানসিকভাবেও আক্রান্ত থাকেন। ডায়াবেটিস শরীরের কোষগুলোর বহুবিধ পরিবর্তন সাধিত করে; যা ক্রমশ দীর্ঘস্থায়ী ও ক্রম:অগ্রসরমান শারীরিক সমস্যা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো- ডায়াবেটিস প্রজনন স্বাস্থ্যকে কিভাবে আক্রান্ত করে। প্রতিবছরই বিপুলসংখ্যক যুবক-যুবতী নতুন করে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে- প্রধনত টাইপ ২ ডায়াবেটিসে, কেউ কেউ টাইপ ১ ডায়াবেটিসে। সম্প্রতি অনেকগুলো গবেষণালব্ধ ফলাফল এটি সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে যে, ডায়াবেটিস বিশেষত; যাদের ডায়াবেটিসের নিয়ন্ত্রণ ভাল নয়, তাদের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিসই সন্তান ধারণের প্রধান বাধা। এমনকি প্রি-ডায়াবেটিস অবস্থাতেও পুরুষ-মহিলাদের প্রজনন ক্ষমতা ঝুঁকিতে থাকে। ডায়াবেটিস কিভাবে পুরুষের প্রজনন স্বাস্থ্যকে আক্রান্ত করে ডায়াবেটিস, সুনির্দিষ্ঠভাবে রক্তের অতিরিক্ত গ্লুকোজ, পুরুষের প্রজনন তন্ত্রের প্রায় প্রতিটি অঙ্গকে কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ ক্ষেত্রে নিয়ামকের ভূমিকায় থাকে ডায়াবেটিসের বয়স, ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রণের মাত্রা এবং দৈহিক স্থ’লতা। ফলস্বরূপ নিম্ন বর্ণিত কমপক্ষে ৪টি সমস্যা দেখা দিতে পারে। ইলেক্টোরাল ইরেক্টাইল : ডায়াবেটিস আক্রান্ত পুরুষদের ইলেক্টোরাল ডিসফাংশন একটি কমন সমস্যা, যা স্নায়ুবিক কারণে হতে পারে; লিঙ্গে রক্ত সরবরাহ বিঘ্নের কারণে হতে পারে অথবা উভয়ের সমন্বিত ফল হতে পারে। ডায়াবেটিসের কন্ট্রোল যত খারাপ থাকে বা যার ডায়াবেটিস যত বেশি দিন যাবত থাকে এর মাত্রাও তত বেশি হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ, রক্তের লিপিডের অস্বাভাবিকতা, ধূমপান, অতিরিক্ত মদ্যপান ও শারীরিক শ্রমহীনতা এ অবস্থাকে আরও নাজুক করে তুলতে পারে। ইজাকুলেটরিসমস্যা : ডায়াবেটিসের রোগীর ইজাকুলেটরির দু’রকমের সমস্যা হতে পারে। ক) ইজাকুলেটরি না হওয়া এবং খ) দু’রকমের ইজাকুলেটরি হওয়া। এ দু’ক্ষেত্রেই পুংলিঙ্গের স্নায়ুবিক সমস্যা প্রধান ভূমিকা রাখে। আক্রান্ত পুরুষটির মানসিক সমস্যাও ভূমিকা রাখতে পারে। নিম্নমানের শুক্রাণু : ডায়াবেটিসে আক্রান্ত পুরুষের প্রজনন তন্ত্রের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অংশ হতে পারে শুক্রাশয় বা অণ্ডকোষ। অতিরিক্ত গ্লুকোজের প্রভাব, যাকে গ্লুকোজের বিষক্রিয়া বলা যায়, সরাসরি শুক্রাণু উৎপাদনকে বাধাগ্রস্ত করে। আবার যে পরিমাণ শুক্রাণু তৈরি হয় তাও আদর্শ গুণগত মান পায় না অর্থাৎ এ পুরুষটির শুক্রাণু একটি সুস্থ সবল সন্তান উৎপাদনের সক্ষমতা অনেকটাই হারিয়ে ফেলে। হাইপোগোনাডিজম (টেস্টোসটেরণ হরমোনের ঘাটতি) : প্রতি ৪ জন ডায়াবেটিস পুরুষের কমপক্ষে ১ জন টেস্টোসটেরণ হরমোনের ঘাটতিতে আক্রান্ত। টেস্টোসটেরণ হরমোনটি পুরুষদের প্রধান যৌন হরমোন। এর অভাবে পুরুষের দৈহিক কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় যৌন ক্রিয়ার আগ্রহ কমে যাওয়ায় মানসিক দৃঢ়তা কমে এবং ইলেক্টোরাল ডিসফাংশন হতে পারে। অর্থাৎ টেস্টোসটেরন ঘাটতি আক্রান্ত পুরুষের সামগ্রিক প্রজনন ক্ষমতাকে ব্যাহত করে। প্রকৃত পক্ষে : ডায়াবেটিস রোগীর রক্তের অতিরিক্ত গ্লুকোজ (হাইপারগ্লাইসেমিয়া) শুক্রাণুর ডিএন’র স্থায়ী পরিবর্তন করে যা এ শুক্রাণুর মান নিম্নমুখী করে দেয়। অর্থাৎ ডায়াবেটিস রোগীর প্রজনন ক্ষমতার মূল জায়গাটিতেই মারাত্মক রকম ক্ষতি সাধিত হয়ে থাকে। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত পুরুষদের মাঝে যারা সন্তান নিতে সক্ষম হননি এবং অথবা যারা ভবিষ্যতে সন্তান নিতে আগ্রহী তাদের ক্ষেত্রে এখনি সতর্ক হওয়া জরুরী। ডায়াবেটিসের সকল রোগীর ক্ষেত্রেই করণীয় কর্মকাণ্ডের শীর্ষে থাকে ডায়াবেটিসের কাক্সিক্ষত নিয়ন্ত্রণ। এই ক্ষেত্রে আরও সুকঠোরভাবে ডায়াবেটিসের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, যা পরবর্তী সকল সময়ে বজায়ও রাখতে হবে। এ সকল পুরুষের একই সঙ্গে অন্য আরও কিছু শারীরিক সমস্যা থাকতে পারে সেগুলোকেও গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে তবে, ডায়াবেটিসের পুরুষ তার নিজের দৈহিক জটিলতা কমাতে তোবটেই সন্তান নেয়ার সক্ষমতা বাড়াতে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের আদর্শতম পদ্ধতির আশ্রয় নেবেন (কোন একজন দক্ষ ও হরমোন বিশেষজ্ঞ এ ব্যাপারে সবচেয়ে ভাল সাহায্য করতে পারেন), দৈহিক স্থ’লতা হ্রাসসহ শারীরিক অন্যান্য প্যারামিটারের উন্নতি সাধন করতে হবে, ধূমপান ত্যাগ করতে হবে এবং তারপরও কোন কোন ক্ষেত্রে কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতির সাহায্য নিতে হতে পারে। ডায়াবেটিস কিভাবে মহিলাদের প্রজনন স্বাস্থ্যকে আক্রান্ত করে ডায়াবেটিস মহিলাদের সন্তান ধারণক্ষমতা অর্ধেকে নামিয়ে আনে। আর যারা দীর্ঘদিন যাবত ডায়াবেটিসে ভুগছেন এবং চতুর্থদশকে এসে সন্তান ধারণ করতে চাচ্ছেন, তাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটি আরও ব্যাপক। বিপুলসংখ্যক মেয়ে (বয়স ১৫-৪৫ এর মধ্যে প্রধানত:) পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোমে ভুগছে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে এর প্রাবল্য ও গভীরতা ব্যাপক। পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম এর যুবতীদের অন্তত: ৪০ শতাংশ এদের ৪০ বছর বয়স হওয়ার আগেই টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবেন। কিন্তু, ভাবনার বিষয় হলো, পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম নিজে মহিলাদের বন্ধ্যত্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ, এসব মহিলার ডায়াবেটিস হলে দুয়ে মিলে ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যাবে। টাইপ ১ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে ঝুঁকি আরও বেশি। যে সকল মহিলা ডায়াবেটিস নিয়েই গর্ভধারণের কথা ভাবছেন, তাদের জরুরীভিত্তিতে একজন হরমোন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে ডায়াবেটিসের নিয়ন্ত্রণ নিখুঁতইকরণ করা জরুরী। যাদের ডায়াবেটিস নেই বলে ভাবছেন, এমনকি তাদেরকেও গর্ভধারণ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ডায়াবেটিস স্ক্রিন করা উচিত। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত ওষুধগুলোর মধ্যে থেকে প্রাক গর্ভধারণ সময়কালের জন্য উপযোগী ওষুধগুলো চিকিৎসক আপনাকে নির্বাচন করে দেবেন। কিন্তু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণকেই প্রাধান্য দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস রোগীর জন্য সুষমখাদ্য তালিকা মেনে চলা, পরিমিত শারীরিক শ্রম এবং ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিগত অভ্যাসগুলো (জর্দা, গুল, সাদাপাতা ও ধূমপান)। ডায়াবেটিস নিয়েও যেসব মহিলা সন্তান নেয়ার পরিকল্পনা করছেন, তারা দ্রুত একজন প্রসূতিবিদ ও হরমোন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেবেন। কারও কারও কৃত্রিম প্রজনন ব্যবস্থার সাহায্য নেয়া প্রয়োজন হতে পারে। লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ফোন : ০১৯১৯০০০০২২
×